ঢাকা, ২ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

আকবর আলি খান কেন অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম

শুভ কিবরিয়া
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, রবিবারmzamin

মৃত্যুর পর সামাজিক মাধ্যমে তার প্রতি যে স্তুতি-ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে, সেটার কারণও বোধ হয় এই যে, ‘শর্ট-কার্ট’ পথ দিয়ে একজন আকবর আলি খান তৈরি হন নাই। লোভ-লালসা-ক্ষমতা-ক্রোধ-ভালোবাসার সবল পৃথিবীর সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাকে। স্ত্রী-কন্যার অকাল মৃত্যু, শারীরিক অক্ষমতা-অসারতা, নিঃসঙ্গতা সবকিছুকেই দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিয়ে জ্ঞান-সাধনার এক বিপদসংকুল, একরোখা-লক্ষ্যভেদী সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই এই জায়গায় পৌঁছুতে হয়েছে আকবর আলি খানকে

 

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখনো আকাশের দিকে মুখ তুলে উলম্ব অবয়ব নেয়নি। পুরো অবকাঠামো আনুভূমিক চেহারায় দাঁড়িয়ে। সেই পুরনো দিনের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইস্ফেন্দিয়ার জাহিদ হাসান মিলনায়তনে সেদিন বেশ বিদগ্ধ শ্রোতাদের সম্মিলন ঘটেছে। সাল-তারিখ মনে নেই, তবে সেদিনের সন্ধ্যাটা ছিল সত্যিই এক মনোরম আবহাওয়ার। শ্রোতারা সবাই উদগ্রীব, কথা শুনবে প্রিয় ও প্রাণের কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। কথা বলবেন আকবর আলি খান। ততদিনে এই খান, আমলার পোশাক ছেড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারীর পোশাক পরে ফেলেছেন। অর্থনীতির ওপরে সম্ভবত বাংলাভাষায় লেখা সেরা পাঠকপ্রিয় বই ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ লিখে বেশ নামও করেছেন।

বিজ্ঞাপন
 তার লেখা ‘ডিস্‌কভারি অব বাংলাদেশ’ ততদিনে বিদগ্ধ মহলের সমীহ কেড়ে নিয়েছে। ফলে আমলা আকবর আলি খান কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কী বলেন সেটা নিয়ে চাপা কৌতূহলও ছিল। আকবর আলি খান মঞ্চে উঠে কথা বলা শুরু করলেন। তার বলার ধরনটা অনেকটাই রোবটিক, তবে শুনতে মন্দ না। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’কে ততক্ষণে তিনি একজন দেহজীবী নারী বানিয়ে ফেলেছেন। একের পর এক যুক্তির অবতারণা করে, তার বক্তব্যের স্বপক্ষে শক্ত অবস্থানও শ্রোতাদের সামনে হাজির করেছেন। পুরো হলজুড়ে এক ধরনের নীরবতা আর চাপা অস্বস্তি।

 জীবনানন্দ দাশকে যারা ভালোবাসেন, যারা তার কথা শুনতেই এই মিলনায়তনে হাজির হয়েছেন, সেই জীবনানন্দপ্রেমিদের আকবর আলি খান ততক্ষণে বিষণ্নতায়-বিমর্ষতায় ডুবিয়ে হতবাক করে ফেলেছেন। হাজার বছর ধরে পথহাঁটা প্রিয়তমার অবয়ব পাওয়া ‘বনলতা সেন’-কে এভাবে রাস্তায় নামিয়ে এনেছেন আকবর আলি খান, এ মানা অসম্ভব। শ্রোতাদের গুঞ্জন বাড়ছে। এরমধ্যে উঠে দাঁড়ালেন খ্যাতিমান ব্যাংকার, অর্থনীতির নামি ছাত্র শাহ আলম সারওয়ার। তিনি আবেগ সম্বরণ করতে পারলেন না। তার সারা জীবনের জীবনানন্দ প্রেম ততক্ষণে পদদলিত, এই ক্রোধ ও ক্ষোভ নিয়েই তিনি আকবর আলি খানের বক্তব্য মানতে রাজি হলেন না। শ্রোতাদের মধ্যে ততক্ষণে সরবতা ফিরে এসেছে। ভদ্রবেশী মারমুখী ক্রোধ যেন ঝলসে উঠছে, সবার বুকে। সমস্বরে সবাই প্রতিবাদ করলেন। আকবর আলি খান, মানুষ নন, একজন রোবটের মতো, যান্ত্রিকতায় সুস্থির ভাব নিয়ে পুরাণ-মিথ-অভিধান থেকে তার নিজের উদ্ভাবনের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে লাগলেন। সে যুক্তি খণ্ডনের পরিবেশ ও প্রজ্ঞা ওই হলে তখন অনুপস্থিত। গুমোট পরিবেশে ঝড়ের হাওয়া। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার পরিস্থিতি সামলাতে মাইক হাতে দাঁড়ালেন। স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে আমলা আকবর আলি খানকে নিয়ে কিছু রসিকতা করলেন। আকবর আলি খান যখন অর্থ সচিব সে সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য সহায়তা চেয়ে তার কাছ থেকে কীভাবে বিফল হয়েছিলেন, সেদিনের গল্পও রসিয়ে রসিয়ে বললেন।

 বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতি সেদিনের নির্দয় আচরণকারী নীরস অর্থসচিব আজ সেই কেন্দ্রে বসেই জীবনানন্দ দাশেরও পিণ্ডি চটকাচ্ছেন-হালকা ঢংয়ে এসব কথা বললেন। তাতে কিছুটা হাসির খোরাক মিললো। ধীরে ধীরে গুমোট পরিবেশও সহজ হলো। তবে সায়ীদ স্যার আকবর আলি খানের জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে যে গবেষণা ও নতুন অন্বেষণ তাকে খুবই গুরুত্ব দিলেন। বললেন এ বিষয়ে বিস্তৃত আকারে বিধৃত করে বই লেখা হলে বিষয়টি নিয়ে আরও বিতর্ক-আলোচনার মধ্যদিয়ে জীবনানন্দ চর্চা নতুন মাত্রা পাবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতারা সেদিনের সেই আলোচনার কথা কতোটা মনে রেখেছেন তা বলা মুশকিল। কিন্তু আকবর আলি খান সেকথা ভোলেন নাই। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তার অভিজ্ঞান-অনুসন্ধান, নতুন চিন্তা হাজির করে বই লিখে ফেললেন, ‘চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ নামে। যারা এই বইটি পড়েছেন তারা জানেন, জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে এ এক অসাধারণ বিশ্লেষণমূলক বই। বাংলাভাষায় জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে যত গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বইটি। এ বিষয়ে তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে, ‘অন্ধকারের উৎস হতে’। যেখানে ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো: নতুন আলোকে বনলতা সেন’ লেখাটিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে দেয়া তার বক্তৃতার একটা বিস্তৃত ভার্সন।  

 

 

এই আকবর আলি খানকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম যখন বিভিন্ন বিষয়ে তার সাক্ষাৎকার ও মতামতো নেয়া শুরু হলো। খেয়াল করলাম ঘটমান যেকোনো বিষয় নিয়ে আমরা পত্রিকার পক্ষে থেকে যতজনের মন্তব্য বা বিশ্লেষণ নেই না কেন, তা হচ্ছে চর্বিত চর্বণ। সবার কথাতেই ঘটনার বয়ান আছে, রাজনৈতিক পক্ষপাত আছে, কিন্তু নতুন চিন্তা নেই। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র দুজন। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আর আকবর আলি খান। দুজনই আজ প্রয়াত। দুজনই সবসময় সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র নিয়ে নতুন চিন্তার সূত্রপাত করেছেন। এ বিষয়টি আরও বড় করে টের পেলাম যখন আকবর আলি খান (১৯৪৪-২০২২)এর বড় বায়োগ্রাফিকাল ইন্টারভিউ নিতে গেলাম। তখনো তার আত্মজীবনী ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ বের হয় নাই। তার সেই বায়োগ্রাফিক্যাল ইন্টারভিউ আমরা পত্রিকায় প্রকাশ করি ও পরে বই আকারে সংকলিতও হয়। বিচিত্র বিষয়ে তিনি লিখেছেন। বহু বিষয়ে তিনি সাহসের সঙ্গেই লিখেছেন। বাংলাভাষায় তিনিই প্রথম বলেছেন ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতির কথা। 

