ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কাওরান বাজারের চিঠি

পয়েন্ট অব নো রিটার্নে রাজনীতি?

সাজেদুল হক
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

দুই পক্ষই অনড়। যদিও শক্তির বিবেচনায় বিরোধীরা দুর্বল। এক দশকের বেশি সময় ধরে তারা আন্দোলনের চেষ্টা করছে। কখনও সহিংসতায় অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার এবং সরকারি দলের অলআউট অ্যাকশনের সামনে টিকতে পারেনি। হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। তাদের আমলেও যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি এমন নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনীতি এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকেই যাচ্ছে। কোনো পক্ষই কোনো ছাড় দেবে না। যারা টেকার টিকে থাকবে।

বিজ্ঞাপন
প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা সম্পর্কে হ্যামলেটেরই উক্তি, ‘করবো কি করবো না, প্রশ্ন হলো তাই, বিরূপ ভাগ্যের শরাঘাত সয়ে যাওয়া, নাকি দুঃখ সমুদ্রের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ কিংবা বিরোধিতা করে ওদের বিলীন করা, কোনটা মহত্তর।’


নাটক এগিয়ে চলে আপন গতিতে। হ্যামলেটের হাতে খুন। মৃত্যু হয় প্রেমিকা ওফেলিয়ারের। এবং সব শেষে আবার মৃত্যু। এনকাউন্টারের শব্দ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। হ্যামলেট নাটকে মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে উপস্থাপক বলেন, ‘মৃত্যুর মিছিল চলছে, মারা যাচ্ছে মানুষ, আর তোমরা শুধুই নীরব।’ সাড়ে নয় বছর আগে  আমারই  লেখা এই  নিবন্ধ বৃহস্পতিবার রাত থেকে খুব মনে পড়ছিল। মূলত রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পটভূমিতে লেখা। সে সময়কার রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মৃত্যুর ঘটনাও এসেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে  মৃত্যুর মিছিল কি আবার ফিরে আসছে? ভোলা, নারায়ণগঞ্জের পর মুন্সীগঞ্জ। ফের গুলি চললো মিছিলে। এবার মারা গেলেন যুবদল কর্মী। শহিদুল ইসলাম শাওন তখনও মারা যাননি। আমাদের রিপোর্টার ফাহিমা আক্তার সুমির রিপোর্ট পড়ছিলাম। পরিবারের বড় সন্তান শাওন। চালাতেন অটোরিকশা। এক বছরের একটি ছেলে রয়েছে তার। ঘটনার দিন দুপুরে বের হয়ে যোগ দেন বিএনপি’র মিছিলে। তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। লাশ হয়ে ফিরেছেন বাড়ি। পরিবারের অভিযোগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আধাঘণ্টা এম্বুলেন্স আটকে রেখেছিল। যে কারণে সময়মতো তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা যায়নি। শাওনের ভাই সোহানুর রহমান বলেন, একজন গুলিবিদ্ধ মানুষকে আধা ঘণ্টা আটকে রাখলে কতটুকু রক্তক্ষরণ হয়। আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখলে ভাই সেখানেই মারা যেতো। আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয় তাহলে তার একটা বাচ্চা ও স্ত্রী আছে তাদের কি হবে? বাচ্চাটা বাবা হারা হয়ে এতিম হয়ে যাবে। তার স্ত্রী স্বামী হারা হবে, আমরা ভাই হারাবো। এই কষ্ট কাউকে বলা যায় না। আমাদের কেমন লাগছে তা আমরা জানি। তার ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্ যেন ভাইকে সুস্থ করে দেন। বাচ্চাটা এখনও তার বাবাকে ভালো করে চিনতেও পারলো না।

শাওনের ভাইয়ের প্রার্থনা কবুল হয়নি। সেটা এখন সবারই জানা। কবুল হয়নি তার পিতার প্রার্থনাও। বাবা-মা তার সন্তান হারালেন, ভাই হারালেন প্রিয় ভাইকে। সবচেয়ে বড় কথা, এক বছর বয়সেই বাবা হারা হয়ে গেল একটি শিশু। অনিশ্চিত হয়ে গেল তার পুরো জীবন। দুঃখজনক হলো এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো কথা হবে না। সাধারণ, গরিব একজন মানুষের মৃত্যুতে, বিরোধী রাজনীতিতে যুক্ত এক কর্মীর মৃত্যুতে কারই বা কি আসে যায়! এ সমাজে, রাষ্ট্রে বিভক্তি ক্রমশ আরও বাড়ছে। ঈদের পর আন্দোলন। এ নিয়ে কত ট্রল হলো! কিন্তু আন্দোলনে যে এ প্রাণহানি, একটি পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি এর দায় কে নিবে?

