ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

‘ধার-দেনা করে এসেছি, ঠিকমতো খেতেও দেয় না’

মরিয়ম চম্পা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, শুক্রবার

আজিম, নজরুল, মুজিব এবং ওসমানের জীবনের চিত্রনাট্য প্রায় এক। পেশায় কেউ ভ্যানচালক, গার্মেন্টকর্মী, রং-মিস্ত্রি ও দিনমজুর। উন্নত জীবনের আশায় স্বপ্ন নিয়ে সম্প্রতি পল্টনে অবস্থিত ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের অধীনে ধানসিঁড়ি ওভারসিসের মাধ্যমে সৌদি আরব যান তারা। বিভিন্ন এনজিও, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ করে, শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে কেউ আবার চড়া সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়ে বিদেশে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের। সৌদি আরবের জেদ্দায় বিমানবন্দর সংলগ্ন একটি তিনতলা ভবনে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ বাংলাদেশির সঙ্গে তাদেরও ঠাঁই হয় এই ‘ডাম্পিং সেন্টারে’। সেখানে নেয়ার পর তাদের জিম্মি করে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধাপে মুক্তিপণ নেয়া হয়। মুক্তিপণের টাকা না পেলে তাদেরকে রিয়াদে অবস্থিত ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সারাদিনে খেতে দেয়া হয় এক বেলা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সম্প্রতি মেহেরপুর থেকে যাওয়া ভ্যানচালক আজিম বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান।

বিজ্ঞাপন
যেটা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

মো. আজিম উদ্দিন। বয়স ৩৫ বছর। গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর। পেশায় ভ্যানচালক। স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে চার সদস্যের পরিবার। আড়াই মাস আগে বিভিন্ন সমিতি-এনজিও থেকে লোন তুলে এবং ধার করা আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ধানসিঁড়ি ওভারসিসের মাধ্যমে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরব যান। সেখানে যাওয়ার পর তাকে জেদ্দার এই ডাম্পিং ক্যাম্পে রাখা হয়। দীর্ঘ দুই মাস ক্যাম্পের বন্দি জীবনে অনেক ঘটনার সাক্ষী তিনি। জেদ্দার আল ফায়সালিয়া এলাকার এই বন্দিশালা থেকে এক ভিডিও বার্তায় আজিম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার বাড়ি মেহেরপুর। আমি একটি এজেন্সির সহায়তার সৌদি আরব এসেছি। এখানে আসার পর আমাদের কোনো কাজ না দিয়ে বিমানবন্দর সংলগ্ন একটি ভবনে বন্দি করে রেখেছে। এজেন্সিকে ইকামার কথা বললে, বলে টাকা দাও। যদি কাজের কথা বলি তাহলে বলে, দেশ থেকে টাকা আনো। দেশ থেকে ধার-দেনা করে এসেছি। এখন অবশিষ্ট কিছু নেই আমাদের। পরিবার খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। নতুন করে টাকা পাঠাবে কীভাবে। তিনি বলেন, আমাদের এই বন্দিশালায় ৩ থেকে ৪শ’ লোক রয়েছে। এখানে ঠিকমতো খেতে দেয় না। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে আজিমের ভাই বলেন, ওখানে আড়াই মাস হয়ে গেলেও ভাইয়ের কোনো কাজের ব্যবস্থা করেনি। নানা ভাবে তাদের ওপর নির্যাতন এবং অত্যাচার করে। সম্প্রতি ভাইয়ের কাছে দেশ থেকে টাকা দাবি করে। তিনি দেশে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। দেশে জমিজমা সব বিক্রি করে বিদেশ গিয়েছেন। এখন তার জন্য আমরা টাকা পাঠাবো কীভাবে। তার স্ত্রী খেতে না পেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে তার বাবার বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

মো. নজরুল ইসলাম। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। তার স্ত্রীও একই গার্মেন্টে চাকরি করেন। আড়াই মাস আগে একটি অনলাইনের মাধ্যমে রিক্যাব ইন্টারন্যাশনালের বিষয়ে জানতে পারেন। এরপর রাজধানীর পল্টনে তাদের অফিসে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মোশায়েদ হাসানের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তিনি নজরুলকে বলেন, সৌদিতে যাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে ইকামা এবং তিন দিনের মধ্যে ভালো বেতনে কফিশপ কিংবা কোনো রেস্তরাঁয় কাজের ব্যবস্থা করা হবে। প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ করে তিন মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কোনো কাজ দেয়া হয়নি তাকে। স্ত্রী পারভীন আক্তার বলেন, আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ। আমি গার্মেন্টে চাকরি করে টাকা পাঠালে সে খেতে পায়। না পাঠালে না খেয়ে থাকে। বর্তমানে ওই বন্দিশালা থেকে বের হতে চাইলে রিক্যাবের নিয়োগকৃত দালাল সৌদি আরবে নাসির নামে এক ব্যক্তি ৩৫ হাজার টাকা দাবি করে। পরে তাদের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ করতে কানের দুল, গলার স্বর্ণের চেইন বিক্রি করে দেই। এখন তিনি পরিচিত একজন বাংলাদেশির কাছে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজের ব্যবস্থা হয়নি। 

