নির্বাচিত কলাম
হা ল ফি ল বৃত্তান্ত
প্রলম্বিত যুদ্ধের মানচিত্র
ড. মাহফুজ পারভেজ
২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবারশুধু গাজা বা ফিলিস্তিনই নয়, পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থাই অধিকাংশ জায়গা দখল করে রয়েছে। শুধু মৌখিক হুমকি নয়, চলছে সরাসরি আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ। যার সর্বশেষ উদাহরণ ইরান-ইসরাইল সংঘাত। ইরান-ইসরাইলের মধ্যে চাপা-সংঘাত চলছিল আগে থেকেই। তবে কেউই মুখোমুখি হয়নি। ইরান নেপথ্যে থেকে হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতিদের মাধ্যমে ইসরাইল ও মার্কিন প্রতিপক্ষকে সামাল দিচ্ছিল। ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোও পরোক্ষে শক্তি প্রয়োগ করছিল। এপ্রিল মাসে এসে সেই ছায়াযুদ্ধের পর্দা সরে যায়। ইরান প্রথমবারের মতো ইসরাইলে আক্রমণ চালায়।
সূচনাকালে ২০২৪ সালকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘নির্বাচনী বছর’ হিসাবে। বলা হয়েছিল, ‘বছরটি বিশ্বের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি নজিরবিহীন কালপর্ব’। এ বছর অন্তত ৬৪টি দেশের নির্বাচনে বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ বা প্রায়-অর্ধেকই অংশ নেবেন। সবাই আশা করেছিলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের উত্তরণ হবে।
নানা দেশে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনে গণতন্ত্রের উন্নতি হয়েছে কমই; বরং নানা সূচক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের ক্ষয় এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান। এমনকি, মাত্র চার মাসের মধ্যে ২০২৪ নামক চলমান বছরের রূপ-চরিত্রও নেতিবাচক গতিতে বদলে যেতে শুরু করেছে। জনগণের যে বিরাট অংশ ছিলেন ভোট দিতে প্রস্তুত, তাদের অধিকাংশই এখন যুদ্ধ বা যুদ্ধের আতঙ্ক কবলিত। ‘নির্বাচনী বছর’ ২০২৪ সাল শেষ পর্যন্ত ‘যুদ্ধের বছর’-এ পরিণত হয় কিনা, সেটাই সবাইকে ভাবাচ্ছে। কারণ প্রতিদিনই বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হচ্ছে ‘যুদ্ধের মানচিত্র’। পরিস্থিতি কতোটা খারাপ, তার উদাহরণ গাজা। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় গড়ে কমপক্ষে ৫০ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার (২০শে এপ্রিল) সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার এক লাইভ আপডেটে ইসরাইলি বর্বর হামলায় ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজারে ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে।
শুধু গাজা বা ফিলিস্তিনই নয়, পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থাই অধিকাংশ জায়গা দখল করে রয়েছে। শুধু মৌখিক হুমকি নয়, চলছে সরাসরি আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ। যার সর্বশেষ উদাহরণ ইরান-ইসরাইল সংঘাত।
ইরান-ইসরাইলের মধ্যে চাপা-সংঘাত চলছিল আগে থেকেই। তবে কেউই মুখোমুখি হয়নি। ইরান নেপথ্যে থেকে হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতিদের মাধ্যমে ইসরাইল ও মার্কিন প্রতিপক্ষকে সামাল দিচ্ছিল। ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোও পরোক্ষে শক্তি প্রয়োগ করছিল। এপ্রিল মাসে এসে সেই ছায়াযুদ্ধের পর্দা সরে যায়। ইরান প্রথমবারের মতো ইসরাইলে আক্রমণ চালায়। ইসরাইলও পাল্টা হামলা করে। উল্লেখযোগ্য ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি এর ফলে উতপ্ত ও অগ্নিগর্ভ।
