নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
জানেন কী, প্রতিদিন আপনার সন্তান কোথায় যায়? কার সঙ্গে মিশে? কারা তার বন্ধু?
রেজানুর রহমান
৯ নভেম্বর ২০২২, বুধবারজনজীবনে পরিবর্তনের প্রকাশ ঘটুক- এটাই যুগের দাবি। তাই বলে পারিবারিক বন্ধনগুলো আলগা হয়ে যাবে? মোবাইল ফোন অতি দরকারি জিনিস। তাই বলে প্রাইমারির বাচ্চার বইয়ের ব্যাগে মোবাইল ফোন থাকবে কেন? সে স্কুলে যাচ্ছে পড়াশুনা করার জন্য। মোবাইল নিয়ে সময় কাটানোর জন্য না। অথচ আমরা বাবা-মায়েরা অনেকে জোর করে বাচ্চার বইয়ের ব্যাগে মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে দিচ্ছি যাতে করে যখন-তখন বাচ্চার খোঁজ নিতে পারি। কিন্তু আমরা অনেকেই বোধকরি খবর রাখি না একটি মোবাইল ফোন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য কতোটা ক্ষতিকর? যদি থাকে ইন্টারনেটের সংযোগ তাহলে তো শিশুটির বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ অবারিত। ক্ষতিকর ভিডিও দেখে সে। ক্ষতিকর প্রবণতার দিকে হাত বাড়ায় সহজেই
যুগের দাবি বলে একটা কথা আছে। তাই বলে একই পরিবারের লোকজন বাসার এক ঘর থেকে অন্য ঘরে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে? এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। দরজা খুলে দিলো পরিবারের স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি।
সুযোগ আছে। সুযোগটা কাজে লাগাই। ছেলেটির মা’কে আমি ভাবী বলে সম্মোধন করি। কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম- ভাবী, বাসার মধ্যেও একে-অন্যের সঙ্গে ফোনে কথা বলা কি ঠিক? ভাবী অবাক হয়ে বললেন, এখানে ঠিক-বেঠিকের কি দেখলেন? সুযোগ আছে তাই কাজে লাগাচ্ছি। তার মানে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সামনা-সামনি খুব একটা কথা হয় না? আমার প্রশ্ন শুনে ভাবী বললেন, সামনা-সামনি কথা হয়। তবে বেশি কথা হয় ফোনে। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। একজন কলেজে পড়ে। অন্যজন স্কুল শেষ করতে যাচ্ছে। সবার জন্য আলাদা ঘর আছে। বাসায় থাকলেও সবাই যার যার ঘরেই থাকতে পছন্দ করে। আমি আরও অবাক। ভাবীকে প্রশ্ন করলাম- সকালের নাস্তাও কি যার যার ঘরে? হ্যাঁ। দুপুরের খাবার? তখন তো সবাই বাসায় থাকে না। যে যার কাজে বেরিয়ে যায়? তাহলে রাতের খাবার নিশ্চয়ই সবাই এক সাথে... ভাবী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না সেটাও হয় না। কাজ শেষে সবাই বাসায় ফিরে নিজেদের ঘরে ঢুকে যায়। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা হয়। যার যখন সময় হয় খেয়ে নেয়। ভাই, বর্তমান সময়টা কিন্তু এ রকমই। ভাবী সময়ের দোহাই দিলেন। তার সঙ্গে বাড়তি কোনো কথা বলার ইচ্ছা হলো না। নিজের বাসায় ফিরে বার বার পরিবারটির কথা ভেবেছি। সত্যি কী সময় বদলে দিয়েছে পরিবারটিকে? এই যে একই ছাদের নিচে থাকার পরও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এর ভবিষ্যৎ কী? এবার অন্য একটি পরিবারের কথা বলি।