বৃটিশ আমলে ভারতবর্ষে কর্মরত আমলা মাইকেল ক্যারিটের ভাষ্যে তিনিই প্রথম ঘুষখোর আমলাদের শ্রেণি ভাগ করে জানিয়েছেন এখানে তিন রকমের আমলা আছেন। এক. সজ্জন আমলা-যারা ঘুষ খান না। দুই. ঘুষখোর আমলা-ঘুষ খেয়ে কাজ করে দেন। তিন. ‘শুয়োরের বাচ্চারা’-এই আমলারা ঘুষ নেন অথচ কাজ করেন না।  আমলাদের এইসব সংস্কৃতির মধ্যেই বেড়ে ও গড়ে উঠেছেন আকবর আলি খান, এক জিজ্ঞাসু-আলোড়িত মন নিয়ে। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন একটি বই, ‘সার্কাস, থিয়েটার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে। এই ইচ্ছার কথা শুনেছি তারই জুনিয়র সহকর্মী স্নেহভাজন-শিষ্য আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়ার কাছে। সেটা আর সম্ভব হলো না, তার মৃত্যুর কারণে। তবে, তার আত্মজীবনীতে একটা অসাধারণ তথ্য আছে, নিজের লেখালেখি নিয়ে। সেটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়ও বটে।  তিনি লিখেছেন, ‘পণ্ডিতদের জন্যই লিখি  বা সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখি না কেন, সব বইয়ের পেছনে রয়েছে অনেক বছরের চিন্তা ও ভাবনা। বনলতাকে নিয়ে দুটি বই লিখেছি। বনলতাকে নিয়ে চিন্তা শুরু করি ১৯৬৮ সালে। এ সস্পর্কে প্রথম বই (‘অন্ধকারের উৎস হতে’) প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এরপর ‘চাবিকাঠির খোঁজে’ প্রকাশিত হয় ৪৬ বছর পর-২০১৪ সালে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা শুরু করি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে। ‘ভাবনা ও দুর্ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’ প্রকাশিত হয় ৫৮ বছর পর-২০১৯ সালে। ‘ডিস্‌কভারি অব বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে-প্রায় ১৬ বছর পর। বাংলাদেশের সংস্কার নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি ১৯৬৮ সালে। 

এ সম্পর্কে বই প্রকাশিত হয় ৪৭ বছর গবেষণা শেষে ২০১৪ সালে। ১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশের অর্থসচিব নিযুক্ত হই। বাংলাদেশের বাজেট সম্পর্কে আমার বই প্রকাশিত হয় ১৫ বছর পর ২০১১ সালে। বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য সম্পর্কে গবেষণা শুরু করি ১৯৮০ সালে। ২৯ বছরের গবেষণার পর এ সম্পর্কে বই প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার’ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি ১৯৬৮ সালে। ৪২ বছরের গবেষণার পর ২০১০ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’র প্রশ্নগুলো নিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকে চিন্তা শুরু করি। ৩১ বছরের গবেষণার পর বইটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। ২০০৩ সালে বিশ্বব্যাংকে যোগ দেয়ার পর সুশাসন সম্পর্কে গবেষণা শুরু করি। ১৪ বছরের গবেষণার পর ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘অবাক বাংলাদেশ’। লেবিট ও ডুবনার ‘আজব ও জবর আজব অর্থনীতি’ নিয়ে প্রথম বই প্রকাশ করে ২০০৫ সালে। এ বিষয়ে আমার বই প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। অল্প কিছু বিষয়ে প্রতিবেদন লেখা হয়েছে তিন-চার বছরের গবেষণায়। 

অন্যত্র আমার সব বই-ই দীর্ঘদিনের গবেষণার ভিত্তিতে রচিত।’ আকবর আলি খানের নিজের লেখার দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রমাণ করে আকবর আলি খানের মতো লেখক তৈরি হন বিশদ প্রস্তুতি আর দীর্ঘ গবেষণা ও চিন্তার পথ পাড়ি দিয়ে। মৃত্যুর পর সামাজিক মাধ্যমে তার প্রতি যে স্তুতি-ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে, সেটার কারণও বোধ হয় এই যে, ‘শর্ট-কার্ট’ পথ দিয়ে একজন আকবর আলি খান তৈরি হন নাই। লোভ-লালসা-ক্ষমতা-ক্রোধ-ভালোবাসার সবল পৃথিবীর সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাকে। স্ত্রী-কন্যার অকাল মৃত্যু, শারীরিক অক্ষমতা-অসারতা, নিঃসঙ্গতা সবকিছুকেই দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিয়ে জ্ঞান-সাধনার এক বিপদসংকুল, একরোখা-লক্ষ্যভেদী সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই এই জায়গায় পৌঁছুতে হয়েছে আকবর আলি খানকে। তার জীবনের সমাপ্তির পর তার বিষয়ে জনভাবনা তাই আজ আমাদের জন্য এক গবেষণার বিষয়ও।  তার ভাষাতেই বলি, ‘ জীবনযাপন করাই যথেষ্ট নয়, জীবন থেকে শেখার প্রয়োজন রয়েছে। জীবন নিয়ে বীক্ষণ করতে হবে।’ 

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status