ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

ভালোবাসা যত্ন ছাড়া টিকে না দেশের ফুটবলকে আদৌ কি আমরা ভালোবাসি?

রেজানুর রহমান
২৩ নভেম্বর ২০২২, বুধবার
mzamin

যাবো জাতীয় প্রেস ক্লাবের দিকে। অটোরিকশায় বসে যাচ্ছি। একটু আগে চায়ের দোকানের সামনে বসা সেই লোকটির ফুটবল স্বপ্নই চোখের সামনে ভাসছে। চমৎকার প্রস্তাবনা। দেশের ফুটবলের জাগরণে এরকমই কোনো উদ্যোগ জরুরি। ৩০০ এমপি’র নেতৃত্বে দেশের ৩০০ স্থানে ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেখান থেকে বাছাই করা ৩০০ সেরা খেলোয়াড়। ৩০০ সেরা গোলকিপার খুঁজে নেয়া হলো

সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি পতাকা বানিয়েছে মাগুরার একদল তরুণ। নিজের দেশের পতাকা নয়। অন্য দেশের।

বিজ্ঞাপন
জার্মানির পতাকা। এই পতাকার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে মরিয়া ফুটবলে জার্মানিই সেরা। তাই জার্মানিই তাদের পছন্দ। এই পতাকা বানাতে তাদের অনেক খরচ হয়েছে। অঙ্কের পরিমাণটা আপাতত উল্লেখ করছি না। যারা এব্যাপারে কিছুই জানেন না তারা জানার পর অনেকেই হয়তো টাসকি খাবেন। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পতাকা। কতো গজ কাপড় দরকার? শুধু তো কাপড় থাকলেই হবে না। কাপড়ে পতাকার নির্ধারিত প্রতীক, সঙ্গে রঙ দিতে হবে। এক গজ দুই গজের ব্যাপার হলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু এটা তো শত শত গজের ব্যাপার। অঙ্কের হিসাব জানতে হবে। সেই সঙ্গে আরও কতো যে খুঁটিনাটি ব্যাপার আছে। একদিনে এত বড় পতাকা বানানো সম্ভব হয়নি। অনেকদিন ও অনেক সময় লেগেছে। একটি পতাকার জন্য এত আয়োজন? তাও না হয় নিজের দেশের পতাকা হলে একটা কথা ছিল। অন্যদেশের পতাকার জন্য এত মায়া কেন? রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডায় এই প্রশ্নটাই ছুড়ে দিলেন একজন বয়স্ক লোক। তার পরিচয় জানি না। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে বলে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। পরিচিত দোকানদার। মাঝে মাঝে তার দোকানে চা খাই। ম্যাট্রিক পাস তরুণ। বাগেরহাটে বাড়ি। চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে চাকরি না পেয়ে শেষমেশ চায়ের দোকান দিয়ে বসে। ওর ব্যবহারের গুণে সারাক্ষণই চায়ের দোকানটিতে ভিড় লেগেই থাকে। চা খেতে খেতে কতো যে আলোচনা করে মানুষ। রাজনীতি, সমাজনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এমন কি নায়ক-নায়িকার লেটেস্ট প্রেম পরিণয়ের খবরও তারা আলোচনা করে। যেন একটি মিনি পার্লামেন্ট। 

 

 

 যিনি জার্মানির সাত মাইল দৈর্ঘ্যের পতাকার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তার হাতে চায়ের কাপ। বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে চায়ের দোকানের সামনে বসা লোকজনের উদ্দেশ্যে বললেন, দ্যাশে এমনিতেই কতো সমস্যা। জিনিসপত্রের দাম পাগলা ঘোড়ার লাহান অস্থির। মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিছে দেশের মানুষ। সেখানে অন্য দেশের পতাকা নিয়ে এত মাতামাতি ক্যান? দ্যাশের পতাকা হইলে না হয় একটা কতা ছিল। চিন্তা করেন সাত মাইলের পতাকা। লাখ লাখ টাকা খরচ হইছে। এই টাকাটা দ্যাশের কল্যাণে ব্যবহার করলে ভালো হইতো না? লোকটিকে থামিয়ে দিলেন তার পাশেই বসা অন্য একজন। মধ্যবয়সী লোক। বললেন, ভাই আপনি ব্যাপারটা এই ভাবে দেখছেন কেন? পজিটিভ ভাবে দেখেন। এইটা কিন্তু ভাই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। কোনো দেশের জন্য নয়। মধ্যবয়স্ক লোকটিকে থামিয়ে দিলেন বয়স্ক লোকটি- কি বললেন আপনি? ফুটবলের জন্য ভালোবাসা? এই যে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ কইর‌্যা অন্য দেশের পতাকা বানাইতেছেন তারা ওই টাকা দিয়া সত্যিকার অর্থে দেশের ফুটবলের উন্নতির জন্যই কাজ করতে পারতেন। আমাকে আপনি তাইলে প্রশ্ন করেন- কীভাবে এটা সম্ভব? মধ্যবয়স্ক লোকটি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন- কীভাবে সম্ভব বলেন তো শুনি।  বয়স্ক ভদ্রলোক চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন- মাগুরার কথাই বলি। শুনছি জার্মানির পতাকা বানানোর জন্য নাকি ৩০ লাখেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। ভাই চিন্তা কইর‌্যা দেখেন একটা দুইটা টাকা না। ৩০ লাখ টাকা। 

