নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
গণতন্ত্র, নাগরিক সত্তা, অধিকার
ড. মাহফুজ পারভেজ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার
সবকিছুর আগে মানুষের সত্তা, অধিকার, স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নটি বার বার সামনে এসে যাবেই। ফলত, তাত্ত্বিক অসঙ্গতি কখনোই প্রায়োগিক সফলতা আনতে পারে না; বিশ্ববিশ্রুত বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরও একই অভিমত। তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করে সঠিক পথটি খুঁজে বের করতে এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়। তাহলেই বিশুদ্ধ গণতন্ত্রে জনদুর্ভোগ মোচন এবং নাগরিক সত্তা ও অধিকার সমুন্নত হতে পারবে
‘মানবজমিন’ প্রথম পাতায় ‘সরজমিন- পদে পদে ভোগান্তি’ সিরিজের ‘বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এ কেমন অভ্যর্থনা!’ শীর্ষক ফাহিমা আক্তার সুমি’র ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২২, রোববারের রিপোর্টের সূত্রে আমাদের ‘নাগরিক সত্তা’ ও ‘নাগরিক অধিকার’ প্রসঙ্গে তত্ত্ব ও বাস্তবতার তুলনামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি বলে অনুভূত হচ্ছে। আমরা জানি, রিপাবলিক অর্থে প্রজাতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। রাজতন্ত্র শেষ, এখন প্রজার বা নাগরিকের তন্ত্র চলবে, এটাই প্রজাতন্ত্রের মর্মকথা। আধুনিক কালের স্বাধীন দেশের এ ঘোষণার মূল্য অপরিসীম। বর্তমানকালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি দেশই প্রজা অর্থে নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধান কর্তৃক, আইনের দ্বারা, নৈতিক বিবেচনায় এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে নাগরিকগণের জয় ঘোষণা করাই গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। নাগরিক সত্তার সম্মান ও স্বীকৃতি এবং নাগরিক অধিকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়াই বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
কিন্তু সকল দেশে ‘নাগরিক অধিকার’ বাস্তবের কার্যক্ষেত্রে সমান নয়। সকল দেশ নাগরিকদের সকল ধরনের সুবিধা দিতে পারে নি। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক অধিকার যতটুকু সমুন্নত, শোভন ও মর্যাদাপূর্ণ, অনুন্নত দেশে ততটুকু নয়। কোথাও কোথাও নাগরিক নিগ্রহের চিত্র ভয়াবহ। উদাহরণ বাড়ানোর দরকার হয় না। সকলের সামনে নানারূপ আতঙ্কের চিত্র বিদ্যমান। ‘মানবজমিন’-এর আলোচ্য রিপোর্ট তার একটি সামান্য দৃষ্টান্তমাত্র।
বাস্তবতা হলো এই যে, নাগরিক অর্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উপযুক্ত সেবা, নিরাপত্তা ও সম্মানজনক অধিকার পাওয়া এখনো বিভিন্নভাবে দুরূহ। বরং নাগরিক অধিকারের নানা রকম পদদলনের চিত্রই কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে পত্র-পত্রিকায় বিষয়গুলো উপস্থাপিতও হচ্ছে। এতে সামগ্রিক মানবাধিকারে ধস নামার আশঙ্কা এবং আইনের ন্যায্য প্রয়োগের ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হওয়ার বিপদ ঘনীভূত হয়।

নাগরিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে তাত্ত্বিকভাবে এবং বৃহত্তর পরিসরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, আইনের শাসন, বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, বিবিধ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বহুস্বর সংবাদমাধ্যমের মুক্ত উপস্থিতির বিষয়গুলো বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্রের সৌধ, প্রজাতন্ত্রের গৌরব, শাসনের সুকৃতিও ম্লান হয় নাগরিক সত্তার প্রাপ্য অধিকার হনন করা হলে। কারণ, আধুনিক রাজনীতির মূল ভোক্তা বা স্টেকহোল্ডার নাগরিকগণই যদি নিগৃহীত ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে সকল অর্জনই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অতএব, প্রজা বা নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বসময়েই চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের ভাবিত করেছে; নাগরিক অর্থে জনগণকে ভরসায় ও নিরাপত্তায় রাখার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বও পেয়েছে।
