নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
ডিজিটাল ঈদ ডিজিটাল শুভেচ্ছা
শামীমুল হক
১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবারগ্রামেগঞ্জে মেলা বা বান্নি চলে আসছে আদিকাল থেকে। চৈত্রের শেষদিন থেকে বৈশাখের মেলা এক অন্যরকম আকর্ষণ হয়ে ওঠে মানুষের মাঝে। মেলায় যেমন গ্রামীণ ঐতিহ্য মাটির বাসন কোসন কেনার ধুম পড়ে। তেমনি মেলায় বসে নানা পণ্যের হাট। গ্রামের মানুষজন মাসের পর মাস অপেক্ষা করে বৈশাখী মেলার জন্য। মেলাগুলো সাধারণত নদীর তীরে, কোনো বটগাছের নিচে বসে। কি নেই মেলায়? দা, বঁটি থেকে শুরু করে মিঠাই, খাট থেকে পালং সবই পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ মাটির তৈরি জিনিসপত্র, খেলনার পসরা জমে।
ঈদের আনন্দ, শুভেচ্ছা বিনিময়, ভাব প্রকাশ সবই যেন বদলে গেছে। পৃথিবী বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আচার-কানুনও। ঈদের চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা এখন আর চোখে পড়ে না। আগেকার দিনে চাঁদ দেখতে পারার যে আনন্দ এখন তা একেবারেই মিইয়ে গেছে। বন্ধ-ুবান্ধব মিলে পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে থাকতো চাঁদ দেখার জন্য। চোখের ফলক পর্যন্ত ফেলতো হিসাব করে। যেন ফস্কে না যায়। এখন শহর তো দূরের কথা, গ্রামগঞ্জেও সেই প্রতিযোগিতা নেই। গর্ব করে কেউ বলতে পারে না আমি চাঁদ দেখেছি। আর এই চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেতো ঈদের আনন্দ। এখন চাঁদ দেখা গেছে ঘোষণা আসার অপেক্ষায় বসে থাকেন সবাই। নিজ চোখে চাঁদ দেখার আগ্রহ নেই কারও। চাঁদ দেখার ঘোষণা শোনার পর শুরু হয় ডিজিটাল ঈদ মোবারকের বন্যা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার- ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা মাধ্যমে পাঠাতে থাকে পোস্টার। যেখানে লেখা থাকে ঈদ মোবারক। আর তার নানা পদবি। এই পোস্টার একটি ডিজাইন করে নিজের হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ক্লিক করে একেবারে সবার মাঝে পৌঁছে দেয়া হয়। আর এনালগ যুগে কোনো বন্ধুকে ঈদ শুভেচ্ছা দিতে হলে ছুটে যেতে হতো তার বাড়ি। অর্থকড়ি খরচ করে, সময় ব্যয় করে, গাড়ি ভাড়া দিয়ে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হতো। ডিজিটাল যুগ কতো কাছে এনে দিয়েছে সবকিছু। কিন্তু এতে আনন্দ কি বেড়েছে? নাকি কমেছে? একেক জনের একেক মত। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ভালোবাসা আর আবেগ কমেছে অনেক। এখন মনে হয় একটি ডিজাইন করা পোস্টার পাঠালেই হয়ে গেল। আর ফেসবুকে দিয়ে দিলেই হলো।
নিজের প্রচার যেমন হচ্ছে তেমনি অন্যকে ঈদ মোবারক দেয়াও হলো। কে দেখলো না দেখলো তাতে কি? আবেগ প্রকাশ হলো কিনা তাও জানার দরকার নেই। সবাই দেয় তাই আমি দেই। এই ঈদ শুভেচ্ছার মূল্য কি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের আগে অন্তত একজন আরেকজনকে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে ঈদ মোবারক জানাতেন। শুভেচ্ছা জানাতেন। দাওয়াত দিতেন। এখন তাও হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ঈদগাহে প্রবেশ করার ছবি, ঈদগাহে বসার ছবি, নামাজে দাঁড়ানোর ছবি, ঈদের নামাজ শেষে ফেরার ছবি মিনিটে মিনিটে ফেসবুকে আপলোড করছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কোলাকুলির ছবি তেমন দেখা যায় না। অথচ আগে