ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

বাল্যবিবাহ: জমেছে যে শিশিরের জল

শুভ কিবরিয়া
৪ অক্টোবর ২০২২, মঙ্গলবার
mzamin

২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৭৬ শতাংশ আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। ওই ছাত্রীরা গত বছর বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এসব তথ্য ও অভিজ্ঞতা বলছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ খুব সহজ কাজ নয়। শুধু আইন তৈরি করে এ কাজে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। আবার জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছা ও ন্যায়ানুগ বিবেচনা ছাড়াও এ কাজে ভালো ফল লাভ করা যাবে না। সমাজ-পরিবার-বিদ্যায়তনের সহযোগ ছাড়াও শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের কাজে লাগিয়েও বাল্যবিবাহ কমানো যাবে না

আমাদের এক বন্ধু মাঠ প্রান্তে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত। জেলার উচ্চপদস্থ দায়িত্বে। বন্ধুটি বিস্তর পড়াশোনা করে। দিনশেষে সকল ঝামেলা মিটিয়ে বইয়ের সঙ্গেই তার দেখাশোনা-আমরা তাকে বলি বইভুক মানুষ।

বিজ্ঞাপন
মাঝে মাঝে তার কাছে আমরা যাই-দেশের হাল হকিকত জানতে। সংবাদ মাধ্যমে যা জানা যায়, তার বাইরেও অনেক ঘটনা, অনেক ভেতরের খবর তার কাছে জানা যায়। সেটা দেশ-কাল-পাত্র ভেদে অনেক নতুন খবর তো বটেই অনেক নতুন চিন্তারও জন্ম দেয়। আমি সবসময় তাকে বলি তার এই আমলা জীবনের আমলনামা লিখে রাখতে। সে মৃদুহাস্যে এই প্রস্তাব এড়িয়ে যায়। আপাতত তার পেশাগত জীবনে অনেক পথ পেরুতে হবে বলেই হয়তো ‘আমলানামা’ লেখার ব্যাপারে তার সুউচ্চ-স্পষ্ট জবাব পাইনে। তবে আমার ধারণা সে প্রতিদিনের তার অভিজ্ঞতার অনেক খুঁটিনাটির নোট রাখে। 

পত্রিকায় একটা সংবাদ দেখে তাকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম তার মতামত। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে দেশে প্রতিমাসে ২৮৮ জন কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার। সরকারের এত আয়োজন অথচ বাল্যবিবাহ থামছে না কেন? এত এনজিও কাজ করছে, সরকারের বহু বিভাগ বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করছে, অথচ বাল্যবিবাহের এই হাল কেন? জানতে চাইলাম বন্ধুটির কাছে। বন্ধুটি আমার উল্লেখিত সংবাদের বিস্তারিত শুনতে চাইলো। আমি পত্রিকার সংবাদটি হুবহু পড়ে শোনালাম। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘‘এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় ২ হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিমাসে ২৮৮ কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহ হয়েছে। এ সময় ৫৮৯টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।
৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এসব তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটি জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২’ উপস্থাপন করেছে। এ ফোরাম ২০২২ সালের প্রথম ৮ মাসে দেশের ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম থেকে কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত তথ্য তারা মাঠ পর্যায় থেকে নিয়েছে।’’

সংবাদটি শোনার পর বন্ধুটি বহু পুরনো একটি তথ্যের খবর দিলো শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা থেকে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১), ১৮৯০ সালের দিকের সময়কালের সামাজিক অবস্থার বয়ান দিয়ে লিখেছেন, ‘ত্রিপুরা জেলায়, বিশেষ করিয়া নবীনগরে, খাদ্যদ্রব্যের দাম অত্যন্ত সস্তা ছিল। দুধের সের তৎকালে ২/৩ পয়সা, ৪ পয়সার মাছ কিনিলে দশজনের একটি পরিবারের পক্ষে তাহা প্রচুর ছিল। বহু পরিবার অনশনে অর্ধাশনে দিন কাটাতো। শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। ইংরেজ রাজত্বের মূল কথা ছিল আইন ও শৃঙ্খলা। হিন্দু সমাজ জীবনে বহু কুপ্রথা বিদ্যমান ছিল। ঘাটুর (উধহপরহম ইড়ু) প্রচলন ছিল। অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান উভয়েই কুপ্রথার সমর্থক ছিল। বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। তবু সমাজ সত্যের মর্যাদা দিতো। সে মর্যাদা আজ সম্পূর্ণ তিরোহিত হইয়াছে।’

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মজীবনীর বয়ানটুকু দিয়ে বন্ধুটির বক্তব্য হলো বাল্যবিবাহের বিষয়ে ইতিহাসের সায় আছে। বহু পুরনো কাল থেকে আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহ প্রচলিত আছে। বাল্যবিবাহের স্বপক্ষে একটা হীন যুক্তি সমাজের ভেতরে সংস্থাপিত আছে। এটা সমাজের একটা কাল রোগ। অতীতে সমাজে যখন শিক্ষার অভাব ছিল তখনো এই রোগ বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার হার এখন বহুগুণে বেড়েছে, স্বাধীন দেশে আমরা বসবাস করছি কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরীণ প্রবণতা খুব একটা বদলায়নি।  খুব সহজে এ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। বন্ধুর এই মন্তব্যে সহমত হতে পারলাম না। আমার যুক্তি পাড়তেই বন্ধুটি তার দুটো সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার কথা বললো।