আরেক ভুক্তভোগী মো. মুজিবর রহমান। গ্রামের বাড়ি জামালপুর। দেশে রং-মিস্ত্রির কাজ করতেন। মোশায়েদ হাসানের মাধ্যমে গত ৫ই জুলাই প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব যান। সেখানে যাওয়ার পর জেদ্দার এই বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। কোনো কাজ দেয়া হয়নি। এই বন্দিশালায় ২৪ ঘণ্টা তালা মেরে রাখা হতো। ভুক্তভোগী মুজিবরের পারিবারিক সূত্র জানায়, মুজিবর সেখানে যাওয়ার পর তাকে খেতে না দেয়াসহ বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করতো। উসমান নামে এক বাংলাদেশি তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে জেদ্দা থেকে রিয়াদের বন্দিশালায় নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বর্তমানে তার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানেন না মুজিবর। এই বন্দিশালায় চলতি বছরে এক বাংলাদেশি তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। এর আগে আরেক বাংলাদেশি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে দেশে ফেরত আসেন। মুজিবরের এক বোন বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাস, শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ভাইকে মুক্ত করার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। অনেক চেষ্টার পরে সম্প্রতি তাকে এই বন্দিশালা থেকে সৌদি ২ হাজার মুদ্রা দিয়ে তাকে বের করে নিয়ে আসেন। তাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে সম্প্রতি ধানসিঁড়ির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নামমাত্র অর্থ প্রদান করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের ১৯শে মে মানব পাচার ও জিম্মির মাধ্যমে অর্থ আদায় করার অভিযোগে ধানসিঁড়ি ওভারসিসের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মোশায়েদ হাসানসহ চক্রের পাঁচ হোতাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তারা হলেন- মোশায়েদ হাসান, গোলাম আজম সৈকত, মেহেদী হাসান শান্ত, মোহসিন হোসেন ও নাইফ উদ্দিন রুদ্র। গত ১৮ই মে রাতে রাজধানীর পল্টন থেকে এই পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য প্রমাণ পাওয়ায় পল্টন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পল্টন থানায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ জন এবং সৌদি আরবে অবস্থানরত এই চক্রের আরেক সদস্য মো. নাসির উদ্দিনসহ মোট ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

 মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, পলি আক্তার লিজার স্বামী কামরুল আহসান এবং সঙ্গে আরও পাঁচ জনকে কাজের চুক্তিতে সৌদি আরবে পাঠায় ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যাওয়ার সময় জোর করে তাদের ব্যাগে ৪-৫ কেজি জর্দা দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটির লোকজন। কিন্তু সৌদি আরবে যে কোম্পানির জন্য পাঠানো হয়, তারা তাদের রিসিভ করেনি। চক্রের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন রিসিভ করে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যান। এরপর দীর্ঘদিন সেই ক্যাম্পে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। সেই সঙ্গে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। স্বামীকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে কিছু টাকাও দেন পলি আক্তার। এরপর র‌্যাব-৩ এ অভিযোগ করেন মামলার বাদী পলি আক্তার। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের আটক করে। এ বিষয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ভুক্তভাগী পরিবারগুলো লিখিত অভিযোগ করলে অভিযুক্ত মানব পাচার চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতিপূর্বে র‌্যাব মানব পাচারের অভিযোগে বিভিন্ন চক্রকে গ্রেপ্তার শেষে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করেছেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্রিয়েটিভ গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মোশায়েদ হাসান মানবজমিনকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। সৌদিতে যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে এখান থেকে শ্রমিক পাঠানো হয় অনেক সময় সেই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে শ্রমিকদের নতুন করে কাজের ব্যবস্থা করতে কিছুটা সময় লাগে। বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাদের পাঠানো হয়েছে তাদের প্রত্যেককে ধীরে ধীরে কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের বন্দি করে অর্থ আদায়ের বিষয়ে বলেন, কোনো শ্রমিককে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের বিষয়টি মিথ্যা। আমরা তাদের কারও কাছে অর্থ দাবি করিনি।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status