ঢাকা, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

ঈদের আনন্দ ঈদের বেদনা

শামীমুল হক
৮ এপ্রিল ২০২৪, সোমবারmzamin

এত আনন্দের মাঝেও নিরানন্দ ঈদ কাটে দেশের একটি অংশের মানুষের। এরা জোগাড় করতে পারে না নতুন কাপড়। সেমাই খাবে এমন অবস্থাও নেই কারও কারও। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদ আসে নিরানন্দ হয়েই। সেমাই-চিনির বদলে মুখে উঠে পান্তা ভাত আর মরিচ পুড়া। এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে দেশে। অবশ্য এসব মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগ করে দিতে স্থানীয় ও সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ বর্তমান সময়ে চোখে পড়ে। যুবকরা নিজেরা চাঁদা দিয়ে সেমাই, চিনি, পোলাও চালসহ প্রয়োজনীয় আরও সামগ্রী এক করে প্যাকেট তৈরি করে। পরে লিস্ট করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের কিছু এলাকায় এ সুবিধাবঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে মানুষ। আগামীতে এদের নিয়েও ভাবতে হবে। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। এ আনন্দ আর খুশি সবার মাঝে ভাগ করে দিতে পারলে পরিপূর্ণ হবে ঈদ


তখন বয়স আর কতো? আট, দশ কিংবা এগার। চোখে স্বপ্ন। মনে আনন্দ। ঈদ বলে কথা। ঈদের ক’দিন আগে থেকেই কঠিন অপেক্ষা। একদিন নয় যেন এক মাস। এক মুহূর্তও তর সইছে না। ঈদ কেন আসছে না? রোজার ঈদের বাড়তি আকর্ষণ থাকে চাঁদ দেখা। ঈদের এই চাঁদ নিজ চোখে দেখতে হবে। এরপর বিজয়ের বেশে এসে বলতে হবে সবাইকে- আমি ঈদের চাঁদ দেখেছি। মুখে যে তৃপ্তি, চাঁদ দেখার তৃপ্তি। আর এ চাঁদ দেখার জন্য ইফতারের পরপরই দৌড় বাড়ির পাশের সড়কে। এ সড়ক জুড়েই মানুষের চাঁদ খোঁজার দৃশ্য। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার দিয়ে উঠে। ওই যে চাঁদ। হালকার উপর একটা বাঁকা টান। একে একে সবাই দেখে নেয়। খুবই অল্প সময় থাকে এ চাঁদ। এরপর মিইয়ে যায়। চাঁদ দেখা গেছে মানে কাল ঈদ। আবার এমনও হয় চাঁদ দেখা যায়নি। মানে আরও একটি রোজা। এরপর ঈদ। এই ঈদের দিনকে ঘিরে কতো যে পরিকল্পনা। ভাইবোনরা মিলে আগের রাতে হাতে মেহেদি দেয়ার আসর বসতো। মেহেদি পাতা বেটে তা ব্যবহার করা হতো। এখনকার মতো পেকেট মেহেদি তখন ছিল না। কল্পনাও করা যায়নি-একদিন মেহেদি প্রবেশ করবে প্লাস্টিকের প্যাকেটে। দোকান থেকে কিনে এনে তা মুহূর্তেই হাত রাঙাবে। এ যুগে এসে এটাই হচ্ছে।  ঈদে নতুন জামা সে সময় ছিল। এখনো আছে। বাবা ঈদের আগে আমাদের নিয়ে যেতেন মার্কেটে। পছন্দমতো শার্ট, পাঞ্জাবি, জুতা কিনে দিতেন। মহা আনন্দে সেসব নিয়ে বাসায় ফিরতাম। ঈদ পর্যন্ত প্রতিদিন কয়েকবার জামাগুলো খুলে খুলে দেখতাম। কিন্তু পরতে পারতাম না। পরতাম না। তাহলে যে কাপড় পুরান হয়ে যাবে। কি যে অপেক্ষা ঈদের সকালের জন্য।