নামাজ শেষে মাঠ থেকে বেরুতেই আধাঘণ্টা একঘণ্টা সময় লাগতো। কারণ একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করতে করতে এ সময় চলে যেতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও নানা ধরনের ছবি দেয়া হয় ঈদের আনন্দের। বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডা, নৌকা ভ্রমণ, পিকনিক, ঘুরে বেড়ানোর ছবি ফেসবুক জুড়ে আছে। এসবই ডিজিটাল যুগের ঈদ আনন্দ। কোথাও কোথাও নামকরা শিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় কনসার্টের। কোথাও বা কিসসার আসর। মূল কথা ঈদের আনন্দ এখন বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে। যে যেভাবে পারে এ আনন্দকে উপভোগ করছে। কিন্তু এসবই মনে হয় কৃত্রিম। আগের মতো হৃদয় দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগ করার মানসিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে প্রায় মানুষই। কেউ বা প্রেমিকাকে নিয়ে দূরে কোথাও নদীর ধারে বা কোনো পার্কে বসে না বলা কথা অনর্গল বলে যাচ্ছে। ডিজিটাল যুগের প্রেম ভালোবাসায়ও নাকি পরিবর্তন এসেছে। একে অপরকে আদর না করা পর্যন্ত নাকি সে প্রেম পোক্ত হয় না। ঈদের পরদিন মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে দেখি মাঠ জুড়ে বহু যুবক বয়সী ছেলেরা বসে আছে। সবার হাতে মোবাইল ফোন। আর এ ফোনের দিকে দৃষ্টি সবার। হয়তো কেউ প্রেমিকার সঙ্গে চ্যাট করছে। কেউবা এয়ার ফোন লাগিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলছে। আবার কেউ বা কোনো বন্ধুর সঙ্গে গ্রুপ বেঁধে খেলছে। কেউ বা অনলাইন জুয়ায় মত্ত। এদের ঈদের আনন্দ এভাবেই কেটেছে। মোট কথা ঈদ এখন ডিজিটালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আগে যেখানে ঈদের দিন সিনেমা দেখতে যাবেÑ এজন্য যুবকরা প্রস্তুতি নিতো সপ্তাহ, দশ দিন আগ থেকে। এখন সিনেমামুখী আর কেউ হন না। ঘরে ঘরে টেলিভিশন আছে ঠিকই। কিন্তু এ টেলিভিশন অন হয় খুব কম। সবাই ব্যস্ত মোবাইল ফোন নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে। ছবি উঠানো আর আপলোড নিয়ে। আবার কোনো গ্রুপ আছে ঈদে নানা অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। কবিতা পাঠের আসর। নাটক মঞ্চস্থ করা। জারি গানের আসর। আবার এক ধরনের যুবক আছে যারা খাবার নিয়ে ব্যস্ত। কোন রেস্তরাঁয় কি খাবার আছে তাদের মুখস্থ। ঈদে দলবেঁধে তারা সেসব রেস্তরাঁয় ছুটেন। সব মিলিয়ে বলা যায় ঈদের এখন নানা রঙ।
আবার এক শ্রেণির যুবক রয়েছেন যারা সাউন্ডবক্স বাজিয়ে সড়কে ধুলো উড়িয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায়। তাদের এ কীর্তিকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে মানুষ। অবশ্য প্রশাসন এ ব্যাপারে থাকে সজাগ। এই ঈদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে একদল যুবক সাউন্ডবক্স নিয়ে পিকআপ ভ্যানে রাস্তায় নেমে আসে। ঈদ আনন্দের নামে এরা বিশৃঙ্খলা ও বেহায়াপনা করতে থাকে। ঈদের দিনে এমন বেহায়াপনা দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সরাইল সদরের বকুলতলা এলাকায় এমন কাণ্ড হচ্ছে জেনে ইউএনও মো. মেজবাহ-উল- আলম ভূঁইয়া হানা দেন। সাউন্ডবক্স ও ডেক্সসেট জব্দ করেন। এ সময় যুবকরা পালিয়ে যায়। ইউএনও’র দপ্তর সূত্র জানায়, প্রতিবছরই ঈদ বা অন্যকোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস উদ্যাপনের নামে পিকআপ ভ্যানে সাউন্ডবক্স ও ডেক্সসেট বসিয়ে একদল তরুণ চলন্ত গাড়িতে বিভিন্ন আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গিতে নাচতে থাকে। অশ্লীল ভাষায় তারা গানও গায়। গাড়িতে বসেই তারা ধূমপান ও নেশা করে। চালক ও যাত্রীরা আনন্দে মাতোয়ারা থাকে। এ ফাঁকে দুর্ঘটনাও ঘটে।