তোরা যদি ফুটবলই ভালোবাসিস তাইলে ফুটবলের জন্য কিছু কর। এই টাকা দিয়া তারা বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষেই একটা ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করতে পারতেন। যতদিন বিশ্বকাপ ফুটবল চলবে ততদিন এই টুর্নামেন্টও চলবে। ধরেন গিয়া আঞ্চলিক পর্যায়ের ২০টা ফুটবল ক্লাব এই টুর্নামেন্টে অংশ নিলো। টুর্নামেন্টে সেরা ফুটবলার, সেরা গোলরক্ষকের জন্যও পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। যদি এই ধরনের উদ্যোগ তারা নিতে পারতো তাইলে সত্যিকার অর্থে একটা কাজের কাজ হইতো, বলতে বলতে ফুটবল নিয়ে আরও অনেক বড় স্বপ্ন ছড়িয়ে দিলেন তিনি। বললেন, এই যে ধরেন দেশে ৩০০ জন এমপি আছেন। তারাও নিশ্চয়ই কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেন্টিনা, জার্মানি অথবা ফ্রান্সের সাপোর্টার। ভালো কথা। যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নাই, কাজেই আমরা তো কাউকে না কাউকে সাপোর্ট করবো? বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশের ফুটবল কেন বিশ্বকাপে নাই? এই দেশে ফুটবলের জোয়ার ছিল না? শহরের বাইরে একেবারে অজপাড়া গাঁয়ে এক সময় ফুটবল টুর্নামেন্ট হইতো। দেশের ফুটবলের জন্য মানুষের কতো যে মায়া, ভালোবাসা ছিল। এইসব মায়া আর ভালোবাসা গেল কোথায়? ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা থাকলে মানুষের ভিড় ঠেকানো যাইতো না। দেশের ফুটবলের জন্য এমন ভালোবাসাই তো ছিল।

 এখন ভালোবাসা নাই কেন? বয়স্ক লোকটি ক্রমান্বয়ে উত্তেজিত হচ্ছেন। অন্য সবাই নিশ্চুপ তার কথা শুনছিল। হঠাৎ একজন ক্ষোভের সঙ্গেই বললো, ভাই এই কথা সালাহউদ্দিন সাবেরে জিগান। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। খেলোয়াড় হিসেবে আমি তাকে রেসপেক্ট করি। কিন্তু ফুটবলের প্রশাসক হিসেবে তিনি ফ্লপ। দেশের ফুটবলের জন্য তিনি একটা ভালো কাজ করেছেন? বলেন আপনারা? আমার কাছে ডকুমেন্ট আছে। কয়েক বছর আগে তিনি প্রায় কসম কইর‌্যা বলেছিলেন ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলবে। কেমনে বলেছিলেন এই কথা? এখন তার লজ্জা করে না? এই লোকের সমর্থনে পাশেই বসা অন্য একজন বললেন, ভাই আপনি একদম খাঁটি কথা বলেছেন, একদিকে সালাহউদ্দিন অন্যদিকে পাপন ভাই, মাঝখানে ওয়াসার এমডি তাসকিন সাহেব খেলা ভালোই খেলতেছেন। ক্রিকেটে পাপন ভাই, ফুটবলে সালাহউদ্দিন ভাইয়ের তুলনা নাই। তাসকিন সাহেব আরও এক ডিগ্রি উপরে আছেন। তিনি নাকি বিদেশে বইস্যা চাকরি করেন। নিজের বেতন নিজে বাড়াইয়া নেন। 

