নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
ফুটবল ও আমাদের আবেগ
সামন হোসেন
২১ নভেম্বর ২০২২, সোমবারফুটবল উন্মাদনার মধ্যে থাকা বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ আসলেই এক মাসের জন্য এই দেশটির আকাশ-মাটি হয়ে যায় যেন এক খণ্ড ব্রাজিল, এক টুকরো আর্জেন্টিনা। সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপে ভাগ হয়ে যায় জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমারদের প্রমাণ সাইজের অবয়বে পড়ে নতুন রঙের প্রলেপ
দর্শক আগ্রহ হারিয়ে এখন ধুঁকছে দেশের একসময়ের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। আবাহনী ও মোহামেডান দ্বৈরথও আগের মতো আবেদন জাগাতে পারছে না। গ্যালারিতে নেই পুরনো সেই তর্জন-গর্জন। জাতীয় দলও সফলতা পাচ্ছে না। সোজা কথা দেশের শ্রী বাড়ানো ফুটবল এখন একেবারে শ্রীহীন। তাই বলে ‘ফুটবল’ শ্রীহীন হয়ে যায়নি। বরং দিনকে দিন এর জৌলুস বাড়ছে।
বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বিশ্বের যেকোনো বড় ক্রীড়াযজ্ঞ আয়োজন করতে গেলে বিতর্ক থাকবেই। কাতারও তার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু বল মাঠে গড়ানোর আগেই কাতারকে ঘিরে মাঠের বাইরের কিছু বিষয় নিয়ে যেভাবে সমালোচনা হয়েছে তাতে জল কম ঘোলা হয়নি। বিশেষ করে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ভেন্যুুগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থানীয় আয়োজকদের প্রায় পুরোটাই অভিবাসী শ্রমিদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এই অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে দাবি করে পশ্চিমা দেশগুলো বলেছে তাদেরকে নায্য পাওনা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারী ইউরোপিয়ান দেশগুলোও এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু সব সমালোচনার জবাব হয়তো কখনো কখনো প্রমাণ করা যায়, কিছু আবার যায় না। কাতারের মতো তেল সমৃদ্ধ একটি ধনী দেশের জন্য বিশ্বকাপ আয়োজনে অর্থের কোনো অভাব হয়নি। এই আয়োজনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ফুটবল উন্মাদনার মধ্যে থাকা বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ আসলেই এক মাসের জন্য এই দেশটির আকাশ-মাটি হয়ে যায় যেন এক খণ্ড ব্রাজিল, এক টুকরো আর্জেন্টিনা। সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপে ভাগ হয়ে যায় জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমারদের প্রমাণ সাইজের অবয়বে পড়ে নতুন রঙের প্রলেপ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তো চলতি হাওয়ার নাগরদোলার চক্কর। বিষয় ওখানে ঘোরে দ্রুতবেগে। এই রাজনীতি, এই সমাজনীতি; এই অশ্লীলতার আস্ফালন, এই মানবিকতার আশ্চর্য আঁধার। সঙ্গে নিজেকে জাহির করার ব্যাপার তো রয়েছেই! সেই ফেসবুকেও বদলের ছোঁয়া লাগে। প্রোফাইল পিকচার পাল্টে যায়। প্রিয় ফুটবলার কিংবা দলের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে সেখানে। স্ট্যাটাসের ধরনে আসে পরিবর্তন। নিজ দলের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির পাশাপাশি প্রতিপক্ষ নিয়েও চলছে অবিরাম খোঁচাখুঁচি। জবাব-পাল্টা জবাব। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এই উন্মাদনা যে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক, তা কিন্তু নয়। গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মিন্টু নামের একজন শখের বাগান বিক্রি আর স্ত্রীর জমানো মোট ৫ লাখ টাকা দিয়ে নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার লম্বা দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা টানিয়েছেন। একই শহরে একজন তার পাঁচতলা বাড়ি ব্রাজিলের পতাকার রংয়ে রাঙিয়েছেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন রাজধানীর মুগদা ও খিলগাঁওয়ে আয়োজন করা হয় আনন্দ শোভাযাত্রার। অংশ নেন নানা বয়সের মানুষ। ছিল মোটরসাইকেলের বহর, সাজানো ঘোড়ার গাড়ি।
ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রিয় দলের সমর্থনে দেয়া স্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ। শোভাযাত্রায় বাংলাদেশ এবং বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়া ৩২টি দেশের পতাকা ছিল। মুগদা থেকে শুরু হয়ে শোভাযাত্রাটি শেষ হয় বাফুফে ভবনের সামনে। এমন আয়োজনে খুশি ফুটবল ভক্তরা। মোটকথা বিশ্বকাপ শুরুর সময় যত ঘনিয়ে আসছে, উন্মাদনা ততই বাড়তে থাকে। আমি নিজে ক্রীড়া সাংবাদিক হলেও আর্জেন্টিনার পাড় ভক্ত। আমার স্ত্রীও তাই। দল নিয়ে আমার ঘরে বিভক্তি না থাকলেও বন্ধু পারভেজ আছে মধুর যন্ত্রনায়। ও আর্জেন্টিনার সমর্থক। এরইমধ্যে ডজন খানেক আর্জেন্টিনার জার্সি আছে ওর জিম্মায়। কিন্তু পারভেজের স্ত্রী জুথি ব্রাজিলের সমর্থক। পারভেজ ব্রাজিলের জার্সি কিনে না দেয়ায় অনলাইনে জার্সির অর্ডার দিয়েছে জুঁথি। সহকর্মী দম্পতি পিয়াস সরকার-আইরিন আঁচলও দুই দলে বিভক্ত। আঁচল আর্জেন্টিনার ও পিয়াস সরকার ব্রাজিলের সমর্থক। একঘরে বসবাস করলেও ভিন্ন দুই দলের জার্সি পরে নিজেদের সমর্থন দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আমার ধারণা বিশ্বকাপ নিয়ে এই যে বিভক্তি, এটা শুধু আমার চারপাশে নয়, খেলা যারা পছন্দ করে এমন সবখানে। হাজার হাজার মাইল দূরের অচেনা-অজানা এই দেশগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এই যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ, তা দেখে প্রায়ই মনে প্রশ্নে জাগে, কেন এমন আবেগী আর জোড়ালো সমর্থন। শুধু কী একজন মেসি, নেইমার কিংবা রোনালদোর কারণেই এতটা মাতামাতি, নাকি অন্য কিছু।
এই কারণ খোঁজার আগে চলুন জানার চেষ্টা করি- ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এই যে আগ্রহ আর উন্মাদনা ঠিক কবে থেকে শুরু। এটা একেবারে দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা বেশ পুরোনো। অর্থাৎ স্বাধীনতারও আগে থেকে ক্লাব ফুটবল বেশ জনপ্রিয় ছিল এই অঞ্চলে। সেটা অব্যাহত ছিল ৯০ এর দশক পর্যন্ত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্যই মনে হতে পারে। অথচ সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেতো পুরো দেশ। বাড়িতে বাড়িতে উড়তো দুদলের পতাকা। খেলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাটি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হতো আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে। কিন্তু ফুটবল কর্তাদের সূদুরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা না থাকায়, কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের সেই সোনালী অধ্যায়। স্তিমিত হয়ে গেছে ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা। কিন্তু নিজেদের রক্তে ফুটবলের মোহনীয় জাদুর যে স্পর্শ সে সময় পেয়েছিল বাঙালি, তা কি কখনো ভোলা যায়? একদমই না। আমার ধারণা ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই উন্মাদনা তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়ার মূল কারিগর আর্জেন্টিনার দিয়াগো ম্যারাডোনা। তবে তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যেমন আমার সহকর্মী পিন্টু আনোয়ারের মুখেও বিটিভি’র পর্দায় ১৯৮২ সালের সেই বিশ্বকাপের গল্প শুনেছি।
একদিকে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা, ড্যানিয়েল প্যাসারেলা অন্যদিকে ব্রাজিল দলে জিকো, সক্রেটিসের মতো ফুটবলারদের নৈপুণ্যের ছবি এখনো নাকি তার চোখে ভাসে। সেবার হট ফেভারিট ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে সাড়া ফেলেছিলেন ইতালির পাওলো রসি। পরে দর্শকদের স্পর্শ করলো ১৯৮৬ বিশ্বকাপের উত্তাপ-জৌলুস। বিশ্ব মাতানো খেলোয়াড়দের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে টেলিভিশন। