নির্বাচিত কলাম
আগামী ১০ বছরেও বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ
জয়ন্ত চক্রবর্তী
(২ বছর আগে) ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার, ১০:৩০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১৭ পূর্বাহ্ন

উগ্র হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী বিজেপি সমর্থকরা আমাকে মাফ করবেন। আমাকে যে কেউ তৃণমূল সমর্থক কলমচি অথবা অনুপ্রাণিত মিডিয়া বলে কটাক্ষ করতে পারেন। কিন্তু, এই কলাম এর উদ্দেশ্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। সেই জায়গা থেকেই লিখতে বাধ্য হচ্ছি যে তৃণমূল কংগ্রেসের গত ১১ বছরের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি সত্ত্বেও এই দলটিই আগামী ১০ বছর বঙ্গ শাসন করবে। তৃণমূলের এক ডাকসাইটে মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে জেলে রয়েছেন। চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এক জেলা সভাপতিও জেলে। কয়লা- বালি-গরু পাচারের কলঙ্কের কালি তৃণমূলের সর্বাঙ্গে। তা সত্ত্বেও এই কথা কী করে লিখছি যে তৃণমূল এই রাজ্যে আগামী ১০ বছর নির্বিঘ্নে রাজপাট চালাবে? আসলে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধিতা পশ্চিমবঙ্গে নেই। আর আছে অন্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবেগ। এই দুয়ের যোগফল তৃণমূলকে নিরঙ্কুশ করছে। সিপিএম নিঃসন্দেহে বিকল্প হওয়ার লক্ষ্যে নিজেদের আন্দোলনমুখী করেছে। তরুণ প্রজন্মকে তুলে এনে নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু চৌত্রিশ বছরের লেগাসি তাদের যেভাবে বিশ্বাসহীন করে তুলেছে তাতে নিরন্তর জনসংযোগ তাদের ১০ বছর পরে আদর্শ বিরোধী বলে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এখন কোনও মতেই নয়। সে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কোটি দুর্নীতি তুলে ধরলেও নয়। দক্ষিণপন্থি কংগ্রেস কার্যত জাতীয় রাজনীতিতেই এক বিলীনপ্রায় দল। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ এই দল জাতীয় সভাপতি নির্বাচনেই টালমাটাল। একটি অঙ্গরাজ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তাদের তৃণমূলের বিকল্প হয়ে ওঠা এখন ভুবনেশ্বর কুমারের সেঞ্চুরি করার মতোই কঠিন। বাকি রইলো বিজেপি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তৃণমূল জমানার এই ১১ বছর রাজত্বে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপিই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও কেন বলছি আগামী ১০ বছর বিজেপি এই রাজ্যে দন্তস্ফুট করতে পারবে না? কারণটা আর কিছু নয়। বিজেপি এখনও এটা বাঙালিকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি যে এই রাজনৈতিক দলটি বাঙালির। গো বলয়ের রাজনীতির ছায়া বিজেপির কায়ায় এত বেশি যে বিজেপিকে এখনও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দিভাষী অবাঙালিদের পার্টি হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসে। যতই মজুমদার- অধিকারী কিংবা ঘোষদের প্রজেক্ট করুক বিজেপি- বঙ্গভাষী এখনও বিজেপিকে নিজেদের পার্টি বলে ভাবতে শেখেনি। তার ওপর বঙ্গ বিজেপির নেতাদের মধ্যে দিল্লির কাছে আসার অলিখিত প্রতিযোগিতাও তাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। অতি সম্প্রতি নবান্ন অভিযানের কথাই