বেড়াতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর বাসায়। দরজা খুলে দিলেন পরিবারটির কর্ত্রী। তাকেও আমি ভাবী বলে ডাকি। ড্রয়িং রুমে বসতে বসতে বললাম- ভাবী, ছেলে-মেয়েরা কি বাসায়? হ্যাঁ। ঘুমাচ্ছে। বেলা ১২টা। তখনও ছেলে-মেয়েরা ঘুমাচ্ছে। একটু অবাক হলাম। বললাম- ভাবী এত বেলা করেও ওরা ঘুমায়? বেলা ১২টা বাজে। ভাবী গর্বের সঙ্গে বললেন, রাত জেগে পড়াশুনা করে তো। সময় কাটায় ফেসবুকে। কত করে বলি বেশি রাতে ফেসবুকে থাকিস না। কে শোনে কার কথা। সারা রাত জাগে। দিনে ঘুমায়? ওরাতো শিক্ষার্থী? ওদের স্কুল, কলেজ? মাঝে মাঝে যায়। এখন তো অনলাইনের যুগ। অনলাইনেই লেখাপড়া চলে। কথা বলতে বলতেই ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ডাক দিলেন। প্রথমে কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি এলো। বেশ বিরক্ত। ছোট বেলা থেকে এই ছেলেকে আমি দেখে আসছি। এদের বাসায় এলেই দুই ভাই বোন হইচই বাধিয়ে দিতো। অথচ আজ যেন একটু বিরক্ত। ঘুমে ঢুলু অবস্থায় হাত তুলে সালাম দিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে গেল। এক সময় মেয়েটি এলো। সালাম দিয়ে সামনে সোফায় বসলো। কথা শুরু করতে যাবো। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আঙ্কেল আপনি বসেন। আমি একটু আসতেছি... মেয়েটিও তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
মেয়ের মা বললো, সারা রাত ঘুমায়নি তো তাই.... কৌতূহল মেটানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম- ভাবী ছেলে- মেয়েরা পড়াশোনা ঠিকমতো করছে তো? ভাবী একটু বিব্রত হয়ে বললেন, মেয়েটা ঠিক আছে। ছেলেটাকে নিয়ে পড়েছি ঝামেলায়। একদম পড়তে চায় না। ফেসবুকে কিসব গ্রুপ খুলেছে। গ্রুপের কাজ নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। প্রিয় পাঠক, তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর এক যুগে অবস্থান করছি আমরা। কেউ কী কোনোদিন ভেবেছিল নিজের ছবি নিজে তুলতে পারবে? আরও বিস্ময়কর হলো- পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অন্য প্রান্তে ভিডিও কলে পরস্পরের চলমান ছবি দেখে কথা বলা যাবে এটাও কি সাধারণ মানুষ কোনোদিন কল্পনা করেছিল? চিঠি হারিয়ে যাবে। আসবে ফেসবুক, ই-মেইল, টুইটার সহ যোগাযোগের অনেক মাধ্যম এ কথাও কি সাধারণ মানুষ ভেবেছিল? বিস্ময়কর খবর হলো- একদল গবেষক বিকল্প রক্ত তৈরি করেছে। মানব শরীরে এই রক্ত পুশ করা হয়েছে। গবেষকরা দাবি করছেন বিকল্প রক্ত নাকি মানবদেহের রক্তের চেয়েও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। যা ছিল কল্পনারও বাইরে সেটাই এখন বাস্তব। জনজীবনে পরিবর্তনের প্রকাশ ঘটুক- এটাই যুগের দাবি। তাই বলে পারিবারিক বন্ধনগুলো আলগা হয়ে যাবে? মোবাইল ফোন অতি দরকারি জিনিস। তাই বলে প্রাইমারির বাচ্চার বইয়ের ব্যাগে মোবাইল ফোন থাকবে কেন?