পত্রিকায় দেখলাম- তিনি বলেছেন- বিদেশে বসে দেশের চাকরি করতে দোষ কোথায়? এইটা কি ভাই বিবেকবান মানুষের কথা? সৎ মানুষের কথা? এই লোককে থামিয়ে দিলেন পাশেই বসা আরেকজন। বললেন, ভাই ফুটবল নিয়া কিছু বলেন। আপনি ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?  ক্ষুব্ধ লোকটি উত্তর দিলো- আমি ভাই ব্রাজিল আর্জেন্টিনা, কোনোটাই না। আমি বাংলাদেশের সাপোর্টার। তাকে যিনি একটু আগে প্রশ্ন করেছেন তিনি আবার প্রশ্ন করলেন- বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপে নাই।  লোকটি আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন- বাংলাদেশ কেন বিশ্বকাপে নাই। মাত্র ৩০/৩৫ লাখ মানুষের দেশ উরুগুয়ে বিশ্বকাপে আছে। আর ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নাই। কেন নাই? এই দেশের মানুষ কি উরুগুয়ের চেয়ে ফুটবলকে কম ভালোবাসে?  এই লোকের কথায় আবার সবাই চুপ। আমার চা খাওয়া শেষ। গন্তব্যে পা বাড়াবো ভাবছি। হঠাৎ ক্ষুব্ধ লোকটি দেশের ফুটবলের উন্নয়নে একটি চমৎকার প্রস্তাব দিয়ে বসলো। ভাই আমি ছোটমুখে একটা বড় কথা বলি। আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এখন চলছে মেধার যুগ। সেজন্য অনুশীলন দরকার। এই যে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়া সারা দেশে এত উত্তেজনা শুরু হয়েছে এটাকে কাজে লাগিয়েই আমরা দেশের ফুটবল নিয়ে একটা কাজ করতে পারতাম। সেটা কেমন? বলছি শোনেন, ৩০০ জন সংসদ সদস্য আছেন। তাদের নেতৃত্বে দেশের ৩০০টি স্থানে পৃথক ভাবে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা যেত। 

ভেবে দেখুন একবার সারা দেশে একযোগে ৩০০টি স্থানে ফুটবলের আয়োজন শুরু হয়েছে। প্রতিটি টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়, সেরা গোলকীপারকে খুঁজে বের করা হবে। তারা পুরস্কারও পাবেন। এই যে এক সঙ্গে ৩০০ জন সেরা খেলোয়াড় ও সেরা গোলকীপার পাওয়া গেল পরবর্তীতে তাদেরকে বাছাই করে যদি জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে আমার ধারণা কিছু ভালো ফুটবলার বেরিয়ে আসবে। কী বলেন আপনারা?  সবাই তার কথায় হাত তালি দিতে থাকলো। আমি গন্তব্যে পা বাড়ালাম।  যাবো জাতীয় প্রেস ক্লাবের দিকে। অটোরিকশায় বসে যাচ্ছি। একটু আগে চায়ের দোকানের সামনে বসা সেই লোকটির ফুটবল স্বপ্নই চোখের সামনে ভাসছে। চমৎকার প্রস্তাবনা। দেশের ফুটবলের জাগরণে এরকমই কোনো উদ্যোগ জরুরি। ৩০০ এমপি’র নেতৃত্বে দেশের ৩০০ স্থানে ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেখান থেকে বাছাই করা ৩০০ সেরা খেলোয়াড়। ৩০০ সেরা গোলকিপার খুঁজে নেয়া হলো।  দেশে ঢাকায় তাদের জন্য বছরব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু হলো। আমার বিশ্বাস এদের মধ্য থেকেই মেসি, নেইমার, রোনালদোর মতো বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড় বের হয়ে আসবে।  দেশের ৩০০ জন এমপি এই উদ্যোগটা এখনো নিতে পারেন। এজন্য দরকার আন্তরিকতা। সামনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোটের লড়াই শুরু হবে। নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যও সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।  একটা কথা মনে রাখা দরকার- ভালোবাসি কথাটা শুধু মুখে বললেই হয় না। ভালোবাসাও পরিচর্যা চায়। গুরুত্ব চায়। মুখে বললাম দেশের ফুটবলকে ভালোবাসি।

 কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ফুটবলের জন্য কিছুই করলাম না তাহলে এই ভালোবাসা টিকবে না। ভালোবাসাও প্রতিদান চায়। আসুন সকলে মিলে দেশের ফুটবলের পাশে দাঁড়াই।  অনুজ প্রতীম সাংবাদিক, সহকর্মী দৈনিক জনকণ্ঠের মোরসালিন মিজানের একটি লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই।  মোরসালিন লিখেছেন, সেই কবে মরেছে ফুটবল। মরে ভূত হয়ে গেছে। কি, বেশি হয়ে গেল বলাটা? একদমই নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ মূল্যায়ন যথার্থ। খেলাটি বৃষ্টির জলে ধোয়া কর্দমাক্ত মাঠে একেবারে দেবে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে উদ্ধারের কোনো আশা নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম দেশের নারী ফুটবলাররা। তাদের পায়ে ভর করে ফুটবলে বড় বড় সাফল্য আসছে। কিন্তু ফুটবলকে ঘিরে প্রাচীন আবেগ, চিরায়ত ভালোবাসা, সেই ফুটবল কিনা অস্তিত্ব সংকটে। দেশে ফুটবল নেই। ফুটবলার নেই। তবে খেলাটির জন্য আছে আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা...  আবারো বলি যত্ন এবং গুরুত্ব না পেলে ভালোবাসা টিকে না। ফুটবলকে ভালোবাসি। কিন্তু তার জন্য আমাদের যত্নের আয়োজন কি পর্যাপ্ত? জবাবটা কার কাছে চাইবো?    

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status