নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
চা শ্রমিকদের দাসত্বের অবসান হবে কবে?
কাজল ঘোষ
২৪ আগস্ট ২০২২, বুধবার
প্রথম চা বাগানে কবে গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে সবশেষ দু’মাস আগেও কুলাউড়া ছিলাম। জায়গাটি সিরাজনগর চা বাগান। এই এলাকাটি বেশকিছু চা বাগানে ঘেরা। সুযোগ পেলেই চলে যাই সপরিবারে। নিজ জন্মভিটের পর এটিই আমার কাছে দ্বিতীয় ভিটে। শুধুমাত্র এই চোখ দুটির প্রশান্তির জন্য আমি এই এলাকায় ছুটে যাই। এত পরিমাণ সবুজ আর কোনো এলাকায় দেখা যায় না। পুরো মৌলভীবাজার জুড়েই রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় চা বাগান। এখানকার শ্রীমঙ্গল তো দুনিয়াজুড়ে খ্যাত। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির’ মোহনীয়তা সকলকেই মুগ্ধ করে। কিন্তু এর নেপথ্যের গল্প যতবার মনে হয় ততবার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। মনে হয়, আমরা বুঝি এখনো আদিম অন্ধকারেই রয়ে গেছি। শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া- এই তিনটি এলাকার একাধিক চা বাগানে নানান সময়ে অবস্থান করে চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। অল্প কথাতেই মনে হয় তারা যেন অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। তাদের জীবনসূর্য আটকে গেছে এই চা বাগানের সীমানাতেই।
যাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তারাই বলেছে বাবুরাই তাদের সবকিছু। ‘পাতা তুলে, পাতা খায়, পাতার ঘরে থাকি আর উদর পুরে বাংলা খায়। দিন শেষে ঝুপরি ঘরে বসে ছেলে-বুড়ো সকলেই বাংলায় বুঁদ হয়ে থাকে। যদি বলি পানির মতো সস্তা এই বাংলা ভুল হবে তা প্রায় বিনে পয়সাতেই মেলে। দিনভর রোদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে দিনান্তে বসে যাই ঝুপরিতে তরল নিয়ে। নেশার ঘোর তাদের যুগ যাতনা ভুলে যেতে সাহায্য করে। চা শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন তাদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য। যে মজুরি তারা চান এটিও কি ন্যায্য। সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৩০০ নয় ৫০০ টাকা করে তাদের মজুরি নির্ধারিত হোক। দশদিনের বেশি চা শ্রমিকরা আধাপেটা খেয়ে না খেয়ে পথের আন্দোলনে আছেন। তারা ৩০০ টাকা মজুরি চান। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ১২০ টাকার স্থলে ২৫ টাকা বৃদ্ধি করার কথা জানিয়েছেন। যদিও এ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। শ্রমিকরা এখনো তাদের অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে পথে রয়েছেন।
একজন অধ্যাপকের দৃষ্টিতে কেন এই সংকট?
কথা হচ্ছিল চা শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন অধ্যাপকের সঙ্গে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত প্রফেসর ড. মো. আশ্রাফুল করিমের সঙ্গে। তিনি বললেন, প্রথমে আমাদেরকে চা শ্রমিকদের নাগরিক হিসেবে ভাবতে হবে। আমরা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তাদেরকে এখনো নাগরিক হিসেবে কোনো মর্যাদা দেয়া হয়নি। ১৮৫৪ সালে বৃটিশরা তাদের ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসেছে এই এলাকায়। কিন্তু তারা আমাদের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এখনো তাদের ভিন্নভাবে দেখা হয়। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হচ্ছে তাদেরকে আমাদের করে নিতে হবে। আমরা এখনো তাদের ওপারের মানুষ হিসেবে ট্রিট করে থাকি। কথা হচ্ছে ১৮৫৪ সালে তো এটি এক রাষ্ট্র ছিল, তখন তো বাংলাদেশ বলে পৃথক রাষ্ট্র ছিল না। নির্মম হলেও সত্য তাদের এখনো পর্যন্ত জমির মালিকানা নেই। তারা নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে কোনো আন্দোলন সংগ্রাম পর্যন্ত করতে পারে না। চা বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে কোনো চা শ্রমিক কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। তাদেরকে বৃটিশদের তৈরি গোলামির জিঞ্জিরেই আটকে রাখা হয়েছে। চা বাগানের মালিকরা যেন প্রভু আর শ্রমিকরা যেন দাস। এ অবস্থা চলতে থাকলে ১৭০ বছরের দাসত্বের অবসান কীভাবে সম্ভব?
