ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

দেশটা কেন এমন হয়ে যাচ্ছে?

দিদারুল ভূঁইয়া
১৫ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার
mzamin

আমাদের সকল নাগরিকের জান জবান সম্মানের অধিকার লাগবে। এটা হলো সাফ কথা। এজন্য যেটা লাগবে এদেশে মানুষের পক্ষের, নাগরিকদের কাছে জবাবদিহিতার একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সরকার, সামাজিক শক্তি। এর শুরুটা ভোটাধিকারের মাধ্যমে। আপনি ভোট দিতে না পারলে আপনার অন্য কোনো হক, কোনো অধিকার থাকে না। শুরুটা ভোটাধিকারে হলেও এখানেই শেষ না। যাদের আপনি প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, তারা যদি ভোটের পর আর আপনার অনুগত না থাকেন, আপনার পক্ষে না থাকেন, তাহলে যেন আপনি তাদের শান্তিপূর্ণভাবে সরিয়ে দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও লাগবে। নয়তো ভোটের অধিকারও হারিয়ে যায়। এটাই হয়েছে এদেশে। এক সময় আমরা অন্তত ভোট দিতে পারতাম।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু যেহেতু এখানে বিপ্লব বা ষড়যন্ত্র ছাড়া ক্ষমতা বদলের শান্তিপূর্ণ কোনো ব্যবস্থা নাই, তাই ভোটাধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলেছি

২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আমার প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ নিয়ে বহুবার খুব বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছি। বেশির ভাগ বিদেশি তখন বাংলাদেশকে চিনতো না। আমার খুব খারাপ লাগতো। তবে কেউ যদি চিনতো, তাহলে ভালো না লেগে বরং আতঙ্ক লাগতো। কারণ তারা বাংলাদেশকে চিনতো মূলত দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যার দেশ হিসেবে। মনে হতো তারা যেন আমার দিকে, বাংলাদেশের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস সাহেবের নোবেল বিজয়ের পর এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। মনে আছে সে বছর নরওয়েতে একটা প্রশিক্ষণে ছিলাম। হলভর্তি প্রায় ২০ দেশের দেড়শ’ কলিগের সামনে যখন আমাদের টিমের পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছিল, প্রথমে সেই পুরাতন আতঙ্ক ভর করছিল। এ দেশের নাম কেউ জানে না। জানলেও করুণার পাত্র হিসেবে জানে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। ভীষণ ব্যতিক্রম। 

বাংলাদেশ টিমের পরিচয় করানোর সময় বলা হলো এরা ইউনূসের দেশের লোক। আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো হল যেন শ্রদ্ধায় নত হয়ে অবাক বিস্ময়ে আমাদের দেখতে লাগলো। যেন আমরা বাংলাদেশি তিনজনও জুনিয়র ইউনূস। 

বলাবাহুল্য ইউনূস সাহেবকে নিয়ে এমন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সে সময় আমাদের অনেকের হয়েছে।
আমার মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়, এমন একটা সম্পদের কোনো ব্যবহার আমরা করতে পারছি না। আমার সুযোগ থাকলে ড. ইউনূস সাহেবকে ব্যবহার করে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের জন্য আরও আরও সম্মান, শ্রদ্ধা, সুযোগ অর্জনের সকল ব্যবস্থা করতাম। 

পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের দেশ বাংলাদেশ। এখানে ক্ষমতাবানদের প্রধান একটা লক্ষ্য থাকে দেশের সম্পদ নিজেদের ভোগে নিশ্চিত করতে বিদেশে পাচার করা। তার বিপরীতে মূলত প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টস কর্মীদের রক্ত ঘামের বিনিময়ে অর্জিত রেমিট্যান্স আর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কারণে মাঝের কিছু সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশংসা অনেক দেশেই ছড়িয়েছে। কিন্তু সেই অবস্থা এখন নেই। ডামি আন্দোলন, ডামি নির্বাচন, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লুটপাট, পাচার, এখানে সেখানে যখন তখন অগ্নিকাণ্ড, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, ভুল চিকিৎসা বা সামান্য খতনা করাতে গিয়ে জীবনহানি, সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি, খুন-ধর্ষণ এমন হাজারো ঘটনার আজ বাংলাদেশ আক্রান্ত। 

গত কয়েক সপ্তাহে সারা দেশে বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের বহর বয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনাগুলোর একটি। এর পরপর এস আলম গ্রুপের চিনির ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে। এ দুইটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। 
বেইলি রোডের ঘটনাস্থলের খুব কাছে একটি পুকুর আছে। ঢাকা শহরে যা একটি বিরল ব্যাপার বটে। তবে তারপরও আগুন নেভাতে দমকল বাহিনী খুব একটা সফল ছিল বলা যাবে না। 

অগ্নিকাণ্ডের পরের দিন থেকেই আমরা আমাদের করিৎকর্মা প্রশাসনের চতুর্মুখী সাঁড়াশি অভিযান দেখতে পেলাম। জনগণকে শায়েস্তা করতে তারা একেবারে উঠেপড়ে লাগলেন। হাজারের বেশি গ্রেপ্তার, শ’খানেক মামলা, অনেক রেস্টুরেন্ট সিলগালা, লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় তারা অল্প কয়েকদিনেই করে ফেলেছেন। কিন্তু যারা এসব অনিয়মের অনুমতি দেয়, যে কারণে অনুমতি দেয়- এসব নিয়ে স্পিকটি নট। তাদের কারও নামে কোনো মামলা, গ্রেপ্তারের খবর এখনো পাই নাই, আশাও করি না।