ধরুন। তিনটি মিছিল নিয়ে নবান্ন অভিযান করলো বিজেপি। কিন্তু তিন নেতা তিনদিকে। একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি রাহুল সিনহা ও লকেট চট্টোপাধ্যায়কে গাড়িতে নিয়ে পুলিশ ট্রেনিং কলেজের কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করে পুলিশের গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সুকান্ত মজুমদার হাওড়া স্টেশনের অতিথিশালায় রাত্রিবাস করে দলবল নিয়ে নবান্ন অভিমুখী হলেন। মাঝরাস্তায় বিজেপির আর এক নেতা দিলীপ ঘোষ অভিযান শেষ হয়ে গেছে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে উঠে সুকান্ত ঘোষণা করলেন, ওদিকেরটা শেষ হলেও আমাদেরটা হয়নি। দিলীপ ঘোষ অভিযান শুরুর অনেক পড়ে কলেজ স্ট্রিটে এসে বাজার গরম করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন এবং অভিযান শেষ বলে ঘোষণা করে ক্ষান্ত হলেন। তিন নেতার আচরণ যেন অনেকটা ছিল- কে বা আগে প্রাণ করিবে দান গোছের। দল নয়, ব্যক্তি ইমেজ দিল্লির দরবারে তুলে ধরার বিষয়টি এত প্রকট হয় যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ট্রেন ভাড়া করে সমর্থক আনার প্রয়াসটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। নবান্ন অভিযানের তিনদিন পড়েও দেখছি এই অভিযানের নিট ফল যেন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার বলা সেই কথাগুলো- ‘ডোন্ট টাচ মি, ইউ আর ফিমেল অ্যান্ড আই অ্যাম এ মেল’। সোশ্যাল মিডিয়া বলুন, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বলুন সবেতেই এই উবাচ নিয়ে খিল্লি ওড়ানো হচ্ছে। শুভেন্দু অধিকারী যতই বলুন যে মহিলা পুলিশ দিয়ে তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, যতই তিনি কোর্টে যান- সিরিয়াল প্রিয় বাঙালি তাঁর এই উক্তিতে এতটাই আমোদ পেয়েছে যে তাতেই মজে আছে তারা। বিজেপির নবান্ন অভিযান ভাঁড় মে যাক। বামফ্রন্ট নেতারা এই ধরনের অভিযানে কখনোই উপদলে ভাগ হয়ে হাঁটতেন না। বিমান, বুদ্ধ, সুভাষ, শ্যামল, ক্ষিতি, কমল, কান্তি, সুজন, সূর্যকান্তকে আমরা একসঙ্গে হাঁটতে দেখেছি। একসঙ্গে জলকামান কিংবা টিয়ার গ্যাস খেতে দেখেছি। ১৯৯৩ সালের ২২শে জুলাই সবকটি কাগজের প্রথম পাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্তাক্ত ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। ডোন্ট টাচ মি, আই অ্যাম মেল জাতীয় স্লাপস্টিক প্রচারিত হয়নি। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দুর্নীতি, গোষ্ঠী সংঘাত আর নীতিহীনতায় দীর্ণ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তাও মমতা মমতাই। পশ্চিমবঙ্গের আবেগের মুখ, প্রতিবাদের ভাষা। মমতাকে কোনও আন্দোলনেই বলতে হয়নি- ডোন্ট টাচ মি আই অ্যাম এ ফিমেল। যে কোনও অভিযানে জল কামান, টিয়ার গ্যাস থাকবেই, কর্মীদেরও আটকানো হবে। এটাই অলিখিত নিয়ম। যথার্থ পৌরুষ দিয়ে এর মোকাবিলা করতে হয়। আন্দোলনের সময় মমতা তাঁর নারীসত্তা ভুলে নিজেকে মানুষ হিসেবে তুলে ধরেন। এখানেই তাঁর জিৎ। তাই, আগামী ১০ বছরেও তাঁর গদি অটুট থাকবে, যতই পার্থ চট্টোপাধ্যায় নর্ম সহচরী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় এর ফ্ল্যাট এ টাকার পাহাড় নির্মাণ করুন বা অনুব্রত মন্ডল চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজান, মমতা আগামী ১০ বছরের জন্যে নিষ্কণ্টক।