নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
রেষারেষি, পিষে মারা এবং নিয়ম না মানার কালচার
শামীমুল হক
১৭ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবারসড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু চালকরা যে শপথ নিয়েছেন, পিষে মারার। তারা শপথ নিয়েছেন নিয়ম না মানার। কিন্তু পিষে মারা আর নিয়ম না মানার এ কালচার চলবে আর কতোদিন?
শেষ কথা হলো- সবার আগে চালকদের প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে। সড়কগুলোকে লেনে ভাগ করে নির্দিষ্ট গাড়িকে লেনের বাইরে চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পথচারীকে অবশ্যই রাস্তা পারাপারের সময় সতর্ক থাকতে হবে
সেদিন গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে দেখা গেল লাশ পড়ে আছে। লাশের একটু দূরে একটি মোটরসাইকেল এবড়োথেবড়ো হয়ে পড়ে আছে। লাশের মাথা থেঁতলে গেছে। কিছু মানুষ ও পুলিশ ঘিরে আছে লাশটি।
গৃহবধূ সাহারা বেগম। সড়ক সন্ত্রাসে জেরবার তার পরিবার। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু সড়ক সন্ত্রাস তার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। সাহারার স্বামী রফিকুল ইসলাম ছিলেন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা। সেদিন মতিঝিলের অফিস থেকে লোকাল বাসে যাচ্ছিলেন বাসায়। সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে বাসটি মাঝ সড়কে নামিয়ে দেয় তাকে। বাস থেকে নামার পরই আরেকটি বাস রং সাইড দিয়ে ক্রস করতে যায়। দুই বাসের মাঝে পড়েন রফিক। মারাত্মক আহত হন। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দুই বাসের চাপায় রফিকের বুকের হাড় ভেঙে যায়। এরই সঙ্গে রফিকের সংসারের পাঁজরও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। দুই সন্তানসহ সাহারার এখন সম্বল শুধুই কান্না। সাহারার কথাÑ ড্রাইভাররা ঘাতক। ওরা সন্ত্রাসী। স্টিয়ারিং ওদের অস্ত্র। রাজধানীতে স্পটে স্পটে দাঁড়ালে দেখা যায়, সড়কে চলন্ত বাসের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই কলেজছাত্র রাজীবের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শরীর থেকে। পাশাপাশি লেগে থাকা দুটি বাসের মধ্যে ঝুলে থাকে রাজীবের হাতটি। এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেন সবাই। বাসযাত্রীরা মনে করেন ড্রাইভাররা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসের কারণেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। একটি বাসে কম করে হলেও ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী থাকে। এসব যাত্রী মাত্র তিন জনের কাছে জিম্মি। হেলপার, কন্ডাক্টর ও ড্রাইভারের কর্মকাণ্ডে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। এ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক যাত্রী মন্তব্য করেন অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় অনেকটা রিস্ক নিয়ে বাসে উঠতে হয়। বাসের ড্রাইভারদের অমানবিক প্রতিযোগিতা কী করে বন্ধ হবে জানি না। কখনো কখনো দেখা যায় বাস কোনো স্টপেজে হালকা ভাবে থামায়। যাত্রী উঠতে না উঠতেই চালক গাড়ি টান দেয়। পেছনে পেছনে যাত্রীরাও দৌড়ে উঠতে যান। এ করতে গিয়ে কোনো কোনো যাত্রী নিচে পড়ে যান। আবার দেখা গেছে, যাত্রী নামার সময় চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়। এমন এক ঘটনায় ক’দিন আগেই ওই গাড়ির পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ওই ব্যক্তি মারা যান। প্রতিযোগিতা করে চালাতে গিয়ে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে যান। কিন্তু ড্রাইভাররা এতে যেন আনন্দই পান। উল্লাস করেন। প্রতিদিন সড়কে এমন কতো যে ঘটনা ঘটে তার ইয়ত্তা নেই। ক’টিইবা মিডিয়ায় আসে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়কে পরিবহন চলাচলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় যাত্রীদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। নগরীর রাস্তায় কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।
