নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
মোবাইলমুক্ত পুতিন, ঝামেলামুক্ত পরিকল্পনামন্ত্রী আর জিএম কাদের?
তারিক চয়ন
১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, সোমবার
মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগই দিনের অনেকটা সময় কাটাচ্ছে মোবাইল ফোনে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মেধা যেমন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, তেমনি দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বসে থাকতে থাকতে তারা নানা রোগব্যাধি আর জরায় আক্রান্ত হচ্ছে।
শুধু কমবয়সী ছেলেমেয়েরাই নয়, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের অনেকেই এখন মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। দূরের ব্যক্তির সঙ্গে তারবিহীন স্বস্তিতে যেকোনো জায়গা থেকে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনের উদ্ভব হলেও মূলত ইন্টারনেট এবং উন্নতমানের ক্যামেরার জন্য এখন অনেকেরই মোবাইল ফোন ছাড়া এক মুহূর্তও চলছে না। তাছাড়া, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি থেকে শুরু করে টর্চলাইট, মিউজিক কী নেই মোবাইল ফোনে!
তবে, মোবাইল ফোনে এত এত সুযোগ আর বিকল্প থাকা সত্ত্বেও নামিদামি রাজনীতিবিদরা সাধারণত নেতাকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে কথা বলার জন্য এবং অনলাইনে পত্রিকা পড়ার জন্যই এটি ব্যবহার করে থাকেন। এর বাইরে সময়টাইবা কোথায় তাদের! যদিও দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র বেশ কয়েকজন বর্ষীয়ান-বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদের সাক্ষাৎ পেয়েছি যারা শত ব্যস্ততার ভিড়েও একটু সময় পেলেই মোবাইল ফোনে ভালো গান শুনতে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর জানতে কিংবা ভালো মুভি দেখতে ভুল করেন না। অবশ্য, দেশে এখন এমন রাজনীতিবিদের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা।
সারা দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব বিশ্বনেতাদের মোবাইল ফোনের সঙ্গে সখ্যতার খবর আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তারা কে কোন মডেলের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তা নিয়ে জনমনে খুব স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। তাদের অনেকেই সেটি গোপন রাখতে পছন্দ করেন। ঘন ঘন টুইট করার জন্য বিখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পতো অস্বীকারই করে বসেন যে, তার কোনো ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন রয়েছে। বারবার নিরাপত্তা সতর্কতা দেয়া সত্ত্বেও যোগাযোগের জন্য তিনি (প্রেসিডেন্ট থাকাকালে) ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করছেন প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনে এমন এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এর জবাবে ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দেন: তার কোনো ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নেই, তিনি কেবল সরকার অনুমোদিত ফোন-ই ব্যবহার করেন।
এদিক বিবেচনায়, ট্রাম্পের চেয়ে এক কাঠি সরেস রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার দাবি, তার কোনো মোবাইল ফোনই নেই! বেশ কয়েকবারই তিনি প্রকাশ্যে এমন দাবি করেছেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে অনেক আগে একবার তিনি জানিয়েছিলেন: তিনি এটা ব্যবহার করেন না, কারণ এটা একটা ঝামেলা। সারাক্ষণই রিং বাজতে থাকবে।
থাইল্যান্ডের সাবেক (এবং প্রথম নারী) প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে অবশ্য একসঙ্গে অনেকগুলো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যেতো। দেশটির বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর অ্যাডভান্সড ইনফো সার্ভিসেসের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন ইংলাক। ২০১৫ সালে দুর্নীতির অভিযোগে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে যখন একটি দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা, তখন তিনি দেশ ছেড়ে আরব আমিরাতে পালিয়ে যান। সর্বদা সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারিতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কীভাবে দেশ ছেড়ে পালালেন, অনেকে এমন প্রশ্ন তুললে থাই সেনাপ্রধান জানান, ইংলাক তার সবগুলো ফোন ফেলে দিয়েছিলেন, তাই তার অবস্থান আগের মতো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
আধুনিক বিশ্বে কারও অবস্থান শনাক্ত করতে মোবাইল ফোন যে কতোটা সহজ মাধ্যম তা ইংলাকের ঘটনাটি থেকেই বোঝা যায়। কেবল অবস্থান কেন, ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য যোগাযোগ নাম্বারের পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিও থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন প্রভাবশালী বা বড় রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে ছবি, ভিডিওর পাশাপাশি দলিল দস্তাবেজ, কথোপকথনের রেকর্ড থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সুতরাং, গুরুত্বপূর্ণ কারও ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়া কিংবা অন্যের হাতে পড়াটি নিছক ছেলেখেলার বিষয় নয়। আর, তিনি যদি হন সরকারের মন্ত্রী কিংবা সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা তাহলে তো কথাই নেই! সমপ্রতি এমনই দুটি বড়োসড়ো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।
