ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কাওরান বাজারের চিঠি

ইসি’র গায়েবি রিপোর্ট, গায়েবি এমপি এবং জয়া আহসান

সাজেদুল হক
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

গায়েবি এমপি এবং প্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের বক্তব্য নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম ক’দিন আগে। নানা কারণে এগোয়নি। কখনো কখনো এমন হয়। কী বোর্ডে আঙ্গুল চলতে চায় না। ভাবছিলাম ইস্যুগুলো কী পুরনো হয়ে গেছে। মুহূর্তেই মনে হলো না! ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো ইস্যুতো আসলে কখনো পুরনো হবার নয়। লেখা এগুচ্ছিল। এরইমধ্যে গতকাল শুক্রবার প্রথম আলো’র প্রধান খবরে নজর পড়লো। গায়েবি এমপির পর নির্বাচন কমিশনেরও গায়েবি রিপোর্ট! ভাবা যায়! সব সম্ভবের দেশে কোনো কিছুই অবশ্য অসম্ভব নয়! কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শেরে বাংলা নগরে এক ধরনের ইতিবাচক পরিবেশ দেখা যায়। অন্তত মুখের কথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনাররা অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে থাকেন।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু মুখের এবং মনের কথা কি এক? এ নিয়ে সংশয় ছিল, ছিল নানা আলোচনা। নির্বাচন কমিশনকে প্রথম বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় ইভিএম নিয়ে। বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি স্পষ্টতই ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা দাবি করে, এটি ভোট কারচুপির মেশিন। রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশই ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান প্রকাশ করেছে। 

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবশ্য তিনশ’ আসনেই ইভিএম চাওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। সবশেষে ‘রায়’ ঘোষণা করে আউয়াল কমিশন। জানিয়ে দেয়, দেড়শ’ আসনে ইভিএম, দেড়শ’ আসনে ব্যালটে ভোট হবে। কমিশন, এটাও জানায় যে, এটি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরে আবার বলা হয়, সব দল একমত হলে ভোট হবে ব্যালটে। এসব নিয়ে যখন বিতর্ক চলছিল তখন রীতিমতো বোমা ফাটালো প্রথম আলো। পত্রিকাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘ইসির সঙ্গে জুলাই মাসে সংলাপে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছিল মাত্র চারটি দল। কিন্তু কর্মপরিকল্পনায় ইসি বলেছে, পক্ষে ১৭টি দল। ইসি বলছে, জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে অংশ নেয়া ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে। এরমধ্যে ১৭টি দল কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে ছিল। যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলছে ইসি, তাদের মধ্যে তিনটি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে। একটি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দেয়নি। ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা বলেছে।’’  এই রিপোর্টের পর পুরো নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এমনিতে নির্বাচন কমিশনের চেহারা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। ইভিএম নিয়ে তাদের রিপোর্টের মধ্যদিয়ে সবকিছু অনেকটাই খোলাসা হয়ে গেল। মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। ইভিএম নিয়ে এর আগে  নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খানের একটি বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘ইভিএমে চ্যালেঞ্জ একটাই। 

 

 

এ ছাড়া আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। একটা ডাকাত-সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান। দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’’ কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এখনকার অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে সেটিও প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়। একই সময়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর দেয়া একটি ভাষণও ভাইরাল হয়। তার কথা ছিল, ইভিএম কেন্দ্রে চাপ দেয়ার জন্য তার লোক থাকবে। ইভিএম না থাকলে যেভাবে পারেন ভোট মেরে দিতেন বলেও জানান তিনি। ভদ্রলোকের নাম মো. আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন। ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনের সংসদ সদস্য। সম্প্রতি তার একটি বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেটাও আসলে অদ্ভুত। এ এক অন্যরকম সময়। মানুষ সত্য বললে তার বক্তব্য বড় জোর ভাইরাল হয়। প্রশংসা করেন কম লোকই। আবার অনেকে সমালোচনাও করেন। সরকার দলীয় এ সংসদ সদস্য কী বলেছেন, তা নিশ্চয় আপনারা জেনে গেছেন। তবুও আরও একবার আমরা দেখে আসি। সংসদ সদস্য তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমারে ভোট দিয়া কোনোদিন পাস করাইতে পারেন নাই। প্রথমবার আল্লাহ দিছে, দ্বিতীয়বার খালি গেছুইন আর আইছুইন। খুব কষ্ট হইছে না। খালি গেছুইন আর আইছুইন, যতবার পারছুইন দিছুইন। এইগুলারে ভোট মনে করি না আমি।’ নান্দাইলের  মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের কালিয়াপাড়া বাজারে ওয়ার্ড যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