আপনি যদি টকশো দেখে থাকেন, পত্রিকায় কলাম পড়ে থাকেন কিংবা নেতাদের কথা শুনে থাকেন, তবে একটি পরিষ্কার বার্তা পাবেন। সেটি হচ্ছে, জোর যার মুল্লুক তার। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও একবার তলোয়ার-রাইফেলের কথা বলেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।  মাঝে টকশো’তে ঢাকার এক সম্পাদকের কথা শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে। তার মেসেজও ছিল লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। বিএনপি কেন আন্দোলন করতে পারে না? যা করার আন্দোলন করেই করতে হবে! তো আন্দোলন মানে কি? মারামারি? আগুন? রক্তপাত? মৃত্যু? যে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজও এখন পর্যন্ত প্রাচীন এই চিন্তায় আবদ্ধ সেখানে পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব।

ব্যালট পৃথিবীতে কেন এলো? প্রধানত ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের জন্য। রাজা আসবে, রাজা যাবে কিন্তু ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে কোনো রক্তপাত হবে না, কাটাকাটি হবে না। জনগণই তাদের নেতা নির্বাচন করবে। হ্যাঁ, গণতন্ত্রের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এখানে সংখ্যালঘুর সঠিক মতামতও গুরুত্ব পায় না। কিন্তু এ দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশে দেশে গণতন্ত্র এগিয়ে গেছে। আমরাও বলছি, আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অতীতের লেখার পুনরাবৃত্তি করে বলি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনেও এই ব্যালটের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এখন এখানে ব্যালট হয়ে পড়েছে গৌণ।  

রাজনীতির ময়দানে স্লোগানটির জনক শামীম ওসমান। পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে তা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমান, রুমীন ফারহানা। সবার মুখে এক কথা। খেলা হবে। দৃশ্যপট পরিষ্কার। এ খেলা এরইমধ্যে মাঠে গড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো এতে মারা যাচ্ছে মানুষ, গুলি খাচ্ছে মানুষ, আহত হচ্ছে মানুষ। আহত হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। নেতারা বলছেন, ফয়সালা হবে রাজপথে। কিন্তু রাজপথে ফয়সালা কি গণতন্ত্রের মেকানিজম।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্ট্যাটাসকো চলছে। এমনিতে যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদতো হতেই পারে। সংঘাতও প্রাচীন কাল থেকে মানুষের সঙ্গী। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান সংকট নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে। নির্বাচন এখানে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গায়েবি ভোট, গায়েবি এমপি কম দেখিনি আমরা। ক’দিন আগে এক সংসদ সদস্যতো নিজেই দাবি করলেন, জনগণ তাকে এমপি বানায়নি। যাক সে কথা। নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাংলাদেশে নিজস্ব একটা পদ্ধতি তৈরি করেছিল। ১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বর জামায়াত অনির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে ‘তত্ত্বাধায়ক’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে (সংগ্রাম, ৮ই ডিসেম্বর ১৯৮০)। ১৯৮৩ সালের ২০শে নভেম্বর এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানে জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন এক জনসভায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ফর্মুলা দিয়েছিল (সংগ্রাম, ২১ নভেম্বর ১৯৮৩)। (সূত্র: তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দুই ব্যক্তির ছায়া: মিজানুর রহমান খান, প্রতিচিন্তা)

এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হন। পরে বিএনপি’র আমলে মাগুরার বিতর্কিত নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে ফের জোরালো করে। বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাতেই হয়েছে এবং এসব নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। পরে সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়। তবে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সব বিচারপতিই গুরুত্ব আরোপ করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর দু’টি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার যদিও বিরোধী দল এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল সে অর্থে কখনও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বিএনপি। বিরোধী শিবিরের অন্যান্য দলকেও তারা আন্দোলনে টানার চেষ্টা করছে। বিএনপি কয়েক সপ্তাহ ধরে মাঠে বিক্ষোভ করে আসছে। আর এ কর্মসূচি ঘিরেই তৈরি হয়েছে সংঘাত। কোথাও সরকারি দল, কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে। রক্তাক্ত হয়েছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা । লাশ পড়েছে ভোলা, নারায়ণগঞ্জ সবশেষ মুন্সীগঞ্জে।

দুই পক্ষই অনড়। যদিও শক্তির বিবেচনায় বিরোধীরা দুর্বল। এক দশকের বেশি সময় ধরে তারা আন্দোলনের চেষ্টা করছে। কখনও সহিংসতায় অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার এবং সরকারি দলের অলআউট অ্যাকশনের সামনে টিকতে পারেনি। হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। তাদের আমলেও যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি এমন নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনীতি এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকেই যাচ্ছে। কোনো পক্ষই কোনো ছাড় দেবে না। যারা টেকার টিকে থাকবে। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা সম্পর্কে হ্যামলেটেরই উক্তি, ‘করবো কি করবো না, প্রশ্ন হলো তাই, বিরূপ ভাগ্যের শরাঘাত সয়ে যাওয়া, নাকি দুঃখ সমুদ্রের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ কিংবা বিরোধিতা করে ওদের বিলীন করা, কোনটা মহত্তর।’
কিন্তু রাজনীতিতো যুদ্ধ নয়, বিনাশের খেলাও নয়। খেলা হতে পারে, তবে গণতন্ত্রে সেটা হতে হবে ব্যালটে। বলা হয়, পলিটিক্স ইজ আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। তাহলে কেন এতো সংঘাত, লড়াই। ক্ষমতার জন্য? সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটি কি ক্ষমতা? কিন্তু রাজনীতিতে সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটির নামতো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে সংঘাত, রক্তপাত জায়েজ নয়। যদিও এ ভূমে তাই হয়ে আসছে। মুখে গণতন্ত্র, মনে লাঠিতন্ত্র। গণতন্ত্রে ছাড় দিতে হয়, ছেড়ে দিতে হয়। দুই শিবিরের নেতাদেরই তা  বোঝা প্রয়োজন।
 

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন
[email protected]

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status