মূল কথা- সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। সিস্টেমটাই খুব বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। আমরা যা দেখি, আসলে উপসর্গটা দেখি। আমরা এমন কোনো পরিকল্পনা করিনি যেখানে বাস ড্রাইভাররা সুষ্ঠুভাবে গাড়ি চালাবে। আমরা যখন যে এসেছে, রুট পারমিট দিয়েছি। মালিকরাও ফিক্সড ইনকামে চলে গেছে। ফলে দিনের শেষে এখন চালকরাই ব্যবসাটা করছে পুরো রাস্তায়। পরিবহন মালিকরাও রাস্তার পরিস্থিতির জন্য ব্যবস্থাপনার অভাবের কথা তুলে ধরেন। ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হলে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব হ্রাস পাবে। গতকাল সকাল ৯টায় গুলিস্তান হলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় গাড়ি চারদিক থেকে আসছে। হলের সামনে যাত্রীরা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শিকড় পরিবহনের একটি গাড়ি যাত্রী তুলছিল। এ সময় অপর একটি শিকড় গাড়ি পেছন দিক থেকে ওই গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় একজন যাত্রী উঠতে গিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েন। কিন্তু এদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। পেছনের গাড়ির বক্তব্য, ওই গাড়ি আমার আগের সিরিয়ালের। ও কেন আমার গাড়ি আসার পরও দাঁড়িয়ে থাকবে? ধাক্কা না দিলে সে যাবে না। তাই ধাক্কা দিয়েছি। একটু এগিয়ে পল্টন মোড়ে দেখা যায়, মনজিল পরিবহনের দু’টি বাস ঘষাঘষি করে চলছে। এভাবে মিনিট খানেক চলার পর একটি গাড়ির গ্লাস ভেঙে সড়কে পড়ে যায়। আর দুটি বাসের ভেতর থেকেই যাত্রীরা চিৎকার করছিল। কিন্তু কে শুনে কার কথা। প্রায়ই দেখা যায়, এক গাড়ি অন্য গাড়িকে সাইড না দেয়ার দৃশ্য। এক পর্যায়ে পেছনের গাড়ি একটু সুযোগ পেলেই গাড়ি এগিয়ে দেয়। এ অবস্থায় লুকিং গ্লাস ভেঙে যায়। কখনো কখনো যাত্রীরা আঘাতপ্রাপ্ত হন। সড়কে ড্রাইভারদের সন্ত্রাসের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ সন্ত্রাসে হাজারো পরিবারকে জীবনভর কান্নার সাগরে ভাসতে হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে চালকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ট্রাফিক পুলিশও দায়সারা দায়িত্ব পালন করে।
আবার দেখা যায়, গাড়িতে মূল স্ট্যান্ড থেকে ওঠার সময় ধীরস্থির ভাবে উঠলেও পথে পথে গাড়ি চলন্ত অবস্থায় যাত্রীদের উঠতে হচ্ছে। আবার নামতে গেলে কখনো সড়কের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে নামতে বলে চালক আর হেলপার। এভাবে রিস্ক নিয়ে রাজধানীর যাত্রীদের চলাচল করতে হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর) এ জন্য সাত কারণকে চিহ্নিত করেছে। প্রথম কারণ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। এ ছাড়া অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর ওই সংগঠনের জরিপে ওঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে ৫৯৯৭টি, যাতে ৮৭৯৮ জন নিহত ও ১৮১১৩ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালে ২৯৯৮টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩৪১২ ও আহত হয়েছেন ৮৫৭২। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু চালকরা যে শপথ নিয়েছেন, পিষে মারার। তারা শপথ নিয়েছেন নিয়ম না মানার। কিন্তু পিষে মারা আর নিয়ম না মানার এ কালচার চলবে আর কতোদিন?
শেষ কথা হলো- সবার আগে চালকদের প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে। সড়কগুলোকে লেনে ভাগ করে নির্দিষ্ট গাড়িকে লেনের বাইরে চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পথচারীকে অবশ্যই রাস্তা পারাপারের সময় সতর্ক থাকতে হবে।