ঢাকা, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

ড. ইউনূস, রিদম জিরো আর মানুষের ‘বস্তু’ হয়ে থাকার ফল

ডা. জাহেদ উর রহমান
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার
mzamin

যদি এমন হয় একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার, যেটি তার দলের এবং স্বার্থের সহযোগী ছাড়া আর সবাইকে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পথে হুমকি মনে করে, সেটি ‘বস্তু’ হয়ে থাকা মানুষের প্রতি কেমন আচরণ করবে?
৬ ঘণ্টার প্রদর্শনী শেষে মারিনা যখন ‘বস্তু’ অবস্থা থেকে জীবন্ত মানুষে পরিণত হয়ে যখন খুব স্বাভাবিকভাবে (উগ্র বা আক্রমণাত্মক নয়) এগিয়ে যান তার উপরে অত্যাচার করা মানুষগুলোর দিকে, তারা তখন পালিয়ে চলে যায়। জানি, এখানেই পাল্টা প্রশ্ন আসবে, ড. ইউনূস যদি অনেক আগে থেকেই বর্তমান সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলে যেতেন, তাহলে কি তিনি আজকের সমস্যায় পড়তেন না? 
কর্তৃত্ববাদী কিংবা হাইব্রিড রেজিম মানুষকে আদতে একটা ‘বস্তুতে’ পরিণত করতে চায় এবং অনেক সময়ই সফল হয় তারা। মানুষের মধ্যেও এই বিভ্রম তৈরি হয় যে, তারা যদি ‘বস্তু’ হয়ে থাকেন, তাহলে নিরাপদ থাকবেন তারা। মানুষের এই বিশ্বাস যে, কতোটা ভ্রান্ত, ড. ইউনূস হতে পারেন, তার একেবারে মোক্ষম উদাহরণ


সামপ্রতিক সময়ে ড. ইউনূস বেশ সরব হয়ে উঠেছেন। দেশি-বিদেশি নানা সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তিনি। সরকার তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেগুলোর। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি কেন এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন, এমন স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কেও কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু আমাদের অনেকেই সম্ভবত অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের মানদণ্ডে কিছু নিষিদ্ধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যেমন বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা, ভোটাধিকারহীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা, মত প্রকাশের সংকট ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কঠোর কথা বলছেন। তাকে যারা চেনেন, যারা তাকে দীর্ঘদিন থেকে অনুসরণ করেন, তাদের মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে হঠাৎ কেন তার এমন পরিবর্তন?

এ যাত্রা ড. ইউনূস কথা বলতে শুরু করার ক্ষেত্রে প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ডয়চে ভেলে বাংলার সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস এমন কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো কারও কাছে মনে হতেই পারে, তার বলা উচিত হয়নি।

বিজ্ঞাপন
সত্যি বলতে এই কলাম লেখার অনুপ্রেরণা তার এই সাক্ষাৎকারের একটি বক্তব্য থেকেই।

ড. ইউনূসের মামলার রায়ের পর জনগণকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক কণ্ঠে কথা বলার আহ্বান জানানোর প্রসঙ্গ টেনে সঞ্চালক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মামলা থেকে মুক্তি পেতেই তিনি এই ধরনের আহ্বান জানিয়ে সরকারের পরিবর্তন চাইছেন কিনা। ড. ইউনূস জানান তিনি আসলে সবাইকে আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আমরা সবাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের পক্ষে। তিনি মনে করেন, এগুলো না থাকলে আমরা জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবো না। তিনি এটাও মনে করেন এগুলো এখন অনেক দূরতম বস্তু হয়ে গেছে আমাদের জন্য, তাই এগুলো আমাদের মুখ ফুটে বলতে হবে। 

