বাংলারজমিন
অন্ধত্ব নিয়ে ১৬ বছর
যুবদল কর্মীর চোখ তুলে নিয়ে দেয়া হয়েছিল জেলে
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
৩০ জুন ২০২৫, সোমবার
‘সড়কে ফেলে দু’চোখ উপড়ে নিলো। এতেও ক্ষান্ত হয়নি তারা। এমন অবস্থায় পুলিশ দিয়ে জেলে পাঠায়। অসুস্থ অবস্থায় দেড় মাস কারাগারে থাকতে হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর অন্ধত্ব জীবনযাপন। নিজের জীবনের এমন অবস্থায় পৃথিবীর আলো দেখে একটি পুত্র সন্তান। অথচ তাকে আর কোনোদিন দেখা হলো না আমার! তার চেহারা কেমন, তা দেখার সুযোগ আর হলো না আমার। একটি বার ছেলের মুখ দেখতে না পারা হতভাগ্য বাবা আমি। বিএনপি’র হয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততাই ছিল আমার একমাত্র অপরাধ। আর সেই কারণে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী দিনেদুপুরে রাস্তায় ফেলে আমার দুটো চোখ কেড়ে নেয়।’ এভাবেই নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার কথা তুলে ধরেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের যুবদল কর্মী মো. লিটন হাওলাদার (৩৮)।
লিটন উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি ওই ইউনিয়নের যুবদলের সাবেক সদস্য ছিলেন। বর্তমানে সন্তোষপুর ১নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সদস্য। লিটন বলেন, জীবনকে ঠিকভাবে বুঝে উঠার আগেই রাজনীতির কারণে আমার জীবনটা অন্ধকার হয়ে গেল। এখন আমি মানুষের বোঝা। কোনো কাজ কর্ম করতে পারি না। আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। সংসারে বাবা-মা, স্ত্রী এবং এক ছেলে রয়েছে। ছেলে আবির এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছেলের লেখাপড়া, সংসার ও নিজের ওষুধ খরচ নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কী আমার ভবিষ্যৎ? এমন প্রশ্ন রেখে লিটন বলেন, ১৬ বছর হলো চোখ হারালাম। কিন্তু অপরাধীদের কোনো বিচার হলো না। আওয়ামী লীগের সেই দুঃশাসনে নিজের চোখ হারানোর যন্ত্রণার কথাও না বলতে পারার কষ্টের কথা তুলে ধরেন লিটন। নিজ দল বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ সিনিয়র নেতাদের কাছে আকুতি জানিয়ে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
জানা যায়, ২০০৯ সালের দিকে সাফিয়া বেগম নামে লিটনের এক ফুপু সন্তোষপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। সেখানেই একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন লিটন। ওই সময় মাধবখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মিজান কাজী, নুরজামাল খান ও মনির হোসেনসহ ৫-৭ জন বিদ্যালয়ে গিয়ে তার ফুপুকে বলে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এই টাকা দিতে আপত্তি জানালে ২০০৯ সালের ৩রা এপ্রিল সকালে আওয়ামী লীগ নেতারা লোকজন নিয়ে তার ফুপুর থাকার ঘর ভাঙচুরসহ মারধর করে। এই খবর পেয়ে লিটন ও তার বাব-চাচারা ঘটনাস্থলে আসলে তাদেরও মারধর করে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে লিটন পালিয়ে নিকটস্থ সাজ্জল বাড়ি নামক এলাকায় একটি ঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মিজান বাহিনী খুঁজে বের করে ওইদিন বিকালেই লিটনকে মোটরসাইকেল করে চাকরখালী নামক এলাকার নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। পরে তার হাত পা বেঁধে মুখের ভেতর কাঁচা কলা ঢুকিয়ে গাছের লাঠি দিয়ে দু’টি চোখ উপড়ে দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে।
ঘটনার পরদিন লিটনের স্ত্রী সাদেকা বেগম বাদী হয়ে মির্জাগঞ্জ থানায় নুর জামাল, মিজান কাজীসহ মোট ১৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলাটি এখন পটুয়াখালী সিআইডিতে তদন্তাধীন আছে। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পটুয়াখালী সিআইডি কার্যালয়ের সাব-ইন্সপেক্টর আল মামুন বলেন, তদন্ত চলমান আছে। দুই এক মাসের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি মো. মজিবুর রহমান বলেন, যুবদল করায় ওই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজান কাজী, নজরুল কাজীরা লিটনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে এবং চোখ তুলে দেয়। চোখের চিকিৎসায় এখনো ওর অনেক টাকা খরচ হয়। খুবই মানবেতর জীবন কাটছে লিটনের। ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মো. পলাশ হাওলাদার বলেন, অভাব-অনটনে দিন কাটছে লিটনের। তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তিনি।