  যা বলছিলাম, কতো যে পরিকল্পনা? কখন নানী বাড়ি যাবো। কখন কোন বন্ধুর বড়ি যাবো। দেখতাম মা চাঁদ রাতে জেগে জেগে পিঠা বানাতেন। তেলের পিঠা। পায়েস। সেমাই। আরও কতো কি? মায়ের হাতের সেই তেলের পিঠা খাওয়া হয় না বহুদিন। এখনো তেলের পিঠা খাই বিভিন্ন সময়ে। তবে মায়ের হাতের বানানো পিঠার মতো হয় না। সত্যিই মা’র হাতে জাদু ছিল। ওই জাদু মায়ের হাতের রান্নাকে বানিয়ে দিতো অনন্য। জানি সবার মা’র বেলাই এমনটা হয়। ঈদের দিন সকালে মা আমাদের ভাইবোনদের তার বানানো পিঠা, পায়েস খাইয়ে শান্তি পেতেন।  কিন্তু সবার আগে ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতে যেতাম। নিজেদের বড় পুকুরে গোসল করার উৎসব হতো। কার আগে কে গোসল করবে। কার আগে কে সাজবে। নতুন পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়ে নিতাম। এরপর পাশের গ্রামের ঈদগাহে ছুটে চলা। গ্রামীণ সড়ক ধরে সব রাস্তার স্রোত গিয়ে মিশে যেতো ঈদগাহ মাঠে। ওই মাঠে আশপাশের বেশক’টি গ্রামের মানুষ ঈদের জামাতে অংশ নিতেন। নামাজ শেষে সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যেতেন। সবার চোখ মাঠের শেষ প্রান্তে। কতো মানুষ হয়েছে নামাজে সেটা দেখা।

 এভাবে নামাজ শেষে মাঠের মধ্যে শুরু হতো কোলাকুলি। এ যেন মহা আনন্দের এক রত্তি প্রকাশ। এরপর ফেরার পালা। সড়কে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সবাই ছুটছে বাড়ির দিকে। এ দৃশ্য এখনো আছে। তবে এখন কয়েক গ্রামের লোক একসঙ্গে ঈদের জামাত পড়ে না। গ্রামে গ্রামে এখন ঈদগাহ তৈরি হয়েছে। এতে ঈদের নামাজের সেই আমেজে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। নামাজ শেষে প্রথমে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম। সালামের পর সালামির জন্য অপেক্ষা। বাবাও এ ঈদের দিনের জন্য নতুন টাকা সংগ্রহ করতেন। আমাদের দিতেন। পাড়ার অন্যসব শিশুরা আসতো সালাম করতে, তাদেরও দিতেন। তেমন আমরাও সালাম করতে ছুটে চলতাম এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। সঙ্গে চলতো সালামি সংগ্রহ। নানী বাড়ি যেতাম এক সময়। একই গ্রামে নানী বাড়ি হওয়ায় ছুটে যেতাম সেখানে। আর নানী নীরবে অপেক্ষা করতেন আমাদের জন্য। সবাই নানা বাড়ি বললেও আমরা বলতাম নানী বাড়ি। কারণ আমাদের জন্মের আগে নানা মারা যান। আর আমরা বুঝতে পারার পর থেকে নানীকেই দেখে আসছি। তাই নানী বাড়ি হিসেবেই পরিচিত ছিল আমাদের কাছে। আমাদের নানী বাড়ি ছিল আমাদের প্রাণ। দুধ, দই আর মাঠার অভাব ছিল না। গোয়াল ভরা গরু দেখেছি। ধান কাটার মৌসুমে চলতো এক যজ্ঞ। ভিন জেলা থেকে আসতো ৩০ থেকে ৪০ জন কামলা।

 তারা মাসব্যাপী থেকে ধান কেটে মাড়াই করতেন। এসবই এখন স্মৃতি।  শিশু-কিশোরদের ঈদের বিনোদন বলতে সেমাই খাওয়া, পিঠা খাওয়া আর সালামি সংগ্রহ করা। এক টাকা, দুই টাকা করতে করতে অনেক টাকা জমা হতো। এ টাকা নিয়ে হতো আরেক পরিকল্পনা। আর গ্রামের মা-বোনদের একটি বিনোদন ছিল বিটিভিতে ঈদের দিন সিনেমা দেখা। এ সিনেমা দেখার জন্য সময়ের আগে সব কাজ সেরে ফেলতেন মা- বোনেরা। তবে সে সময় এখনকার মতো ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। রঙিন টিভি  তো ছিলই না। সাদাকালো টিভি। কোন মহল্লায় এক কিংবা দুটি বাড়িতে টিভি ছিল। এ টিভি চলতো বিরাট লম্বা বাঁশের উপর এন্টিনা টানানোর পর। না হলে ঝিরঝির করতো টেলিভিশন। দেখা গেছে, এমন ঝিরঝির করলে কেউ একজন এসে এন্টিনা ফিট করা বাঁশকে ঝাঁকুনি দিতেন। এক ঈদে বিকালের দিকে সিনেমা চলাকালীন সময়ে আমাদের মহল্লায় প্রবেশ করেছি। দেখি প্রতিটি বাড়িতে সুনশান নীরবতা। একটু এগিয়ে এসে দেখলাম এক কাকার বাড়ি থেকে ভেসে আসছে টেলিভিশনের শব্দ। টিভি ঘরের ভেতরে চলছে। দর্শকের বেশির ভাগই মহল্লার নারীরা। দিনের বেলা বিদায় দরজা- জানালা বন্ধ করে টিভি দেখা হচ্ছে। 