পরিপূরক প্রশ্নে সঞ্চালক তাকে জিজ্ঞেস করেন কিছু না বলেও ড. ইউনূস যেমন দুর্যোগের মধ্যে আছেন, তিনি কিছু বললে না জানি কী হতো। জবাবে তিনি বলেন, ‘তুমি তো সবটা বলেই ফেলেছো সমস্যাগুলো কী। কাজেই এই হলো অবস্থা। অবস্থাটা হলো আমি দেশের কাউকে কিছু বলি না, এমন কথা তো নয়ই। বাইরে,  বিদেশেও সবাইকে সাদরে নিয়ে আসি, তাও না। তাদেরকে অনেক শর্ত দেই আমার এই কথাগুলো ছাপানোর আগে আমাকে বলতে হবে যাতে আবার এমন কোনো কথা-শব্দ এমন থেকে না যায়, আমি আরও বিপদের সম্মুখীন হবো। আমি শুধু বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য এটা করছি। কারণ আমি চারদিক থেকে বিপদের মধ্যে আছি। কাজেই কথা না বলা, এটা একটা নিজেকে রক্ষা করার একটা সুবিধা আর কি। কথা যত কম বলা যায়, ততই হয়তো ঝামেলা থেকে বাঁচবো।’
এরপর সঞ্চালক তাকে করেছিলেন একটি একেবারে অনিবার্য পাল্টা প্রশ্ন- নিজেকে কতোটা রক্ষা করতে পারলেন ড. ইউনূস? জবাবে ড. ইউনূস কী বলেছিলেন, সেটা সম্ভবত অনুমান করতে পারছি আমরা। সে প্রসঙ্গে আমরা ফিরে আসবো আবার, তার আগে জেনে নেই এক বিশ্বখ্যাত পারফরম্যান্স শো সম্পর্কে।

মারিনা আব্রামোভিচ একজন সার্বিয়ান পারফরম্যান্স আর্টিস্ট। ১৯৭৪ সালে ইতালির নেপলসে একটি অভিনব পারফরম্যান্স আয়োজন করেন। ‘রিদম জিরো’ নামের এই পারফরম্যান্সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছয় ঘণ্টা তিনি থাকবেন ‘বস্তু’ হিসেবে; স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং দর্শকরা তার সঙ্গে করতে পারবেন যা খুশি তা। মারিনা তার সামনে একটি টেবিলে রাখেন ৭২টি বস্তু। এর মধ্যে যেমন ছিল গ্লাস, মোমবাতি, গোলাপ, চুলের ব্রাশ, চিরুনি, আয়না, লিপস্টিক, পালক, মধু, রুটি, মদ- এর ‘নির্দোষ’ জিনিস, তেমনি ছিল কাঁচি, সার্জিক্যাল ছুরি, করাত, কুড়াল এবং একটি বুলেটসহ একটি পিস্তলের মতো মারাত্মক সব অস্ত্র। আগ্রহী দর্শকরা এসব বস্তুর যে কোনোটি মারিনার ওপরে ব্যবহার করতে পারবেন বলে জানানো হয়। তিনি কাউকে কোনো রকম বাধা দেবেন না, এবং যা ই ঘটুক না কেন, সবকিছুর দায়-দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা দেন।

শুরুর দিকে দর্শনার্থীরা শান্ত ছিলেন। তারা মারিনার সঙ্গে মজাও করছিলেন। সময় যত এগিয়ে যেতে থাকে ততই তারা আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। কেউ তার শরীরে হাত দেন, আঁচড় কাটেন। সময় গড়াতে থাকে আর দর্শনার্থীরা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে থাকেন। তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়। গোলাপের কাঁটা ফোটানো এবং ছুরি দিয়ে আঁচড় কাটা হয় তার শরীরে। একজন পিস্তলটি নিয়ে তার মাথায় তাক করেন, যদিও একজন দর্শনার্থী তাকে নিবৃত্ত করেন। চরম সহিংস একটা পরিস্থিতিতে নির্ধারিত ৬ ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়। এরপর যা করলেন তিনি এবং সেটার যে ফল হলো সেটা নিয়ে বলছি কলামের শেষের দিকে। 

