ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

প্রেম এমনও হয়!

সে যুগের লাইলী-মজনু এ যুগের খাইরুন-মামুন

শামীমুল হক
১৮ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

ইতিহাসে ঠাঁই নেয়া প্রেম কাহিনী পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়েছে। কিন্তু এ প্রেম এখনো মানুষকে উতলা করে। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ভিন্ন দেশের, ভিন্ন মহাদেশের প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন হচ্ছে। প্রেমের কারণে কেউ কেউ জীবনকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেয়। বিষপানে আত্মহত্যা করে। আবার কেউ গলায় দড়ি দেয়। প্রেমের এমন করুণ কাহিনী কান পাতলেই শোনা যায়। এই তো ক’দিন আগে নাটোরের গুরুদাসপুরের কলেজ শিক্ষিকা খাইরুন নাহার তার ছাত্র মামুনকে ভালোবেসে ঘর ছাড়েন। যে ঘরে ছিল তার সন্তান, স্বামী। ৪০ বছরের খাইরুন বিয়ে করেন ২২ বছরের মামুনকে।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই প্রেমিকা সেই কলেজ শিক্ষিকা নিজের জীবন দিয়ে যান। প্রেমিক গ্রেপ্তার হয়। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এখন সে কাহিনীর শেষ কোথায় কেউ খবরও রাখে না। আসলে যুগে যুগে প্রেম ছিল, প্রেম আছে, প্রেম থাকবে। কোনো প্রেম ইতিহাস হবে। কোনো প্রেমের নীরবে মৃত্যু ঘটবে। আর বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো যদি কোনো প্রেম সেলুলয়েডে বন্দি হয় কিংবা সাহিত্যে ঠাঁই নেয় তাহলে এ প্রেম অমর হয়েই রবে

চণ্ডীদাস আর রজকিনীর প্রেম কাহিনী আজও শিহরিত করে মানুষকে। ব্রাহ্মণের ছেলে চণ্ডীদাস প্রেমে পড়ে যান ধোপাকন্যা রজকিনীর। যিনি কিনা বিশালাক্ষ্মীর মন্দিরে পরিচারিকার কাজ করতেন। রজকিনীকে মন্দিরের কাপড় কাচতে প্রতিদিন যেতেন পুকুর ঘাটে। এই রজকিনীকে ভালো লেগে যায় চণ্ডীদাসের। রজকিনীকে একনজর দেখতে পুকুরের অপর ঘাটে বড়শি নিয়ে বসে থাকতেন চণ্ডীদাস। একদিন-দু’দিন নয়, এক মাস-দুই মাস নয়, একবছর-দুইবছর নয়। দীর্ঘ বার বছর এভাবে চণ্ডীদাস পুকুর ঘাটে বড়শি নিয়ে বসে থাকতেন। বার বছর পর রজকিনী একদিন চণ্ডীদাসকে জিজ্ঞেস করেন এতদিন ধরে কি মাছ ধরছো? চণ্ডীদাস উত্তর দেন এইমাত্র ঠোঁকর দিয়েছে। এভাবে তাদের মধ্যে প্রেম হয়। কিন্তু এ প্রেম মেনে নেয় না চণ্ডীদাসের পরিবার। একসময় দু’জনে পালিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে গিয়েও বিপত্তিতে পড়েন। কথিত আছে সেখান থেকেও তারা চলে যান বৃন্দাবনে। এরপর তাদের আর দেখা যায়নি। 

যুগে যুগে এমন প্রেমকাহিনী আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করেছে। সিনেমায় তাদের প্রেমকাহিনী অনেককে কাঁদিয়েছে। যেসব প্রেমকাহিনী আলোড়িত করেছে মানুষের মাঝে তার মধ্যে আরও রয়েছে লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনী। এই লাইলী মজনুর প্রেমকাহিনী আরও করুণ। আরবে বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক শাসক ছিলেন, যার নাম ছিল সাইয়্যিদ। তিনি আরবের অন্যতম ধনী ছিলেন। মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তাই তিনি সব সময় মানুষকে সাহায্য করতেন। কিন্তু তার কোনো সন্তান ছিল না। এ কারণে তার পরিবারে ছিল হতাশা।  তিনি ও তার স্ত্রী সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা সন্তান চেয়ে প্রার্থনা করতেন। একটা সময় তাদের মনের বাসনা পূরণ হয়। তাদের একটি ছেলে সন্তান হয়। এ সংবাদে আরবজুড়ে বয়ে যায় আনন্দ। বাদশাহ্‌ তার সন্তানের নাম রাখেন কায়েস। আর এই কায়েসই পরবর্তীতে মজনু হয়ে ওঠে। কায়েস বড় হতে থাকে। তিনি দেখতে যতটা সুন্দর, তেমনি ছিলেন মেধাবীও। একসময় কায়েসকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। ওই মাদ্রাসায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পড়তো। আর এই মাদ্রাসায় যারা পড়াশোনা করতো তারা সবাই ছিল বিত্তবান ও অভিজাত বংশের সন্তান। 

