ঢাকা, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ রজব ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

আসন বিন্যাস নিয়ে কারও ভাবনা আছে কি?

শামীমুল হক
৭ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারmzamin

আইনানুযায়ী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের সংসদীয় আসন ব্যাপক ওলটপালট করার ফলে সারা দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-ই সীমানা পুনঃনির্ধারণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে গ্রামাঞ্চলের জনগণ। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারা দেশের সংসদীয় আসনগুলো একইরূপে থাকলেও ২০০৮ সালে এসে হঠাৎ করে ব্যাপক রদবদল আনার পেছনে দুরভিসন্ধি যে ছিল সেটা পরে বোঝা গেছে

এক-এগারোর সময়ে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন সংসদীয় আসনে ব্যাপক রদবদল করেন। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৩০টি আসনে রদবদল করা হয়। সে সময় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে ১৩০ আসনের সীমানা বদল করা হয়েছে। এ রদবদলের তীব্র প্রতিবাদ জানায় বিএনপিসহ অন্যান্য দল। কোনো প্রতিবাদকেই পাত্তা দেয়নি শামসুল হুদা কমিশন। বরং সে সময়কার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ২০০৮ সালের নির্বাচন হবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো। অবশ্য নির্বাচনী ফলাফলে তার এ কথার প্রমাণও মিলেছে। বেছে বেছে ওই আসনগুলোতে পরিবর্তন আনা হয় যে আসনগুলোয় বিএনপি’র জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। এ ছাড়া ১২টি জেলার ১০টি সংসদীয় আসন কর্তন করেছিল হুদা কমিশন। আর জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে শুধু ঢাকায় ৭টি আসন বাড়ানো হয়। ১৩টি থেকে করা হয় ২০টি। যে ১২টি জেলা থেকে আসন কর্তন করা হয় তার মধ্যে ১০টি জেলায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র দখলে ছিল। একটি জামায়াতের আর অন্যটি ছিল আওয়ামী লীগের। বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমানা পুনঃনির্ধারণে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২৩০টি আসন নিয়ে জয়লাভ করে। সামান্য ব্যবধানে বেশির ভাগ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী হেরে যায়। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একতরফা, ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি ডামি নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা একাধিক বার বলেছিলেন, ঢাকা মহানগরীতে সংসদীয় আসন সীমিত রেখে অন্যান্য জেলায় আসন পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী জনসংখ্যা নয়, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় আনতে হবে। ২০০১ সালের নির্ধারিত সীমানায় ফিরে গেলে ভালো হয়। 

আইনানুযায়ী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের সংসদীয় আসন ব্যাপক ওলটপালট করার ফলে সারা দেশে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই সীমানা পুনঃনির্ধারণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে গ্রামাঞ্চলের জনগণ। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারা দেশের সংসদীয় আসনগুলো একইরূপে থাকলেও ২০০৮ সালে এসে হঠাৎ করে ব্যাপক রদবদল আনার পেছনে দুরভিসন্ধি যে ছিল সেটা পরে বোঝা গেছে। প্রথমত বিএনপি’র আসনগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো আপত্তি বা মামলা আমলে নেয়নি কমিশন। সবচেয়ে বেশি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়- ঢাকায় ১৯টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও কুমিল্লায় ৭টি। এ ছাড়াও নোয়াখালীতে ৫টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫টি, সিলেটে ৪টি, নরসিংদীতে ৪টি, গাজীপুরে ৪টি, ময়মনসিংহে ৪টি, যশোরে ৪টি, সিরাজগঞ্জে ৪টি, বগুড়ায় ৪টি, রাজশাহীতে ৩টি, খুলনায় ৩টি, পটুয়াখালীতে ৩টি, বরিশালে ৩টি, টাঙ্গাইলে ৩টি, মুন্সীগঞ্জে ৩টি, নারায়ণগঞ্জে ৩টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, চাঁদপুরে ৩টি, ফেনীতে ৩টি, কুড়িগ্রামে ২টি, সাতক্ষীরায় ২টি, বরগুনায় ২টি, পিরোজপুরে ২টি, নেত্রকোনায় ২টি, কিশোরগঞ্জে ২টি, মানিকগঞ্জে ২টি, ফরিদপুরে ২টি, শরীয়তপুরে ২টি, সুনামগঞ্জে ২টি, লক্ষ্মীপুরে ১টি, কক্সবাজারে ১টি আসন। এসব আসন বিএনপি’র অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত ছিল। যে বারোটি জেলার আসন কর্তন করা হয় সেই জেলাগুলো ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। বিএনপি’র অধ্যুষিত আসনগুলো কেটে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, রাজশাহী ও নেত্রকোনায় বাড়ানো হয়। 