একটু এগিয়ে যেতে দেখি মহিলাদের কান্নার শব্দ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। নায়ক শেষ পর্যন্ত মারা যাওয়ায় তাদের এ কান্না আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আসলে গ্রামীণ নারীরা টিভির এ সিনেমা দেখে নিজেদের এর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। তাদের ধারণা এসবই বাস্তব। আসলে সিনেমা যে সিনেমা- এটা তাদের বুঝানো কঠিন হতো।  আজকের ঈদ যখন দেখি বারবিকিউ পার্টি, লং ড্রাইভ আরও কতো কি? এ যুগের সঙ্গে সে যুগের পার্থক্য বেড়েছে অনেক। আগে ঈদের নামাজ পড়েই যুবকরা ছুটতো সিনেমা হলে। এখন দেখা যায় ট্রাক ভাড়া করে সাউন্ড বক্স বসিয়ে, ভুভুজেলা ফুঁকিয়ে নৃত্য করতে করতে ঘুরে বেড়ানো। সবই হলো ঈদের আনন্দ প্রকাশ। আর এই আনন্দ স্বজনদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শহর থেকে গ্রামে ছুটে যাওয়ার যে আশঙ্কা তা বুঝা যায় সড়ক-মহাসড়কে। তীব্র যানজট পেরিয়ে কেউ বাসে, কেউ বা নিজের গাড়িতে, কেউ আবার প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে ছুটে নিজ গ্রামে, বাড়িতে। ঈদে গ্রাম জেগে উঠে। দেখা হয় স্বজন, পুরনো সব বন্ধুদের সঙ্গে। আড্ডা চলে, চলে খাবার দাবার। এই ঈদ আনন্দ সবাইকে এক জায়গায় করে দেয়। কেউ কেউ এখন দেশের বাইরে ঈদ উদ্‌যাপনে ছুটে যান। সপরিবারে ঈদ উদ্‌যাপন শেষে দেশে ফিরে আসেন। ঈদকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি পরিকল্পনা থাকে শিশু- কিশোরদের। এরাই ঈদ উদ্‌যাপনে মেতে উঠেন। 

আবার বর্তমান সময়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানোর পাশাপাশি কাপড় পাঠানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামাই, নাতি, নাতনি, বিয়াই, বিয়াইন, পুত্রা, জিয়রি সবাইকে দিতে হয় নতুন কাপড়। এটা আবার কারও ওপর এক অত্যাচার হয়ে দেখা দেয়। যাদের অফুরন্ত টাকা আছে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের বেলায় এটা কঠিন। তবুও সমাজ রক্ষার্থে দিতে হয়। কেউ কেউ ঋণ করেও এসব দেয়। এমন তথ্যও রয়েছে। সবচেয়ে ভালো এ প্রথা ভেঙে দেয়া। এ নিয়ম ভেঙে দেয়া। এটা কি সম্ভব?  এত আনন্দের মাঝেও নিরানন্দ ঈদ কাটে দেশের একটি অংশের মানুষের। এরা জোগাড় করতে পারে না নতুন কাপড়। সেমাই খাবে এমন অবস্থাও নেই কারও কারও। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদ আসে নিরানন্দ হয়েই। সেমাই-চিনির বদলে মুখে উঠে পান্তা ভাত আর মরিচ পুড়া। এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে দেশে। অবশ্য এসব মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগ করে দিতে স্থানীয় ও সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ বর্তমান সময়ে চোখে পড়ে। যুবকরা নিজেরা চাঁদা দিয়ে সেমাই, চিনি, পোলাও চালসহ প্রয়োজনীয় আরও সামগ্রী এক করে প্যাকেট তৈরি করে। পরে লিস্ট করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের কিছু এলাকায় এ সুবিধাবঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে মানুষ। আগামীতে এদের নিয়েও ভাবতে হবে। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। এ আনন্দ আর খুশি সবার মাঝে ভাগ করে দিতে পারলে পরিপূর্ণ হবে ঈদ।  

পাঠকের মতামত

অসাধারণ নিবন্ধ, কেবল চরের গরীব মানুষই নয়, সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবার আছে অনেক।যারা বলতে নারি,সইতে নারী। টাকা যে নেই মানুষের হাতে, তা নয়। তবে কোথাও পাহাড়, কোথাও সমুদ্র। বৈষম্যের ফারাক বড়ো বেশী। আর আমাদের বাজিতপুরের বাষাও নানির বাড়ি।বাহ্ কী চমৎকার মিল।তবে আগের সেই আনন্দ বড্ড ঢাকা পরে গেছে, নিরানন্দের তিমির ঝড়ে। ক্রমেই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর শেষ কোথাই?

হোসেন মাহবুব কামাল
৮ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১:১৮ পূর্বাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status