এদিকে, ইউরোপের এক কোণে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই। সেখানেও বিশ্বের বড় শক্তিগুলো পরোক্ষে যুক্ত। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশেও চলছে খণ্ড-খণ্ড যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত। চীন-তাইওয়ানে রয়েছে উত্তেজনা। দক্ষিণ চীন সাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নানা স্থানে শক্তি সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। মিয়ানমারে তীব্র সংঘাতে লিপ্ত দেশটির সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর বাইরেও আরো অনেক জায়গায় সুপ্ত বা প্রকাশ্যে বিরাজমান যুদ্ধ লেগে যাওয়ার ভয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রতিটি যুদ্ধ, সংঘাত ও যুদ্ধাবস্থায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী পক্ষসমূহ ছাড়াও পেছনে রয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো। বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে বা গোপনে সংযুক্ত। অস্ত্র বিক্রি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে দেশগুলো যতটুকু সরব, যুদ্ধ, সংঘাত ও যুদ্ধাবস্থা সামাল দিতে মোটেও ততটুকু আগ্রহী নয়। এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ইসরাইলের আগ্রাসনের পক্ষে অস্ত্র সরবরাহ ও কৌশলগত সমর্থনের পাশাপাশি জাতিসংঘে অসংখ্য বার ভেটো দিয়ে পরিস্থিতি থামানোর বদলে চলমান রেখেছে। ফলে বিশ্ববাসীর শত অনুরোধের পরেও ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি।
যুদ্ধ বন্ধ না-হওয়ার বা বন্ধ না-করার রেকর্ড চলছে বর্তমান বিশ্বে। জাতিসংঘ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসাবে মৌখিক কথাবার্তা ছাড়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য কোনো কার্যকরী ভূমিকাই রাখতে পারছে না। এতে যুদ্ধবাজরা যেমন প্রণোদিত হচ্ছে, তেমনিভাবে আক্রান্তরাও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতাই ক্রমবর্ধিষ্ণু যুদ্ধ পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
বিশ্বের নানাস্থানে যুদ্ধ ও যুদ্ধাবস্থার কারণে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র ব্যবসা ও প্রভাব বৃদ্ধি পেলেও মূল সংকটে পড়ছে বিশ্বের উন্নয়নশীল দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো ও সেখানকার কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। কারণ, একেকটি যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কায় সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যা ও সরবরাহ বিঘ্নের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে, যার কারণে নানা ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়। ডলারের দামও প্রভাবিত হয় যুদ্ধের কারণে, যা নানা দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়।
সবচেয়ে বড় বিপদ আসে জনশক্তি খাতে। দরিদ্র দেশগুলোর শ্রমবাজার যুদ্ধের কারণে সংকুচিত হয়। বহু প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে দেশে ফিরে আসেন। বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও তখন কমে যায়। ফলে কোনো স্থানে যুদ্ধ চললে তার বহুমাত্রিক কুপ্রভাব বিশ্বের নানা দেশে পরিলক্ষিত হয়। যুদ্ধ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও একটি দেশ বা একজন মানুষ যুদ্ধের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির পরোক্ষ দায়ভার ভোগ করতে বাধ্য হয়।
একবিংশ শতকের বিশ্ব যখন জলবায়ু সমস্যা, উষ্ণায়নের বিপদ, জ্বালানি সংকট, ধনী-দরিদ্র তথা উত্তর-দক্ষিণের ভারসাম্যহীনতা এবং প্রযুক্তিগত নানা ভীতির সম্মুখীন, তখন প্রয়োজন ছিল সমগ্র বিশ্বকে একযোগে এসব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে আসা। এজন্য বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যে একটি ঐক্য দরকার ছিল। প্রয়োজন ছিল ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তার কবল থেকে সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার। পরিতাপের বিষয় হলো, বিশ্বনেতাদের কেউই এমন সর্বজনীন অবস্থান নেয়া সাহস ও উদারতা দেখাতে পারছেন না। সবাই নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও রাজনৈতিক লাভের জন্য মরিয়া। এমনকি, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও তারা সকলের জন্য হিতকর পথে যাওয়ার বদলে নিজের স্বার্থে কব্জা করে রেখেছেন। এরই ফলাফল হলো যুদ্ধের বিস্তার ও সংঘাতের বিস্তৃতি।