সে স্কুলে যাচ্ছে পড়াশুনা করার জন্য। মোবাইল নিয়ে সময় কাটানোর জন্য না। অথচ আমরা বাবা-মায়েরা অনেকে জোর করে বাচ্চার বইয়ের ব্যাগে মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে দিচ্ছি যাতে করে যখন-তখন বাচ্চার খোঁজ নিতে পারি। কিন্তু আমরা অনেকেই বোধকরি খবর রাখি না একটি মোবাইল ফোন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা ক্ষতিকর? যদি থাকে ইন্টারনেটের সংযোগ তাহলে তো শিশুটির বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ অবারিত। ক্ষতিকর ভিডিও দেখে সে। ক্ষতিকর প্রবণতার দিকে হাত বাড়ায় সহজেই। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের দেশে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এই প্রজন্মের সামনে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নাই। খায় দায়, ঘুমায় আর মোবাইলে সারা দুনিয়া চষে বেড়ায়। কয়েকদিন আগে একটি কাজে সৈয়দপুর গিয়েছিলাম। শহরের মাঝখানে একটি মার্কেটে একদল তরুণের জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম। সবাই তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। সবাই আড্ডা দিচ্ছে। সবার আগ্রহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি। দেশ নিয়ে তাদের ভাবনাটা কেমন তা জানার জন্য মাত্র ৩টি প্রশ্ন করা হল। ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ, ২১শে ফেব্রুয়ারি কি জন্য বিখ্যাত? ১১ জনের মধ্যে ৭জন ৩টি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারলো না। ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস একথা সবাই বললো। কিন্তু ঝামেলাটা বাধলো বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবস নিয়ে। ১১ জনের ৭জনই ১৬ই ডিসেম্বরকে বলেছে স্বাধীনতা দিবস আর ২৬শে মার্চকে বলেছে বিজয় দিবস।
১১ জনের ৮ জন কলেজে পা দিয়েছে। ৩ জন দশম শ্রেণির ছাত্র। অথচ তারা কোনটা বিজয় দিবস, কোনটা স্বাধীনতা দিবস- সেটাই জানে না। তরুণদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে অনেকের ব্যাপক আগ্রহ। সেজন্য পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব নেই। মিছিল, সমাবেশ আর মাস্তানিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে অনেকে। খেয়াল করলেই দেখবেন আমাদের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে তেমন একটা আগ্রহী নয়। দেশের সিনেমা অনেকের ভালো লাগে না। দেশের গানকে তারা ব্যাকটেডেট ভাবে। দেশের টিভি নাটক নিয়েও তাদের অনেক অভিযোগ। কিছুদিন আগে সিনেমা প্রসঙ্গে প্রায় ২৫ জন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো গবেষণা অথবা তথ্য বের করার ক্ষেত্রে ২৫ জনের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও আলোচনার সুবিধার্থে ২৫ জনের চলচ্চিত্র ভাবনাটা তুলে ধরি। ২৫ জনের মাত্র ২ জন দেশের সিনেমার প্রতি আগ্রহী। বাকি ২৩ জন দেশের সিনেমার ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। তাদের অভিযোগ, এই দেশে প্রকৃত অর্থে সিনেমা নির্মিত হয় না। তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম- কেন একথা বলছেন? গত তিন মাসে কি বাংলাদেশের কোনো সিনেমা দেখেছেন? ২৩ জনেরই অভিন্ন উত্তর- দেখিনি।
তাহলে কি করে বলছেন বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে না? আমার প্রশ্ন শুনে তোতা পাখিকে শেখানো বুলি আওড়ালো সবাই- মানুষ বলে। তাই আমরাও বলি... এটাই হলো বাংলাদেশের বাস্তবতা। অন্যে যা বলে আমরা তাই বিশ্বাস করি। যা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। লেখাটি শেষ করি। শুরুতে দুটি পরিবারের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। শেষটাও করি পরিবারকে দিয়ে। তথ্য-প্রযুক্তি আমাদের পারিবারিক ভাবনার জায়গাটাকেও বদলে দিয়েছে। তাই বলে আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাবো? তথ্য- প্রযুক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে নাকি মানুষই তথ্য-প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এই ভাবনাটা গুরুত্বের দাবি রাখে। সারারাত জেগে ফেসবুকে সময় কাটানো কোনো অহঙ্কারের বিষয় হতে পারে না। বরং সন্তানদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে রাতের ফেসবুক আড্ডা থেকে মুক্ত রাখা। শেষে দেশের সকল অভিভাবকের প্রতি একটা ছোট্ট প্রশ্ন- আপনার সন্তান প্রতিদিন কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে? তার বন্ধু কারা আপনি জানেন কী? প্রিয় পাঠক, শুভ কামনা সবার জন্য। বিশেষ অনুরোধ, খোঁজ নিন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।