তাত্ত্বিক ক্ষেত্র থেকে বাস্তবে চোখ রাখলেই নাগরিক অধিকার হানির বিষয়ে সংশয় গভীর হওয়ার কারণ ঘটে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক স্তরে সত্যই কী মনে করা হয় যে, নাগরিকরাই প্রকৃত ক্ষমতার উৎস ও অধিকারী? বাকি সবাই যে জনপ্রতিনিধি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী রূপে সেই নাগরিকগণ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার অছি বা প্রতিনিধিমাত্র এবং সেবক বিশেষ, তা কি গ্রাহ্য করা হয়? প্রকৃতই যদি সেই বোধ সংশ্লিষ্টদের কথায়, কাজে, বিশ্বাসে, আচরণে, অন্তরে থাকে, তাহলে প্রতি মুহূর্তে নাগরিকদের ওপর দাপট দেখানোর এত নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারতো না।
মূলত:, দাপট যখন সাধারণ মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদ্রব ও অত্যাচারের শামিল হয়, তখন তা নিয়ে কথা হয়, মিডিয়া ও নানা পর্যায়ে নিন্দা ও সমালোচনা হয়। এসব প্রতিক্রিয়ার কারণে অপরাধীরা অন্তর হতে না হউক, লোকলজ্জায় দুঃখ প্রকাশ করেন, কালেভদ্রে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনরায় ভোট-প্রাপ্তির ভয় না থাকলে, প্রশাসনে জবাবদিহিতার উপস্থিতি না থাকলে মৌখিক ক্ষমা চাওয়ারও প্রয়োজন অনেকেই অনুভব করতেন বলে মনে হয় না। বরং উল্টা নাগরিক নিপীড়নকেই নানা বাহানায় জায়েজ করতেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকারের বারোটা বাজিয়ে ছাড়তেন এবং প্রজাতান্ত্রিকতার শরীরে রাজতান্ত্রিকতার কিংবা স্বৈরতার উৎকট কালিমা লেপনে পিছপা হতেন না।
নাগরিক সত্তার অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি গণতন্ত্রের তথা প্রজাতান্ত্রিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ আচরণ, যা হর-হামেশাই পরিলক্ষিত হয় মহলবিশেষ কর্তৃক। এহেন আচার-আচরণ স্বৈরতান্ত্রিক উগ্রতার লক্ষণবাহী এবং নাগরিক বা প্রজা পালনের প্রতিষ্ঠিত শিষ্টতার সঙ্গে বেমানান এবং সম্পূর্ণ পরিপন্থি। পরন্তু, আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি। এসব অনাচারের ফলেই শাসনের মর্মসত্য ও প্রকৃত তাৎপর্য কলুষিত হয় এবং শাসনের রূপ-চরিত্র সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা প্রচারিত হয়। তদুপরি, নাগরিক সত্তা ও অধিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বেদনার কালো ছায়াপাত ঘটে। তখন প্রশ্ন ওঠে, নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদার অবস্থান কোথায়? শুধু বিচারালয়ের রায়ে? নেতার বক্তৃতায়? সুবচনে? আশ্বাসে? হুমকিতে? ধমকিতে?
না। তা মোটেও নয়। বস্তুত আইন এবং বিচার এবং প্রশাসন যেখানে ভারসাম্যপূর্ণ ভাবে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে, সেখানে অনাচারের আশঙ্কা কম হওয়ারই কথা। ক্ষমতার বৃত্ত যখন আইন, বিচার ও শাসন ইত্যাদি নানা শাখায় সুসামঞ্জস্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বচ্ছ থাকে, তখনই নাগরিকগণ গণতন্ত্রের স্বাদ লাভ করেন; নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রটিকে চাক্ষুষ দেখতে পান। কিন্তু যখন সকল ক্ষমতা এক হাতে বা এক স্থানে বা একটি স্তরে কেন্দ্রীভূত হয়, তখনই আসে গলদ। একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রবাহ বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে ও বহুমাত্রিক সুশাসনে কালাপাহাড়ের বিঘ্ন ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের পরিসরে সমাজের সাধারণ নাগরিক অধিকারহীন ও দুষ্টের হুমকির সম্মুখীন হলে তাকে দমিয়ে রাখার কাজ বর্তায় ক্ষমতার বলয়ে অধিষ্ঠিত সকলের উপরই। এখানে ফাঁক তৈরি হলে বা ফাঁকি দেয়া হলে কিংবা পক্ষপাতকে প্রশ্রয় দেয়া হলে দুষ্টরাই শিষ্টের চরম ক্ষতি করতে এবং নাগরিকদের নানাভাবে হেনস্তা করতে পারে। নাগরিক অধিকারকেও চরমভাবে পদদলিত করে তখন।