আরেকটা অদ্ভুত বিষয় হলো এস আলমের সেই ফ্যাক্টরির ধারণক্ষমতা ছিল ৬৫০০০ টনের মতো। কিন্তু চিনি পুড়েছে এক লাখ টনের বেশি। এটা কেমন করে সম্ভব?
বাংলাদেশে দুর্ঘটনা নামের যেসব দুর্যোগে আমরা নিয়মিত মরি, ঠকি, অপমানিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত হই- এর প্রায় সবই আসলে দুর্ঘটনা না। এসব পরিকল্পিত অথবা কাঠামোগত গজব। দুর্ঘটনা না। দুর্ঘটনা বলা যায় সেটাকে, যেটা না ঘটার জন্য সর্বোচ্চ এবং সঠিক প্রচেষ্টা থাকে। এরপরও ঘটে গেলে সেটার একটা বিহিত করা হয়। নতুন করে আরও বেশি সতর্কতা নেয়া হয়। 

এদেশে সড়ক ব্যবস্থা শতভাগ সড়ক দুর্ঘটনাবান্ধব, নৌপরিবহন ব্যবস্থার মূল কাজ আসলে নৌযান ডুবি, চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো জনগণকে আগে ফতুর করা; তারপর মেরে ফেলা, শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো বেকার উৎপাদন করে বিদেশে অদক্ষ কামলার চাহিদা পূরণ, নির্বাচন ব্যবস্থার কাজ হলো জনগণের ভোটাধিকার হরণ, বিচার ব্যবস্থা বানানো হয়েছে ক্ষমতাবানদের লালন আর জনগণকে দমনের জন্য, দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি দেয়া, অডিটর জেনারেল পদের কাজ হলো সরকারের চুরি জায়েজ করা... প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থাই এখানে মানুষের উপর গজব নাজিলের জন্য। এভাবেই এ ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বানানো হয়েছে, পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলাফলও তাই হাতেনাতে। এর বাইরে কিছু হলে সেটাই বরং দুর্ঘটনা।

কথা হলো সমাধান কী? 
আমাদের সকল নাগরিকের জান জবান সম্মানের অধিকার লাগবে। এটা হলো সাফ কথা। এজন্য যেটা লাগবে এদেশে মানুষের পক্ষের, নাগরিকদের কাছে জবাবদিহিতার একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সরকার, সামাজিক শক্তি। এর শুরুটা ভোটাধিকারের মাধ্যমে। আপনি ভোট দিতে না পারলে আপনার অন্য কোনো হক, কোনো অধিকার থাকে না। শুরুটা ভোটাধিকারে হলেও এখানেই শেষ না। যাদের আপনি প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, তারা যদি ভোটের পর আর আপনার অনুগত না থাকেন, আপনার পক্ষে না থাকেন, তাহলে যেন আপনি তাদের শান্তিপূর্ণভাবে সরিয়ে দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও লাগবে। নয়তো ভোটের অধিকারও হারিয়ে যায়। এটাই হয়েছে এদেশে। এক সময় আমরা অন্তত ভোট দিতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু এখানে বিপ্লব বা ষড়যন্ত্র ছাড়া ক্ষমতা বদলের শান্তিপূর্ণ কোনো ব্যবস্থা নাই, তাই ভোটাধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। 

কাজেই ভোটাধিকার কেবল শুরুর কথা, শেষের কথা আরও অনেক কিছু। সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আরও অনেক কিছুর সংস্কার আমাদের লাগবে। আর সাংবিধানিক সংস্কারগুলো এমন একটা ব্যবস্থায় করতে হবে যাতে কেউ আবার কলমের খোঁচায় ধুম করে সেটা বাতিল করে দিতে না পারে। আমরা সকল নাগরিকরা মিলে সোচ্চার হলে, ভোটাধিকারের লড়াইয়ে শামিল হলে, অগ্নিকাণ্ডসহ পরিকল্পিত এবং কাঠামোগত সকল গজবের অবসান এদেশে একদিন নিশ্চয় হবে।
লেখক: অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

পাঠকের মতামত

আপনাদের সকলের মতামতের জন্য ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।

দিদারুল ভূঁইয়া
২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ২:৫৬ অপরাহ্ন

এই রকম একটি বাস্তবতার উপর কলাম লিখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং এভাবে আরো লিখতে যাহাতে বাংলাদেশের মানুষ বোঝাতে পারে যে একদিন প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য সক্রিয় হয়ে হয়ে উঠতে পারে।

Khan
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ৬:১৬ পূর্বাহ্ন

জবাবদিহি না থাকার কারণে আজ দেশে সব সেক্টরে দূর্নীতি ঘুষ চরম আকার ধারণ করেছে কিছু বলতে ও পারবেন না বলার কোন জায়গা ও নাই।ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা থাকলে জবাব দিহি থাকত ।এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে সামনে আরো কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।

রুবেল
১৫ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৩:৫৫ অপরাহ্ন

সবই সত্য কথা কিন্ত বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে।

মনির
১৫ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১২:১২ অপরাহ্ন

'লোভের সাগর পুকুরেে যায়' আমরা পুরো জাতি এখন লোভের জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছি এর মাশুল অবশ্যই দিতে হবে।

মিলন আজাদ
১৫ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন

100% correct statement . When our people will wake up?

Quamrul
১৫ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status