মজুরি ও রেশন নিয়ে গোঁজামিল
অতি সাধারণ একটি কথা জনমনে প্রচলিত তা হলো অনেক সুবিধা পেয়ে থাকে শ্রমিকরা। আসলেই কি তাই? মালিক পক্ষ যে হিসাব দিয়ে থাকে তাতেই তো রয়েছে ফারাক। তারা বলে থাকেন দৈনিক মজুরির বাইরে বাসস্থান, বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বোনাস যুক্ত রয়েছে পুরো হিসাবের ফর্দে। কিন্তু এই হিসাবটি কীভাবে আসলো? একজন শ্রমিক দৈনিক ১২০ টাকা পাবে এই শর্তে বাগানে পাতা তুলে। কথা আছে, একজন শ্রমিক দিনে ২৩ কেজি পাতা তুললে ১২০ টাকা মজুরি। ১ কেজি বেশি তুলতে পারলে ৪ টাকা ২৫ পয়সা অতিরিক্ত পাবে। আর এক কেজি কম তুললে ৫ টাকা ২০ পয়সা কাটা যাবে। রেশনের ক্ষেত্রেও হিসাবটিতে রয়েছে ভিন্নতা। পরিবারের স্বামী কাজ করলে ৩ কেজি ২০০ গ্রাম আটা বা চাল পাবে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী পাবে ২ কেজি ৮০০ গ্রাম, ১২ বছরের নিচে দুজন শিশু ২ কেজি ৪০০ গ্রাম করে রেশন পাবে। কিন্তু স্ত্রীর নামে কাজ থাকলে স্বামীর রেশন নেই। আর ১২ বছরের উপরে শিশুদের জন্য কোনো রেশনই নেই। নানামুখী বৈষম্যের চোরাবালিতে আটকে আছে মালিকপক্ষের দেয়া হিসাব। কথা হচ্ছে, যে পরিবারে শুধু একজন কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে এই রেশনের চিত্রটি কি দাঁড়াবে।

যদি একটি পরিবারে শুধু স্ত্রী বাগানে কাজ করে এবং সন্তান নেই তাহলে তার প্রাপ্য রেশনে পরিমাণ মাত্র ৩ কেজি ২০০ গ্রাম। একই পরিবারের অন্য সদস্য বিশেষত বৃদ্ধ বাবা-মা বা বার বছরের উপরে যদি সন্তান থাকে তাহলে তারা এই পরিমাণ রেশনের ওপরই নির্ভরশীল। এটি কি এই ২০২২ সালে এসে সঠিক। তাছাড়া অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব না জানলেও বলা যায় বর্তমানে বাজারের চালচিত্র কি? জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাজারে যে হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে তাতে ১২০ টাকায় মজুরিতে জীবন কীভাবে চলে? যেখানে এক ডজন ডিমের দাম এখন ১৬০ টাকা পর্যন্ত ওঠেছে। আর চিকিৎসার নামে যে বরাদ্দ তাতে কি একজন শ্রমিকের মোটামুটি মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হচ্ছে? পড়াশোনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রায় আশি শতাংশ শিশুই স্কুলে যায় না।
