অনলাইন
ইসরাইলের পরবর্তী লক্ষ্য কি পাকিস্তান?
মানবজমিন ডিজিটাল
(৪ ঘন্টা আগে) ৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ৯:১২ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৫ অপরাহ্ন

ইসরাইল-ইরান উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে এবং আঞ্চলিক সংঘাতের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে পাকিস্তান। অধ্যাপক জেফ্রি শ্যাক্স প্রশ্ন তুলেছেন, ইসরাইল-ইরান সংঘর্ষের নতুন দফা শুরু হওয়ার পর আমরা কি আরও বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে?
এই অঞ্চলে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর উচ্চ ঝুঁকি থাকার কারণে এই সংঘাত পরবর্তীতে আবার শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন এবং ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ আধুনিক যুদ্ধের একটি নতুন ধরণ প্রকাশ করে, প্রযুক্তি-যুদ্ধ কৌশল এবং শত্রুর ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এজেন্টদের ব্যবহার করে গোপন অভিযান।
প্রথমত, ইউক্রেনের ‘অপারেশন স্পাইডারওয়েব’ সফলভাবে ৪০টিরও বেশি গোপন কৌশলগত বোমারু বিমানকে ধ্বংস করেছে, যা আধুনিক যুদ্ধকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে। অন্যদিকে ইসরাইল ইরানের অভ্যন্তরে গোপন অভিযানের মাধ্যমে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি তার শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা করেছে।
টাইমস অব ইসরাইলের প্রতিবেদন অনুসারে, মোসাদ ইরানের অভ্যন্তরে একটি ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছিল এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে নির্ভুলভাবে টার্গেট করতে পারে এমন অস্ত্র এবং কমান্ডোদের পাঠিয়েছিল।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ইসরাইলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ এবং ইউক্রেনের ‘অপারেশন স্পাইডারওয়েব’ উভয়ই গোপন এজেন্ট নিয়োগের একটি সাধারণ কৌশল ভাগ করে আধুনিক যুদ্ধকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে এবং শত্রুর ভূখণ্ডের ভেতরে স্মার্ট অপারেশনের উদাহরণ স্থাপন করে।এখন ইসরাইল-ইরান সংঘাতের খবরের পাশাপাশি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে একটি নতুন শিরোনাম দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানকে ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পাকিস্তান কেন?
দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি ধর্মযাজক, নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, শীর্ষ সামরিক কমান্ডার, সাধারণ ইসরাইলি নাগরিকরা এমনকি পশ্চিমা বিশ্বে তাদের মিত্ররা প্রকাশ্যে বৃহত্তর ইসরাইলের কথা বলে আসছে। সম্প্রতি ভারতীয়রা পাকিস্তানের পারমাণবিক সম্পদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পরবর্তী প্রজন্মের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী এবং আজ এটি সমাধানের জন্য আমাদের কী করা উচিত। নেতানিয়াহু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো একটি ‘জঙ্গি ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে’ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে বাধা দেয়া। প্রথমটির নাম ইরান, দ্বিতীয়টির নাম পাকিস্তান। যদি এই উগ্র সরকারগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তাহলে তারা নিয়ম মানবে না।'
উল্লেখযোগ্যভাবে, পাকিস্তানের পারমাণবিক সম্পদ ধ্বংস করা ইসরাইলের তালিকায় রয়েছে।ইরাক ধ্বংস করার জন্য ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ জাল তত্ত্ব তৈরি করার অনেক আগে থেকেই বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ইসরাইলি রাজনীতিবিদ এবং তাদের লবিং গ্রুপ, শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা পণ্ডিত এবং সাংবাদিকরা পাকিস্তানকে ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। ‘পশ্চিমা এবং ইসরাইলের জন্য হুমকি’ বা ‘নৃশংস শাসনব্যবস্থা’ এই ধরনের শিরোনাম ব্যবহার করে পশ্চিমা মিডিয়া এর আগে সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, সুদান এবং এখন ইরানসহ সার্বভৌম মুসলিম দেশগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। অ্যাস্পেন আইডিয়াস ফেস্টিভ্যাল চলাকালীন আটলান্টিকের জেফ্রি গোল্ডবার্গ অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন অ্যাডমিরাল মাইক মুলেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি বিপজ্জনক-পাকিস্তান না ইরান? দর্শকদের উপস্থিতিতে মুলেন হেসে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত পাকিস্তান।’