গেল বছরের ৩০শে মে সন্ধ্যায় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বিজয় সরণি এলাকা অতিক্রমকালে গাড়িতে বসে থাকা (সিগন্যালে অপেক্ষারত) পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়! বিবিসি বাংলাকে মন্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ করে এক ঝলকে অবিশ্বাস্য রকম গতিতে ঝড়ের মতো এসে হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে চলে গেল। আমি দেখিনি লোকটাকে। আমাদের লোক গাড়ি থেকে নামলো। কিন্তু ঐ ৩০-৪০ সেকেন্ডের মধ্যে লোকটা কোথায় মিলিয়ে গেল।’ মন্ত্রী জানান- এ ঘটনা তার কাছে বেশ অবিশ্বাস্য ঠেকেছে, তিনি এই ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিশ্বাস হবেই বা কেন! কারণ, সঙ্গে থাকা গানম্যান এবং পুলিশ সদস্যদের এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ওই ছিনতাইকারী একেবারে ছোঁ মেরে আমার মোবাইল নিয়ে গেল তা প্রায় অসম্ভব বলেই তো মনে হয়।
মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হওয়ার পর কাফরুল থানায় জিডি করা হলেও দেড় মাস পর ধানমণ্ডি থানা পুলিশ মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনের তথ্যের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন- তার ফোনে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য থাকলেও সেখানে রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল কোনো তথ্য অথবা তার কাজ ও দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য ছিল না। তাই তার মোবাইল ফোন চুরির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য বেহাত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে, পুলিশ তখন জানিয়েছিল: মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কোনো তথ্য চুরি বা তার তথ্য অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলবে।
পরের ঘটনাটি আরও চমকপ্রদ। অতিসমপ্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। গত ৩১শে আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সামনে থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের ওরফে জিএম কাদেরের মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়।
উল্লেখ্য, ওইদিনই বিদেশে চিকিৎসাধীন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের নামে একটি বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল যেখানে দলের ভেতরকার রাজনীতির নানা বিষয় বর্ণনা করে এবং নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে নভেম্বরে দলীয় সম্মেলন আয়োজনের কথা জানানো হয়। কিন্তু, দলের চেয়ারম্যানের (জিএম কাদের) প্রেস সচিব পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানান: কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রওশনের নেই, এটা অবৈধ।
ঘটনাবহুল ওই দিনের মাত্র আড়াই সপ্তাহ আগেই (১৩ই আগস্ট) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন জিএম কাদের। সেদিন বিকালে বনানী কার্যালয় থেকে উত্তরার নিজ বাসায় যাওয়ার পথে তার গাড়িকে একটি বাস ধাক্কা দিলে গুরুতর আহত হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও বুকে আঘাত পান তিনি।
ওই দুর্ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই (৭ই আগস্ট) জিএম কাদেরের প্রাণনাশের হুমকির কথা জানিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করা হয়েছিল। এর আগে তাকে কাজী মামুনুর রশীদ (দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য) নামে জনৈক ব্যক্তি জীবননাশের হুমকিসংবলিত একাধিক বার্তা পাঠিয়েছেন, এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
এত গেল মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের আগের কাহিনী। ছিনতাইয়ের পর বিমানবন্দর থানায় মামলা হলে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় (৮ই সেপ্টেম্বর) পর চুরি যাওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়। এর মাঝেই ঘটে গেছে নানা নাটকীয়তা। ছিনতাইয়ের পরদিনই (১লা সেপ্টেম্বর) জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা বানাতে স্পিকারকে চিঠি পাঠায় পার্টির সংসদীয় দল। দলীয় সিদ্ধান্তটি এখনো ঝুলে থাকলেও গুজব রটেছে যে, তাকে সরিয়ে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদকে উপনেতা বানাচ্ছেন রওশন এরশাদ।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জিএম কাদেরের মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হলেও পুলিশ বলেছে, এরই মাঝে (চক্রের ফাঁদে পড়ে) এটি বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়েছে। এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রীর উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোনও হাত বদল হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল। দেশের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরির আশঙ্কা রয়েছে কিনা, নাগরিকরা এ প্রশ্ন তাই করতেই পারেন। কিছুদিন মোবাইল ফোনমুক্ত এ দুজন ভ্লাদিমির পুতিনের মতো ঝামেলামুক্ত ছিলেন নাকি মোবাইল ফোন হারিয়ে দিশাহারা, সে প্রশ্নও জাগতে পারে কারও মনে।