সংসদ সদস্য বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি খোদা আমাকে এমপি বানিয়েছেন, আপনারা (সভায় উপস্থিত জনতা) না। কথা সত্য না মিথ্যা? পেছনের মানুষগুলো কি বোবা? আমি প্রত্যেকটা মানুষের কাছে জবাব চাই। আমাকে আপনারা ভোট দেন নাই। আমি আপনাদের কাছে ভোট চাইতে আসি নাই।’ সূত্র: প্রথম আলো প্রশ্ন হচ্ছে আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন কি মিথ্যা কিছু বলেছেন। যদিও অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী অবাধ নির্বাচনের কথা বলে থাকেন। তারা নাকি সুষ্ঠু ভোট দেখেছেন। বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাতো আতশি কাঁচ দিয়েও অনিয়ম খুঁজে পাননি। রাতের ভোট দেখেননি বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও। প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (নূরুল হুদা কমিশন) মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আজও রূপকার্থে কিছু কথা বলতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না।’’ আইসিইউতে থাকা নির্বাচন ব্যবস্থার কেবিনে আসার কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যায়? দুঃখজনক হলেও এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, ‘না’। যদিও মানবজমিনেই গতকাল প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, এবার সাজানো নির্বাচন করা সহজ হবে না। কিন্তু এসব যে কথার কথা তাতো অনেকটাই পরিষ্কার। 

 

 

জয়া আহসান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

সম্প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের একটি সংবাদ সম্মেলন অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। যেখানে তারা চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন। এ নিয়ে এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত খবর বেরিয়েছে। হাওয়া সিনেমা নিয়ে মামলাকারীর বিরুদ্ধে অ্যাকশনও নেয়া হয়েছে। তবে আমার দৃষ্টি কেড়েছে অভিনেত্রী জয়া আহসানের দেয়া বক্তব্যটি। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘‘চলচ্চিত্রের ওপর কখনো কখনো প্রশাসনিক চাপ, কখনো অদৃশ্য চাপ এগুলো বন্ধ করতে হবে। শুধু চলচ্চিত্র নয়। যেকোনো শিল্প মাধ্যম। তাহলে আমরা কী লেখালেখি করবো না, আমরা থিয়েটার করবো না।’’ তিনি আরও বলেন, পয়লা জুলাই হোলি আর্টিজানে যে হামলা, সেটা নিয়ে প্রতিবছর  লেখা হয়। দিনটায় আমার জন্মদিন হলেও আমি সেদিন জন্মদিন পালন করতে পারি না। বিভীষিকাময় দিনটা একটা কালো দিন হয়ে আছে। এ নিয়ে লিখলে, গল্প বললে, ছবি বানালে কি অসুবিধা? কাঁটাবনের পশুপাখির দোকানগুলোতে প্রাণীগুলোর সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, সেটি কি কারও চোখে পড়ে না? কেবল গল্প বললেই সমস্যা? শুধু সৌন্দর্য্যই নয়, জয়া আহসান নানাদিক থেকেই অনন্য। বলেনও সুন্দর। সীমানা পেরিয়ে কলকাতাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। প্রাণী অধিকারের পক্ষেও সরব তিনি। ঢাকায় কুকুর নিধনের বিরুদ্ধে নিয়েছিলেন শক্ত অবস্থান। আদালতে আইনি লড়াইও চালান। শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে দেরিতে হলেও মুখ খুলেছেন শিল্পীরা। তাদের এ অবস্থান অবশ্যই প্রশংসনীয়। স্বাধীনতা ছাড়াতো আসলেই কোনো শিল্প চর্চাই হয় না। কিন্তু শিল্পীরা হয়তো তাদের বক্তব্যকে আরও বিস্তৃত করতে পারতেন। শুধু চলচ্চিত্র বা নাটক বা বই লেখা কেন? চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সর্বত্রই প্রয়োজন। এ অধিকার সংবিধান বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে। কথা বলার স্বাধীনতা এবং মুক্তির যে আকাঙ্খা জন মিলটন প্রকাশ করে গেছেন তাতো পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের, প্রতিটি কালের জন্যই প্রযোজ্য। 

জয়া আহসান হয়তো বলতে পারেন, আমি তো অধিকারের একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছি, অন্যরা বাকি বিষয় নিয়ে করুক না! তিনি এ কথা বললেও তা অযৌক্তিক হবে না। সব বিষয়ে সবার কাজ করার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু আমরা দেশে দেশে দেখেছি মৌলিক অধিকারের পক্ষে, মানুষের অধিকারের পক্ষে শিল্পীরা সরব হন। তাদের ক্ষমতাসীনদের রোষানলেও পড়তে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষের অধিকারের পক্ষে সরব হতে শিল্পীদের খুব কমই দেখা যায়! গুম হওয়া স্বজনদের ফিরে পেতে প্রায়শই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, নানা স্থানে একদল মানুষকে আহাজারি করতে দেখা যায়। এ দৃশ্য অনেককেই ব্যথিত করে। সরকারের পর সরকার আসে যায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও বাড়তে থাকে। কিন্তু এই নিপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে এ দেশের শিল্পীদের খুব একটা দেখা যায় না!        

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status