এদের শিক্ষা নিশ্চিতে কোনো ব্যবস্থাই নেই। যে ঝুপড়ি ঘরে তারা থাকে সেটি দেয়া হয়ে থাকে চা পাতা তুলবে এই শর্তেই। এ কাজ না করলে ঘর হারাবে। অথচ এই শ্রমিকদের কারও নিজের জায়গা-জমিও নেই। যারা বাগানিয়া তারা যুগ যুগ বংশ পরম্পরায় এসব বাগানেই তাদের কৃষ্ণকায় আদল নিয়ে ন্যূনতম বেঁচে থাকার আয়োজনে টিকে আছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসামে একজন শ্রমিক দৈনিক কাজ করে ২০৩ রুপি, কোথাও ২৫০ থেকে ৩৪০ রুপি পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও একজন শ্রমিক ৩৫০ রুপির মতো পেয়ে থাকেন। আমাদের এখানে ১২০ টাকাতেই আটকে গেছে তাদের মজুরি। নিচের কবিতাটি লিখেছেন অভ্র ভট্টাচার্য। কবিতাটি যেন আমার মনের কথা। অসংখ্য মানুষ আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করি। কিন্তু লাখো শ্রমিক প্রতিদিন রোদে পুড়ে নিজেদের অঙ্গার করে যে তিতকুটে নির্জাস আপনার টেবিলে তুলে দেয় তার কথা আমরা কি এতটুকুও ভাবি? প্রশ্নটি আমার নিজের কাছেও।
কবিতার লাইনগুলো-
পাঁচতারা হোটেলে
এক কাপ চায়ের দাম কতো?
অথবা, এক কেজি চালের?
একটা ডিম কতো টাকায় পাওয়া যায়?
বাদ দিন- এগুলো কঠিন প্রশ্ন।
সকালের চায়ে
আপনি যখন সতেজতা খোঁজেন,
ঠিক তখন কিছু মানুষ ঝোপঝাড় ঠেলে
চায়ের পাতা তুলতে শুরু করে।
সারাদিন শেষে তাদের মজুরি কতো জানেন?
বাদ দিন- এগুলো কঠিন প্রশ্ন।
গরম জলে টি-ব্যাগ চুবাতে চুবাতে
আপনার হয়তো খেয়াল থাকে না
মাথাপিছু আয়ের সুখের সাগরে
ডুবে মরে কতো অপ্রয়োজনীয় মানুষ।
আমাদের চায়ের কাপে তারা রং ছড়ায়,
অথচ তাদের জীবন!
ছুড়ে ফেলা টি-ব্যাগের মতো
অপ্রয়োজনীয়, শুষ্ক, রংহীন।
আমাদের কাছে তারা ভুলে যাওয়া মানুষ,
আমাদের কাছে তারা চা বাগানের শ্রমিক,
আমদের কাছে তারা ১২০ আর ১৪৫।
পাঁচ টাকায় যেন কি পাওয়া যায়?
বাদ দিন- এগুলো কঠিন প্রশ্ন।
আসেন আমরা টং দোকানে
এক কাপ চা খাই।
দাম?