কিছুদিন পরে সেই মাদ্রাসায় একটি মেয়ে ভর্তি হয়। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত সুন্দরী ও বিনয়ী। মেয়েটিকে দেখেই কায়েসের খুব ভালো লেগে যায়। তার কাছে মনে হলো যেন এমন সুন্দরী মেয়ে তিনি আর জীবনে কখনো দেখেননি। এই মেয়েটির নামই ছিল লাইলী। কথিত আছে- কায়েস যখন তাকে প্রথম দেখেছিলেন তখন থেকেই তার প্রেমে পড়েছিলেন। কায়েস লাইলীর প্রেমে এতটাই পড়ে যান যে, তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে কায়েস শুধু লাইলীকে নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন। আর লাইলীকে নিয়ে লেখা সেই কবিতাগুলো কায়েস যেখানে সেখানে বসে মানুষদের শোনাতেন। এককথায় বলা চলে লাইলীর জন্য পাগল হয়ে যান কায়েস। এ কারণে লোকেরা তাকে কায়েস বলা বন্ধ করে মজনুন অর্থাৎ দিওয়ানা বলে ডাকতে শুরু করে। মজনুন-এর বাংলা উচ্চারণ মজনু। সেই থেকেই কায়েসের নাম হয়ে যায় মজনু। ধীরে ধীরে মজনুর আচরণ এমন হয়ে যায় যে, তাকে দেখলে একজন পাগলের মতোই মনে হয়। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর মজনু সরাসরি লাইলীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লাইলীর বাবা তৎক্ষণাৎ বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ লাইলীর বাবা তার মেয়েকে কোনো পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান না। 

অন্যদিকে লাইলীও মজনুকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু এই ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার কারণে তিনি মজনুকে এ কথা বলতে পারেননি। পরে একদল বেদুইন মজনুর নিঃশর্ত ভালোবাসা দেখে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ বেদুইন যুদ্ধ করে লাইলীকে মজনুর কাছে এনে দেবে বলে উৎসাহ দেয়। তাদের সহায়তায়, লাইলীর বংশ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তারপরও লাইলীকে মজনুর সঙ্গে বিয়ে দিতে সম্মত হননি লাইলীর বাবা। লাইলীকে তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করতে বাধ্য করেন।

লাইলীর বাবা মজনুর সঙ্গে তার বিয়ে না দিয়ে একজন ধনী বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। এই বিয়েতে লাইলী কিছুতেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু বংশের মান- সম্মান ও পরিবারের ভালোর কথা চিন্তা করে একপ্রকার জোর করেই লাইলীর বাবা সেই বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় লাইলীকে। এ খবর শুনে মজনু রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় ও দুঃখে শহর-গ্রাম ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে যান। তবে বনে গিয়েও কবিতা লেখা বন্ধ করেননি মজনু। এই জঙ্গলে বসেও লাইলীকে নিয়ে মজনু লিখতেন কবিতা। অপরদিকে লাইলী তার বিবাহিত স্বামীকে মেনে নেননি। মজনুর জন্য প্রায় সবসময় কাঁদে। ওদিকে মজনুর শোকে তার বাবা-মা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরও মজনু বাবা-মা’কে একবারও দেখতে আসেননি। তিনি জঙ্গলে বসে শুধু লাইলীকে নিয়েই কবিতা লিখতে থাকেন। একাই কবিতা আবৃত্তি করেন। বালিতে বা মাটিতে লাইলীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কল্পনা করে কবিতা লিখতেন। কয়েক বছর পর, মজনুর বাবা-মা দু’জনেই মারা যান এবং লাইলী নিজেই এই খবরটি মজনুকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার স্বামী খুব চালাক ছিলেন। সে কারণে তিনি বনে গিয়ে মজনুর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাইলী এই কাজের দায়িত্ব দেন এক বৃদ্ধকে। 