১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশের ৮ ধারায় বলা আছে, ‘আদমশুমারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের জন্য পুনরায় আসনসমূহের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। ৬ ধারায় বলা আছে, আঞ্চলিক ভিত্তিক প্রশাসনিক সুবিধার বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে এবং তা করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনের জনসংখ্যার বিভাজনও বিবেচনায় রাখতে হবে’। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে ১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ অমান্য করেছিল কমিশন। জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আসন পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা মহানগরীর আসন সংখ্যা আট থেকে বাড়িয়ে ১৫টি করতে হয় কমিশনের। পরে অবশ্য বিগত কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাসকে ‘বড়’ ভুল হয়েছে বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল। এ জন্য বিদায়ের আগ মুহূর্তে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ঢাকার আসন ১০টি করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। 

ওদিকে যে ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল সেসব এলাকা থেকে ৩ হাজার ৬৯০টি আপত্তি জমা পড়ে কমিশনে। আপত্তিগুলো আমলে নেয়নি কমিশন। পরে শুনানি শেষে সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ এর ধারা ৬ (৪) অনুযায়ী আপত্তিগুলো খারিজ করে ১৩০টি সীমানা পুনঃনির্ধারণ করে ২০০৮ সালের ১০ই জুলাই গেজেট প্রকাশ করে। ১৭টি জেলার আসন হ্রাস-বৃদ্ধি করেছিল কমিশন। ৯টি জেলা থেকে একটি করে আসন কর্তন করা হয়েছিল। জেলাগুলো হলো-সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, বরগুনা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর ও কুমিল্লা। আর পিরোজপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ থেকে ৫ শতাংশ আসন কাটা হয়। আসন বৃদ্ধি করা হয় ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে একটি, গাজীপুরে একটি, রাজশাহীতে একটি ও নেত্রকোনায় অর্ধেক আসন। ২০০৮ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করায় বিগত সংসদ নির্বাচনে ঢাকা জেলায় সাতটি, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা ও গাজীপুরে একটি করে আসন বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ১২টি জেলার আসন কমাতে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে। ফলে ১৩০টি আসনের সীমানা ওলটপালট হয়ে যায়। উপজেলা অবিভাজিত রাখার নির্দেশনা থাকলেও গাজীপুর সদর উপজেলাকে চারটি ভাগে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলাকে তিন ভাগে, ভাণ্ডারিয়া উপজেলাকে দুটি ভাগে, মতলব উপজেলাকে দুটি ভাগে, সিরাজগঞ্জ উপজেলাকে দুটি ভাগে এবং রাজধানীর প্রায় সব থানাকে তিন থেকে চারটি ভাগ করে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, যথা- নদী ও রাস্তাঘাট বিবেচনার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা  হয়নি। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাণ্ডারিয়া ও কাউখালি উপজেলা নিয়ে একটি আসন থাকলেও ২০০৮ সালে এসে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয় নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলাকে। যদিও নদীপথ ছাড়া ভাণ্ডারিয়ার সঙ্গে নেছারাবাদের যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের এই দুই উপজেলার মধ্যখানে রয়েছে দুটি বড় নদী। এইভাবে অনেক নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অবশ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের বিপক্ষে মতামত দেয় আওয়ামী লীগ। দলটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে এই অবস্থানের কথা জানায়। অপরদিকে বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোটের অন্য দলগুলো সীমানা পুনঃনির্ধারণের পক্ষে মত দেয়। বিএনপি মনে করে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে করা সীমানা পুনঃনির্ধারণের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সিইসি’র সঙ্গে দেখা করে ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ার দাবি করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিটি করেছে। নির্বাচনী সংস্কার কমিটি কি আসন পুনর্বিন্যাসের কথা মাথায় রেখে এগুচ্ছে? এ ছাড়া বিএনপি এ নিয়ে কী ভাবছে। নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে কথা বলছে। যতদ্রুত সম্ভব সংস্কার কাজ শেষে নির্বাচন দাবি করছে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসন বিন্যাসের দাবি জোরালোভাবে সামনে আনছে না। আসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই সকল দলের মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এগুতে হবে। নির্বাচন সংস্কার কমিটি এক্ষেত্রে কী পরামর্শ দেয় সেটাও দেখা যেতে পারে।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status