তাই বিনোদন বা আনন্দের নামে পিকআপ ভ্যানে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে নাচ-গান প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় একাধিক দাবি তুলেছেন বক্তারা। এবারের ঈদুল ফিতরে এ জাতীয় কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে গত ৯ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছেÑ পবিত্র ঈদুল ফিতর-২৪ এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সাউন্ডবক্স/ডেক্সসেট বাজানো, পটকা/আতশবাজি ফাটানো ও ক্রয়-বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। ইউএনও মো. মেজবা-উল-আলম ভূঁইয়া বলেন, সরকারি আদেশ অমান্য করে যা ইচ্ছা তাই করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সরাইল ও কালিকচ্ছ তিন জায়গায় সাউন্ডবক্স আর ডেক্সসেট জব্দ করেছি।
এবার ঈদের দু’দিন পর গেছে বাংলা নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতির ধারক। গ্রাম থেকে শহরে এ দিনটিকে অন্যরকমভাবে স্বাগত জানায় বাঙালি। ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বৈশাখকে স্বাগত জানায়। রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে। গ্রামেগঞ্জে মেলা বা বান্নি চলে আসছে আদিকাল থেকে। চৈত্রের শেষদিন থেকে বৈশাখের মেলা এক অন্যরকম আকর্ষণ হয়ে ওঠে মানুষের মাঝে। মেলায় যেমন গ্রামীণ ঐতিহ্য মাটির বাসন কোসন কেনার ধুম পড়ে। তেমনি মেলায় বসে নানা পণ্যের হাট। গ্রামের মানুষজন মাসের পর মাস অপেক্ষা করে বৈশাখী মেলার জন্য। মেলাগুলো সাধারণত নদীর তীরে, কোনো বটগাছের নিচে বসে। কি নেই মেলায়? দা, বঁটি থেকে শুরু করে মিঠাই, খাট থেকে পালং সবই পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ মাটির তৈরি জিনিসপত্র, খেলনার পসরা জমে। ভুভুজেলার ভু ভু শব্দ শোনা যায় দূর পথ থেকে। ঘোড়ায় চড়া, চড়কায় উঠাসহ শিশুদের জন্য রয়েছে নানা আনন্দের আইটেম। বৈশাখী মেলা বাঙালির নানা ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে। আর ঈদ আনন্দ দিন দিন ডিজিটাল রূপ ধারণ করছে। তবে ঈদ বলি আর বৈশাখ বলি সব উৎসবেই লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। শুভেচ্ছা এখন আর কথার মাধ্যমে আসে না। আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে নেই কোনো আবেগ কিংবা ভালোবাসা। আছে শুভেচ্ছাদাতার ছবি সংবলিত পোস্টার। যাতে শুভেচ্ছাদাতা শুভেচ্ছা জানানোর চেয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত।
শামীমুল হক,, গত ২৮ বছর ধরে আমি উনার একজন ভক্ত। বিশেষ করে উনার লিখা পড়ার জন্য একধরণের উন্মাদ বললেও ভুল হবে না। যেমন আজকের লেখাটাই যদি ধরি,,তাহলে আমার মতে বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমানে ডিজিটাল যুগ তথা বাংলার পুরো সাংস্কৃতি ও প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তিনি যোনো বাংলার মুখ,বাংলার অবগাহন।
ডিজিটাল শুভেচ্ছা বার্তায় কোনো আবেগ-ভালোবাসা নেই, আছে শুধুমাত্র অযোগ্যদের নিজেকে প্রচার করার হীন মানসকিতা।