একদিন সেই বুড়ো বনে গিয়ে মজনুকে এই খবর দিলেন। মজনু কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। অনেকক্ষণ এভাবে কান্নাকাটি করার পর তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আর কখনো শহরে আসবেন না। বাকি জীবন তিনি বনেই কাটিয়ে দেবেন। এ সময়ই লাইলীর বৃদ্ধ স্বামী মারা যান। তখন লাইলী মজনুর কাছে যেতে চাইলেন। লাইলী মনে মনে ভাবলেন তিনি মজনুর সঙ্গে বাকি জীবন কাটিয়ে  দেবেন। কিন্তু বেদুইন প্রথা অনুসারে, একজন মহিলার স্বামী মারা গেলে, তাকে কমপক্ষে দুই বছর বাড়িতে থাকতে হবে এবং বাড়িতে বসে তার মৃত স্বামীর জন্য শোক পালন করতে হবে। অন্যথায় শাস্তির বিধান রয়েছে। 

এ কারণে লাইলী ঘর থেকে বের হতে পারেননি। কিন্তু লাইলী এই দুই বছর মজনুকে কীভাবে না দেখে থাকবেন? এই ভেবে ভেবে শোকে শোকে সেই ঘরে বসেই লাইলী মারা যান। মজনু যখন শোনেন যে, লাইলী মারা গেছেন, মজনু কাঁদতে কাঁদতে জঙ্গল ছেড়ে বাহিরে চলে আসেন। আর এরপর থেকে মজনু লাইলীর কবরের পাশে বসে শুয়ে কাঁদতে থাকেন। আর এভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কেঁদে ছিলেন। এক সময় কাঁদতে কাঁদতে লাইলীর কবরের উপরে মজনুর মৃত্যু হয়। তবে লাইলী-মজনুর প্রেমের গল্প নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। কেউ কেউ বলেন যে, লাইলী-মজনু ভারতের রাজস্থানে চলে আসেন এবং রাজস্থানের অনুপগড়ে তাদের মাজার রয়েছে। অনেকে বলেন, লাইলীর বৃদ্ধ স্বামী মজনুকে হত্যার জন্য জনবল নিয়ে বনে গিয়ে মজনুকে খুঁজে পেয়ে তাকে প্রচণ্ড মারধর করেন। আবার অনেকে বলেন, মজনুকে আঘাত করা হলে জাদুকরীভাবে লাইলীর শরীরেও একই পরিমাণ আঘাত লাগতো। এভাবে লাইলীর স্বামী যখন মজনুর বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন, এতে মজনু মারা যায় সেই সঙ্গে এই অলৌকিক আঘাতে লাইলীও মারা যান। পরে তাদের দু’জনকে একসঙ্গে দাফন করা হয়। অবশ্য শিরি-ফরহাদের প্রেম কাহিনী সত্যি না গল্প এ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। কিন্তু এ গল্পে শিরি-ফরহাদের মিল হয়নি। দুইজনই মৃত্যুবরণ করেন। 

ইতিহাসে ঠাঁই নেয়া প্রেম কাহিনী পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়েছে। কিন্তু এ প্রেম এখনও মানুষকে উতলা করে। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ভিন্ন দেশের, ভিন্ন মহাদেশের প্রেমিক- প্রেমিকার মিলন হচ্ছে। প্রেমের কারণে কেউ কেউ জীবনকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেয়। বিষপানে আত্মহত্যা করে। আবার কেউ গলায় দড়ি দেয়। প্রেমের এমন করুণ কাহিনী কান পাতলেই শোনা যায়। এই তো ক’দিন আগে নাটোরের গুরুদাসপুরের কলেজ শিক্ষিকা খাইরুন নাহার তার ছাত্র মামুনকে ভালোবেসে ঘর ছাড়েন। যে ঘরে ছিল তার সন্তান, স্বামী। ৪০ বছরের খাইরুন বিয়ে করেন ২২ বছরের মামুনকে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই প্রেমিকা সেই কলেজ শিক্ষিকা নিজের জীবন দিয়ে যান। প্রেমিক গ্রেপ্তার হয়। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এখন সে কাহিনীর শেষ কোথায় কেউ খবরও রাখে না। আসলে যুগে যুগে প্রেম ছিল, প্রেম আছে, প্রেম থাকবে। কোনো প্রেম ইতিহাস হবে। কোনো প্রেমের নিরবে মৃত্যু ঘটবে। আর বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো যদি কোনো প্রেম সেলুলয়েডে বন্দি হয়। কিংবা সাহিত্যে ঠাঁই নেয় তাহলে এ প্রেম অমর হয়েই রবে। প্রেমের তাজমহল আজও মানুষকে ডাকছে। বিশ্বের হাজারো মানুষ তাজমহল দর্শন করে প্রেমের গীত গাইছে। কিন্তু তাজমহলের জীবনের নির্মমতা ক’জনে জানে? আর তাজমহল বানানোতেই রয়েছে আরও এক নির্মমতার কাহিনী। 
 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status