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়, ম্যারাডোনার সেই চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যের সঙ্গে, ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল। সবমিলিয়ে লাতিন ফুটবলের প্রতি আরও বেশি বুদ হয়ে যায় বাংলাদেশিরা। পরে পেলে-ম্যারাডোনার রেখে যাওয়া সেই ব্যাটন উঠেছে লিওলেন মেসি আর নেইমারদের হাতে। যাদের পায়ের জাদুতে তাবত পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের মতোই মুগ্ধ বাংলাদেশিরা। তারপরও মনে একটা প্রশ্ন চলেই আসে। তা হলো, মেসি অনেক বড় খেলোয়াড় তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু ম্যারাডোনার যে জাদু সেটাকে কি ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন? আবার সাফল্যের প্রয়োজনে মাঠের সেই শৈল্পিকতাকে বিদায় জানিয়েছে ব্রাজিল। তারপরও কেন, বাংলাদেশের মানুষ এতটা আবেগী এই দুটো দলকে নিয়ে। এর কয়েকটি যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। যদিও এদেশের মানুষের প্রবল ফুটবল প্রেম আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। অপ্রিয় হলেও সত্য, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে নিজ দলের অবস্থান তলানিতে। অথচ র্যাঙ্কিংয়ে একসময় বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে থাকা দেশ পানামাও বিশ্বকাপ খেলেছে ২০১৮ সালে। ১৯৯৩ সালে ফিফা র্যাঙ্কিং চালু হওয়ার পর পরবর্তী ৩ বছর বাংলাদেশ পানামা থেকে এগিয়ে ছিল। পরে পানামা র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে গেলেও কাছাকাছি অবস্থানেই ছিল।
এরপর র্যাঙ্কিংয়ে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যেতে থাকি। ২০১১ সালে কিছুটা উন্নতি হলেও এখন পর্যন্ত তলানিতেই রয়ে গেছে। ফিফায় অন্তর্ভুক্ত ২১১টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯২তম। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯৭৬ সালে ফিফায়, ১৯৭৪ সালে এএফসি আর ১৯৯৭ সালে সাফে অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর আমাদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ২০০৩ সালে একবার সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন। তাতেই আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭৩ সালে থাইল্যান্ডের সঙ্গে, যার ফল ছিল ২-২। ১৯৮৫ সালে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ সবেচেয়ে বড় জয় দেখতে পেয়েছিল মালদ্বীপের সঙ্গে, যা ছিল ৮-০। সেই মালদ্বীপের বর্তমান ফিফা র্যাঙ্কিং ১৫৮। যা আমাদের থেকে ২৬ ধাপ এগিয়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ফিফার বর্তমান র্যাঙ্কিং ১০০-এর নিচে, অথচ ৯৬-৯৭ সালে আমাদের কাছাকাছি ছিল। এই অধঃপতনের জন্য কে দায়ী? দেশের ফুটবলের এই দুরবস্থার জন্য অনেকেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নীতি-নির্ধারকদের দায়ী করেন। তবে এনিয়ে কোনো হেলদোল নেই সংশ্লিষ্টদের। তাদের ব্যর্থতার কারণেই বাংলাদেশের ফুটবল নামতে নামতে এতটাই নেমে গেছে যে, এই দলকে নিয়ে ছোটখাট আশা করাটাই কঠিন! যদিও বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সেই ২০১৩ সালে বলেছিলেন, ‘২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে আমরা খেলবোই। এর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তার জন্য আমরা প্রস্তুত।’
কাজী সালাউদ্দিনের এই বক্তব্য নিয়ে দেশে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। ওই সময় তিনি ‘ভিশন ২০২২’ নামের একটি উদ্যোগও নিয়েছিলেন। যেটা কোনো কাজে দেয়নি। অথচ এই ফুটবলকে পুঁজি করেই বড় বড় অট্টালিকা বানিয়েছেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী। ফুটবলই দেশজুড়ে খ্যাতি এনে দিয়েছে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে। আরিফ খান জয় ফুটবলার বলেই মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছেন। আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, হালের মামুনুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন এমিলিদের মানুষ চেনে এই ফুটবলকে কেন্দ্র করেই। তারা কি পেরেছে এদেশের মানুষের আবেগটাকে কাজে লাগিয়ে ফুটবল মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করতে?