চুপ থেকে কতোটা রক্ষা পেয়েছেন, ডয়চে ভেলের সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস স্পষ্টভাবেই বলেন, ‘পারলাম না তো। এখন তো শুধু বাড়ছেই, বাড়ছেই। এখন তো বড় কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি। কিছুদিন আগে হয়তো খবর পেয়েছো, এ মাসের মধ্যেই যে ১২ তারিখে যে ঘটনা ঘটলো, যে আমাদের অফিসের মধ্যেই ঢুকে গেল লোকজন। ঢুকেই বললো এটা আমরা এখন দখল করলাম...’। ড. ইউনূস আরও অনেকের মতোই ভেবেছিলেন চুপ করে থাকাটা তাকে নিরাপদ রাখবে। 
রিদম জিরো শোটায় আসা দর্শনার্থীদের কারও সঙ্গে মারিনার কোনো শত্রুতা দূরেই থাকুক, ছিল না কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্বও। কিন্তু শুধুমাত্র মারিনা বস্তু হয়ে থাকবেন এই নিশ্চয়তা পেয়ে সেই মানুষগুলোই চড়াও হয়ে উঠেছিল তার ওপরে। আর যদি এমন হয় একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার, যেটি তার দলের এবং স্বার্থের সহযোগী ছাড়া আর সবাইকে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পথে হুমকি মনে করে, সেটি ‘বস্তু’ হয়ে থাকা মানুষের প্রতি কেমন আচরণ করবে?

৬ ঘণ্টার প্রদর্শনী শেষে মারিনা যখন ‘বস্তু’ অবস্থা থেকে জীবন্ত মানুষে পরিণত হয়ে যখন খুব স্বাভাবিকভাবে (উগ্র বা আক্রমণাত্মক নয়) এগিয়ে যান তার উপরে অত্যাচার করা মানুষগুলোর দিকে, তারা তখন পালিয়ে চলে যায়। জানি, এখানেই পাল্টা প্রশ্ন আসবে, ড. ইউনূস যদি অনেক আগে থেকেই বর্তমান সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলে যেতেন, তাহলে কি তিনি আজকের সমস্যায় পড়তেন না? 

কর্তৃত্ববাদী কিংবা হাইব্রিড রেজিম মানুষকে আদতে একটা ‘বস্তুতে’ পরিণত করতে চায় এবং অনেক সময়ই সফল হয় তারা। মানুষের মধ্যেও এই বিভ্রম তৈরি হয় যে, তারা যদি ‘বস্তু’ হয়ে থাকেন, তাহলে নিরাপদ থাকবেন তারা। মানুষের এই বিশ্বাস যে, কতোটা ভ্রান্ত, ড. ইউনূস হতে পারেন, তার একেবারে মোক্ষম উদাহরণ।
 

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

 

পাঠকের মতামত

Absolutely right.

IBRAR
৯ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:৫১ পূর্বাহ্ন

Absolutely right.

হাফিজ
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১২:০৭ অপরাহ্ন

খুব ভালো উদাহরণ টেনে বর্তমান বাস্তবতার সাথে তুলনা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। সত্যিই প্রশংসনীয় কলাম এটি।

Mr K
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৫০ পূর্বাহ্ন

কথায় আাছে - সুযোগ পেলে মানুষ আপনার মাথায় লবন রেখে বড়ই খাবেই। বস্ত হয়ে থাকলে আরো বড় বিপদ, ধুলো বালি তো আপনার উপর পড়বে, মশা মাছি বসবে তদোপড়ি মামুষও আপনার পিছনে কিছু একটা দিয়ে পরখ করবেই।

Md. Idris khan
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন

I appreciate, it's a new way to look into the problem

Md Alamgir jalil
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৫:২৮ পূর্বাহ্ন

This is a well-timed and perfect column. Plz try to write regularly. You always inspiring our people's.

Mamoon
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১:৪০ পূর্বাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status