মনে রাখতে হবে, মুলেন পূর্বে পাকিস্তানকে ইসলামী চরমপন্থার কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। অবশ্যই, মুলেন একা নন, অনেক শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং কর্মীরা সকলেই পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক’ এবং ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এর পারমাণবিক অস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের রিপোর্ট ‘The agonizing problem of Pakistan’s nukes’ ( পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সমস্যা) পরবর্তী কী ঘটতে চলেছে তার ইঙ্গিত দেয়। ওসিরাকে ইরাকের পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি ধ্বংস করার পর (১৯৮১), ইসরাইল পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। ‘ইসলামিক বোমা’ শব্দটি বিশ্বকে আতঙ্কিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যদিও কেউ কখনও ‘ইহুদি বোমা’, ‘হিন্দু বোমা’ বা ‘খ্রিস্টান বোমা’- এর কথা শোনেনি। যদিও ইসরাইল, ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক শক্তির কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন মেয়ারশাইমার এবং স্টিফেন ওয়াল্টের ‘দ্য ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি’ (২০০৮), আমেরিকান সাংবাদিক পিটার বেইনার্টের ‘বিইং ইহুদি আফটার দ্য ডেস্ট্রাকশন অফ গাজা’ (২০২৫) এবং পঙ্কজ মিশ্রের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গাজা’ (২০২৫) শীর্ষক বইগুলো ইরান ও গাজার পর কী ঘটতে চলেছে তার সময়োপযোগী স্মারক।
স্পষ্টতই, গত চার দশক ধরে প্রায় সকল আমেরিকান প্রেসিডেন্টই পাকিস্তানে হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন এবং দেশটিকে ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কোনটি বেশি হুমকি? পারমাণবিক ইরান নাকি অস্থিতিশীল পাকিস্তান?বাইডেন বলেছিলেন, ‘তারা উভয়ই অত্যন্ত, অত্যন্ত বিপজ্জনক... পাকিস্তানের অস্ত্র ইতিমধ্যেই ইসরাইল এবং ভূমধ্যসাগরে আঘাত হানতে পারে।’
মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরেও একের পর এক মুসলিম দেশ ধ্বংস করার জন্য ইসরাইলের সুপরিকল্পিত অভিযান চলছে। পশ্চিমা বিশ্ব
ইসরাইলকে নিঃশর্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে এবং লেবানন, সিরিয়া জর্ডান, মিশরে ইসরাইলের ভূমি দখলের অভিযানকে সমর্থন করে চলেছে। ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য ‘অস্তিত্বগত হুমকি’ এবং ‘বিশ্বকে একটি নিরাপদ স্থান করে তোলার’ অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে নেতানিয়াহুর দেশ। ইসরাইলের প্রাণঘাতী অভিযান কোথায় শেষ হবে? এরপর কোন দেশ? পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর নাকি সৌদি আরব?
পরবর্তী টার্গেট
বলা হচ্ছে, ইসরাইল এবং আমেরিকার আরেকটি যুদ্ধের প্রয়োজন যাতে তাদের জনগণ বুঝতে পারে যে, ‘ইসলামিক হুমকি’ এখনও আছে এবং সেই হুমকি দেখাতে পারে পাকিস্তান। ইসরাইল-ইরান সংঘর্ষ আপাতত সীমিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে শেষ হয়েছে এবং পশ্চিমা-ইসরাইলি জোট হয়তো অন্য কোনও প্রকল্পে এগিয়ে যেতে পারে। যুদ্ধ একটি লাভজনক ব্যবসা এবং এটি চলতেই থাকবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় ইসরাইল পাকিস্তানের ক্ষতিসাধন করতে ভারতকে প্রযুক্তি এবং ড্রোনসহ স্মার্ট অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল। ভারতে নেতানিয়াহুর একজন আদর্শিক অংশীদার আছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যিনি বৃহত্তর ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন যা নেতানিয়াহুর বৃহত্তর ইসরাইল গড়ে তোলার স্বপ্নের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কিছু বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে সামরিক অবস্থানগুলোতে ড্রোন হামলা চালাতে পারে, যেমন ইরানে ইসরাইলি ধাঁচের আক্রমণ বা রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনের মতো আক্রমণ। তাছাড়া, পশ্চিমা মিডিয়া পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রাগারকে পশ্চিমা এবং ইসরাইলের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করেছে। অধ্যাপক সুশান্ত সিং মনে করেন, ‘নয়াদিল্লির হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দক্ষিণ এশিয়ার এক বিপজ্জনক সংশোধনবাদী ইতিহাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। যদি তারা মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে চায়, পাকিস্তানে আক্রমণের হুমকি দিতে চায় এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ভেতরে বেলুচ লিবারেশন আর্মিসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে যেতে চায় তাহলে তারা এমন এক ফাঁদে পা দিচ্ছে যা দক্ষিণ এশিয়াকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।’
নেতানিয়াহু ও মোদির আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা বন্ধ করার সময় এসেছে। ইসরাইল এবং ভারতের তরুণদের মনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে শুরু করেছে। আটলান্টিক রিপোর্ট করেছে, ‘৭০ শতাংশ ইসরাইলি নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দেখতে চান।’ একইভাবে এশিয়া টাইমস জানিয়েছে, ‘অনেক ভোটারই মোদির ঘৃণার রাজনীতি পছন্দ করছেন না।’ বার্তাটি সহজ- মানুষ যুদ্ধ নয়, শান্তি চায়।
সূত্র : ডেইলি সাবাহ