বাদ দিন না- এসব কঠিন প্রশ্ন।
কতোটা নির্মমতায় ঠাসা। চা শ্রমিকদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছে বৃটিশ বেনিয়ারা। তারা তাদের এখানে নিয়ে এসেছে দাস বানাতে। তাদের এই দাসত্বের ইতিহাস চা বাগানের ছড়ার পানিতে ধুয়ে মুছে ভেসে চলেছে শত শত বছর ধরে। ইতিহাস বলে, যেসব এলাকায় চা বাগান স্থাপন করেছিল বৃটিশরা সেসব এলাকায় পৃথক মুদ্রার প্রচলন করেছিল। যেন প্রচলিত সমাজের সঙ্গে মিশতে না পারে শ্রমিকরা। শুধু চা বাগানের ভেতরেই তারা যুগ জীবন কাটাবে তেমনই নিয়ম ছিল। তিন পুরুষ ধরে এভাবেই তারা জীবন কাটাচ্ছে। সময় বদলেছে। এনালগ থেকে আমরা ডিজিটালে। ইতিহাস বদলেরও সময় এসেছে। নতুন ইতিহাস হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এই রাষ্ট্র যাদের নাগরিকত্ব সনদ দিয়েছে। তাদের মৌলিক অধিকার যদি হয়ে থাকে সংবিধানে বর্ণিত দফায়। তবে একই সীমানায় থেকেও তারা কেন আটকে আছে বৃটিশদের তৈরি ঘেরাটোপে। নাকি তা এখনো চলছে মালিকদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেই। একজন সন্তোষকে এখনো কেন অধিকারের জন্য লিখতে হয়। একজন সন্তোষের মাকে কেন কান্না সম্বল করে বাঁচতে হয়? এই প্রশ্নগুলোর সমাধান জরুরি।
শেষ কথা
২০১৮ সালে টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে কম মজুরি পান চা শ্রমিকরা। সে সময় তাদের মজুরি ছিল ১০২ টাকা দৈনিক। ২০২২ সালে যখন শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন তখন ১২০ টাকা মজুরি। পিছনে ফিরে তাকালে এই চিত্র বাংলাদেশের সামগ্রিক বাজেট, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় থাকা দেশটির মূল চরিত্রের সঙ্গে একেবারে বেমানান তো বটেই চরম অমানবিকও। স্বাধীনতার পরপর একজন নারী চা শ্রমিকের মজুরি ছিল এক টাকা এক আনা আর পুরুষ শ্রমিকের এক টাকা দুই আনা। পরে বিভিন্ন সময় আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে তা বাড়ে। কিন্তু সেই বৃদ্ধির পরিমাণের দিকে তাকালে বৈষম্যের তুলনার ধারে কাছেও এদেশের অন্য কোন সেক্টরকে মেলানো যাবে না। এই চিত্র এতটাই রাতদিন। এক আনার হিসাব থেকে বেরিয়ে আমাদের মালিক পক্ষ প্রথমে ৮ টাকা তারপর ১২ টাকা, ২০ টাকা, ২২ টাকা, ২৪ টাকা করে বৃদ্ধি করে। ২০০৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩২ টাকায়। ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৭ তে এসে ১০২ এবং সবশেষ ২০২০ সালে ১২০ টাকা।
অথচ একই সময়ে আমাদের প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার চিত্র যদি আমরা প্রতীকী অর্থেও দেখি কি বিশাল রকমের ফারাক স্বাধীনতার পরপর প্রথম বাজেট আর সবশেষ যে বাজেট গেল তা মিলিয়ে দেখুন। চা শ্রমিকদের জীবন ইতিহাস দাসপ্রথার নির্মমতার সঙ্গেই তুলনা চলে। যাদের নিজেদের জমিজিরাত নেই। বাঁচার অধিকার কেবল মালিক যতটুকু চান ততটুকুই। চা বাগানে বেড়াতে গেলে আপনারাই মিলিয়ে দেখুন ম্যানেজারের বাংলো আর যে শ্রমিকদের রক্তে ঘামে দুটি পাতা আর একটি কুড়িতে করে তাদের সোনার সিংহাসন সেই শ্রমিকদের জীবন কতোটা গঞ্জনার। তাদের ঝুপরিতে জীবন কাটে খেয়ে না খেয়ে। শুধু ভোটের সময় নেতাদের কাছে তাদের কদর, ভোট শেষ যে-ই অচ্যুৎ, সে সে-ই। মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও কতোটা ফারাক এই মজুরির ক্ষেত্রে। একজন সামাজিক মাধ্যমে সেই চিত্রই তুলে ধরে উল্লেখ করেছেন, যেখানে ওয়াসার এমডির বেতন মাসে পাঁচ লাখ টাকা আর একজন চা শ্রমিকের বেতন দৈনিক ১২০ টাকা। অথচ সূচক বলছে, দুজনেরই বাৎসরিক মাথাপিছু আয় আড়াই লাখ টাকা। শেষ কথা একটাই, চা শ্রমিকদের নিয়ে এমন বৈষম্যের নিপাত যাক। অন্তত সম্মানজনক বেতন যেন নির্ধারণ করা হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেই আর্জিই রইলো।