অতএব, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং নাগরিকের মধ্যকার অলিখিত সম্পর্ক হলো- নাগরিক সর্বোতভাবে সহযোগিতা করবে রাষ্ট্রের প্রতি। বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিককে দেবে সার্বিক স্বাভাবিক নিরাপত্তার বলয় ও অধিকারের পরিধি। নানা প্রজাতির দুষ্ট যদি আতঙ্ক এবং সংশয়ের মেঘকে ঘনিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন সেটাকে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, দমনের দায়িত্ব নিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এই জরুরি দায়িত্বে শৈথিল্য দেখা গেলেই দুষ্টতন্ত্র বহাল হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুষ্টামী, উৎপীড়ন, অত্যাচার ইত্যাদি কুকর্মই নিয়মে পরিণত হয়। যদিও এরূপ পরিস্থিতি মোটেও কাম্য নয়, তথাপি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বা প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও আগাছার মতো এই দুষ্টচক্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। সেই আগাছাই এক সময় গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের মূল শিকড় নামে পরিচিত নাগরিক অধিকারের চিতা প্রজ্জ্বালিত করতে সক্ষম হয়। এ কারণেই, দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তিবর্গ যদি অনিয়ম ও আগাছা সম্পর্কে সতর্ক না হোন কিংবা নিজেরাই এতে নিমজ্জিত থাকেন, তাহলে সবার জন্যই বিপদ। আর কখনো যদি বিশেষ কোনো কারণে উচ্চতর স্তর হতে সুযোগ ও পক্ষপাত এইসব কুপক্ষকে দেখানো হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠতে বাধ্য; নাগরিকগণ এদের পীড়নে অতিষ্ঠ ও প্রপীড়িত হবেই।
প্রায়োগিক অর্থে, শিল্প-বাণিজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক পরিসরে, সমাজে, রাজনীতিতে, প্রশাসনে তথা সর্বত্র শাসনের দীর্ঘ বাহু নানা ব্যক্তি ও সংস্থার দ্বারা প্রসারিত। বাধ্য করার নামে বা অধীনস্থ করার কুপরিকল্পনায় মানুষকে বজ্রমুষ্টিতে নিয়ন্ত্রণের অপতৎপরতাও এক ধরনের আঘাত। নাগরিক সত্তা ও অধিকারের বিরুদ্ধে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসব কুকাজে অগ্রণী হয়, তারা সুযোগ পেয়ে লাগামছাড়া হয়ে যায় এবং সেই ঝাপ্টা সাধারণের ওপর ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হয় এবং নাগরিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে। মূলত মুষ্টি যখন অতিপ্রবল হয়, তখন দাপটের অতি ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটাই স্বাভাবিক, পরিশেষে যা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়। কখনো কখনো এইসব বাড়াবাড়ির বিপক্ষে শোরগোল ওঠে, নিন্দা-সমালোচনার ঝড় হয় বটে। কিন্তু যখন অকারণ-অপ্রয়োজনীয়-অনৈতিক হস্তক্ষেপের নীতি এবং রীতিই নিজস্ব শক্তির উৎসরূপে গণ্য ও বিবেচিত হয়, তখন সেটার অবসান না হলে শুধু প্রতিবাদে ব্যাধি সারবে না; প্রজাতন্ত্র সঠিক অর্থে নাগরিকতন্ত্র হয়ে উঠবে না।
বিশ্বব্যাপী ভঙ্গুর, অ-অংশগ্রহণমূলক, অ-স্বীকৃত গণতন্ত্রের অধীনে নাগরিকতন্ত্র ও মানবাধিকারের যে শনির দশা চলছে, সেটা অতিক্রম করতে না পারলে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র-এর প্রকৃত বিকশিত বা কার্যকর হওয়া দুঃসাধ্য। উন্নয়নের দামামা বাজিয়েও এসব অসম্পূর্ণতাকে চাপা দেয়া অসম্ভব। কারণ, সবকিছুর আগে মানুষের সত্তা, অধিকার, স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নটি বার বার সামনে এসে যাবেই।
ফলত, তাত্ত্বিক অসঙ্গতি কখনোই প্রায়োগিক সফলতা আনতে পারে না; বিশ্ববিশ্রুত বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরও একই অভিমত। তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করে সঠিক পথটি খুঁজে বের করতে এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়। তাহলেই বিশুদ্ধ গণতন্ত্রে জনদুর্ভোগ মোচন এবং নাগরিক সত্তা ও অধিকার সমুন্নত হতে পারবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক, বিশ্লেষক।