এক. ঊন্ধুটির ভাষ্য হলো, তার মোবাইলে সে মাঝরাতে মেসেজ পেলো এক তরুণীর। স্কুল পড়ুয়া সেই তরুণীর বয়স ১৮ বছরের নিচে। তরুণীটি লিখেছে, তার বাবা তার বিয়ের আয়োজন করেছে আগামীকাল। এই বিয়ে সে করতে রাজী নয়। কেননা সে পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে চায়। এই বিয়ে হলে সে আত্মহত্যা করবে। আত্মহত্যার কথা শুনে বন্ধুটি ঘাবড়ে গেল। কেন না, এই মেয়ের বাড়ি যেখানে সেটা জেলা সদর থেকে বহুদূরের উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। ওই রাতেই বন্ধুটি তার মাঠপ্রান্তের কর্মকর্তাকে জানালো ঘটনাটি। স্থানীয়ভাবে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেল। কিন্তু পরিবারের সবাই অস্বীকার করলো। কিন্তু ওই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, খাবার দাবারের আয়োজন বলে সেখানে একটা কিছু ঘটছে। সারাদিন কর্মকর্তারা ওই বাড়িতে বসে থাকলো। পরিবারের অবিভাবকের মুচলেকা নিলো। তরুণী যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের হেডমাস্টার সাক্ষী রইলেন। 

তবুও পরের দিন গভীর রাতে সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির বাড়িতে গোপনে তার আশ্রয়েই। জনপ্রতিনিধি সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা- মেয়ের বাবা তার বিশ^স্ত কর্মী। এই জনপ্রতিনিধি দিনের বেলায় বাল্যবিবাহের ঘোর বিরোধী কিন্তু গভীর রাতে নিজের কর্মীর মনস্কামনা পূর্ণ করলেন আইন ভেঙেই। মেয়েটির ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়েটা হয়ে গেল। হয়তো যেখানে মেয়েটির বিয়ে হলো, সেটা তার পছন্দের নয়। হয়তো তার নিজের কোনো পছন্দ ছিল। হয়তো তার পছন্দের সঙ্গে বাবা-মার পছন্দ মেলে না। হয়তো মেয়েটি সত্যি সত্যিই পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করতে চায় নাই। এ রকম অনেক হয়তো, যদি.. কারণ থাকতে পারে। কিন্তু শেষাবধি আমরা কি দেখলাম, মেয়েটিকে তার অনিচ্ছের এক জীবনে ঢুকতে সবাই বাধ্য করলো। অভিভাবক, সমাজ, পরিবার, জনপ্রতিনিধির ইচ্ছের কাছে গুটিকতক সরকারি চাকুরে অসহায় হয়ে রইলো!
 

দুই. এবার বন্ধুটি তার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতার কথা বললো। সবেমাত্র উপজেলায় দায়িত্ব পেয়েছে তার অধীনস্ত এক নবীন কর্মকর্তা। বেশ সাহসী, নৈতিকভাবেও শক্তিমান এই কর্মকর্তা এক বাল্যবিবাহের খবর পেয়ে, সেখানে যেয়ে বিয়েটা ভেঙে দেয়। মোবাইল কোর্ট করে মেয়ের বাবাকে জরিমানাও করে বেশ কয়েক হাজার টাকা। মেয়েটির বয়স খুবই কম। মেয়েটির বাবা একজন দিনমজুর। হয়তো মেয়েটিকে পাত্রস্থ করে ঘাড়ের ভার নামাতে চেয়েছে। হয়তো নানা কারণে মেয়েটির পড়াশোনা চালিয়ে নেবার ক্ষমতা তার ছিল না। হয়তো আরও কোনো অসুবিধা ছিল তার। নবীন কর্মকর্তা যখন জরিমানার টাকা আদায় করছে, সে সময় সে ফোন পেলো স্থানীয় সংসদ সদস্যের। স্থানীয় সংসদ সদস্য তখন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। মন্ত্রী ফোনে ঘটনাটি জানতে চেয়ে জরিমানার টাকা কমাতে বললেন। নবীন কর্মকর্তা জানালেন জরিমানার টাকা কাগজে লেখা হয়ে গেছে, কমানোর আর সুযোগ নাই। মন্ত্রী মহোদয়, নবীন কর্মকর্তার এই জবাবে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন, ফোনটি কেটে দিলেন। পরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এই জরিমানার টাকা জোগাড় করে দেন মন্ত্রীর নির্দেশে। অনেক পরে মন্ত্রী মহোদয় ওই নবীন কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন যে, তার সেদিনের ধার্যকৃত জরিমানার টাকা, মন্ত্রীর নিজের পকেট থেকেই দিতে হয়েছে!

পুনশ্চ: ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২২ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বাল্যবিবাহ’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৭৬ শতাংশ আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। ওই ছাত্রীরা গত বছর বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
এসব তথ্য ও অভিজ্ঞতা বলছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ খুব সহজ কাজ নয়। শুধু আইন তৈরি করে এ কাজে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। আবার জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছা ও ন্যায়ানুগ বিবেচনা ছাড়াও এ কাজে ভালো ফল লাভ করা যাবে না। সমাজ-পরিবার-বিদ্যায়তনের সহযোগ ছাড়াও শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের কাজে লাগিয়েও বাল্যবিবাহ কমানো যাবে না। একটা সামষ্টিক, সমন্বিত, সমাজ ঘনিষ্ঠ উদ্যোগ আর সুশিক্ষার প্রসার ছাড়াও বাল্যবিবাহ নিরোধ সম্ভবপর নয়। তাই সমাজকে জাগতে হবে। মানুষকেও জাগাতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status