আন্তর্জাতিক স্তরে মানবিক নেতৃত্ব ও শক্তিশালী সংস্থার অভাবের ফল ভোগ করছে বিশ্ববাসী একাধিক যুদ্ধের মাধ্যমে। প্রতিদিনই যুদ্ধ থামার বদলে বাড়ছে নতুন নতুন যুদ্ধ। পরিধি বাড়ছে যুদ্ধের মানচিত্রের। পৃথিবীর নানা স্থানে ঘটছে যুদ্ধের বিস্তার। বিশ্ববাসী যুদ্ধের নানারূপ প্রতিফলের দ্বারা নিত্য আক্রান্ত হচ্ছে। এই অবস্থান অবসান কোথায়, কেউ জানে না। অনেকে আশঙ্কা করেন, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি চলতেই থাকলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। বিশ্ব শক্তিগুলোর মদদে, থেমে থেমে ও সুপ্তভাবে এতগুলো যুদ্ধ চলতে থাকলে তাকে ‘অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বললে দোষের হবে না।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিবেক সত্যিই চরমভাবে শঙ্কিত। বিশ্বজমিনে প্রলম্বিত যুদ্ধের মানচিত্র। চারিদিকে ছোট ও বড় রক্তাপ্লুত রণাঙ্গন। আশার আলো বলতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেই। এমতাবস্থায় বিশ্ববাসী কোন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে? মানুষের বিদ্যা, বুদ্ধি, যুক্তি, জ্ঞান, বিবেক পরাজিত হয়ে নেমে আসবে সংঘাতের অন্ধকার যুগ? বিশ্ববাসী অক্ষম দৃষ্টিতে দেখবে দানবের উল্লাস? শেষ পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হবে ‘বাবা ভঙ্গ’ নামে পরিচিতি সেই অন্ধ নারী জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী?
‘বাবা ভঙ্গ’ নামের জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী সেই নারী পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন ২৭ বছর আগে। ১৯৯৬ সালে মৃত্যু হয় এই বুলগেরীয় জ্যোতিষীর, যাকে বলকানদের নস্ট্রাডামাস বলেই ডাকা হতো। অনেকেই মনে করছেন, সত্য হতে চলেছে তার আশঙ্কা। বিশেষত, বিশ্ব যখন নানা যুদ্ধ ও সংঘাতে জর্জরিত, তখন সবার মনেই শঙ্কা! সবারই প্রশ্ন- কী হতে যাচ্ছে? কোন পথে বিশ্ব? তখনই কেউ কেউ বলছেন, বিশ্ব কী সেই পথেই, যে পথের শঙ্কা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন সেই অন্ধ জ্যোতিষী ‘বাবা ভঙ্গ’। যার পরিণতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা এক ভয়াল ২০২৪ সালের বিপদাপন্ন পরিস্থিতির গর্ভে লুকায়িত।
কারণ, ‘বাবা ভঙ্গ’ তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বে কোন বছর কী ঘটবে তা নিয়ে নিজের গণনালব্দ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তার সেসব কথা যে একেবারে ফ্যালনা নয়, তা এরই মধ্যে বিশ্ববাসী টের পেয়ে গেছে। সবশেষে আসা কোভিড-১৯ মহামারির পূর্বাভাসও তিনি করেছিলেন। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, বাবা ভঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল ২০২৪ সাল।
২০২৪ নিয়ে তার বক্তব্য ছিল মারাত্মক। তার মতে, ভয়াল কালোয় আচ্ছন্ন একটি বছর হবে এটি। সে আশঙ্কার তালিকায় রয়েছে ইউরোপ জুড়ে সন্ত্রাসী হামলা, বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট আর জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার। এমনকি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর একটি হত্যাচেষ্টা চালানো হবে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্যও তার গণনায় এসেছিল। মোদ্দা কথায়, যুদ্ধ ও সংঘাতের নানা চেহারা তিনি দেখেছিলেন ২০২৪ সালের অবয়বে। যে ২০২৪ সাল হওয়ার কথা বিশ্বব্যাপী নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার বছর, সেখানে এখন যুদ্ধ, সংঘাত, মৃত্যু ও রক্তের হাতছানি! সভ্যতার শিক্ষা ও বিবেকের শক্তি পরাজিত যুদ্ধবাজদের দাপটের সামনে। যুক্তির পথ রুদ্ধ হওয়ায় গুরুত্ব পাচ্ছে ‘বাবা ভঙ্গ’ নামে পরিচিত পূর্ব ইউরোপের সেই অন্ধ নারী জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী!
লেখক: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।