মত-মতান্তর
বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের তৃপ্তি-অতৃপ্তি
গাজী মিজানুর রহমান
(১১ মাস আগে) ১৮ এপ্রিল ২০২২, সোমবার, ৫:০০ অপরাহ্ন

বাংলা সন গণনার ইতিহাস থেকে জানা যায় যে , সম্রাট আকবরের সময়ে জমির খাজনা আদায়ের স্বার্থে সারা হিন্দুস্তানে অঞ্চলভিত্তিক ফসলি সন প্রথা চালু করা হয়েছিল । আকবর তাঁর সাম্রাজ্য শাসনের ঊনত্রিংশ বছরে (হিজরি ৯৯২ এবং ১৫৮৪ সালে) ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নেন । তার পরিষদের সদস্য আমির ফতুল্লাহ সিরাজীর উদ্ভাবিত বর্ষ গণনার নতুন পদ্ধতির বিকশিত রূপ হচ্ছে বর্তমানের বাংলা সন । সন গণনা শুরু হয় সম্রাটের সিংহাসন আরোহনের বছর ১৫৫৬ সাল , তথা ৯৬৩ হিজরি থেকে । সে বছরের বাংলা সনকে ৯৬৩ সন ধরেই এতদাঞ্চলে বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয় । চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসর অপেক্ষা বছরে ১১ দিন কম । তাই এখন বাংলা সন হচ্ছে ১৪২৯ , কিন্তু হিজরি সন ১৪৪৩ । বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা , নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এবং বিহারের ঐতিহাসিক অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল প্রমুখ ব্যক্তিগণ মনে করেন , যোগ বিয়োগ করে হিজিরি সনের উপর দাঁড় করিয়ে বাংলা সন চালু করার কীর্তি সম্রাট আকবরের ।
আর সেই সনকে পরিপূর্ণভাবে চালুর কৃতিত্ব সুবাদার মুর্শিদ কুলি খানের । তিনি ১৭১৭ সাল থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেন । তবে বাংলা সনের মাসের নামগুলি নেয়া হয়েছিল প্রাচীন আমলের শকাব্দ থেকে ।
১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাংলা সনকে সংস্কার করে আন্তর্জাতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় ।
সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হবে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে , সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে । অধিবর্ষে (লিপইয়ার) ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণ্য হবে । আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে । এই পদ্ধতি প্রচলিত হয় ১৯৯৫ সালে । পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে আরেকটা সংস্কার কমিটি কাজ করে । তারা প্রথম ছয় মাসের বদলে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন রাখার সুপারিশ করেন এবং বাকি সাত মাসের মধ্যে ফালগুন মাস ছাড়া বাকি মাসসমূহ হবে ৩০ দিনের হবে বলে মতামত দেন । ফালগুন মাস লিপইয়ার বৎসর হলে ৩০ দিনের , অন্যথায় ২৯ দিনের হবে , এমন সুপারিশ করেন । সে মোতাবেক ১৪২৬ সাল থেকে বাংলা সনের হিসেব চালু আছে এবং ওই বছর থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হচ্ছে ১৪ এপ্রিলে ।
ভারতে ১৯৫২ সালে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ড মেঘনাদ সাহার অধীন একটি কমিটি গঠিত হয় । মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাব ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার গ্রহণ করেছিল । সেই সংস্কার প্রস্তাব এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সুপারিশকৃত পঞ্জিকা সংস্কারের প্রস্তাবে প্রভূত মিল ছিল । ড. সাহার প্রস্তাবের কিছুটা সংশোধন করে পরে এস.পি. পাণ্ডে কমিটি ১৪ই এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল । কিন্তু পশ্চিম বাঙলা আগের মত ১৫ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালন করে যাচ্ছে । প্রয়াত লেখক ও গবেষক সামসুজ্জামান খান লিখেলিছেন যে , ভারতে সেখানকার পঞ্জিকাকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পান্ডে কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে উভয় পদ্ধতির সমর্থকদের মধ্যে বিতর্ক অব্যাহত আছে ।
এরূপ পরিস্থিতিতে সবমিলিয়ে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের অনুষ্ঠান নিয়ে এখন কিছু অতৃপ্তির জায়গা রয়েছে । প্রথমত , একই বাংলা সন গণনায় বাংলাভাষী দুই অঞ্চলে দুই রকমের দিন । ফলে রবীন্দ্রনাথ , নজরুল সহ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য ধারণ করতে গিয়ে দুই দেশ দুই দিনে নানা উৎসব পালন করে । নববর্ষও দুই দেশে দুই দিনে পালিত হয় । দ্বিতীয়ত , পয়লা বৈশাখে যে উদ্দীপনায় বাংলা সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানানো হয় , সেই শ্রদ্ধার যায়গাটুকু বাদবাকি দিনগুলিতে ক্রমশ থিতু হতে থাকে । তদস্থলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রাধান্য পায় । আমাদের নাগরিক জীবনে , অফিস-আদালতে , শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পয়লা বৈশাখ ছাড়া অন্য দিনে বাঙ্গলা সনকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । মহানগরগুলির দোকান-শপিং মলের নাম , কিন্ডারগার্টেনগুলির নামের সাইনবোর্ড দেখলেই এ সত্য অনুধাবন করা যায় । এভাবে নববর্ষ উদযাপন একদিনের আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে ।
পয়লা বৈশাখ একটি অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান । চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত থাকলেও জীবন ও জীবিকার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কোনো ধর্মীয় গণ্ডী নেই । তাই এটা সর্বজনীন । অর্থনীতি জীবনের একটা বড় নিয়ামক । অর্থনীতির সাথে , বিশেষ করে কৃষি-অর্থনীতির সাথে সংশ্লেষ থাকায় গ্রামাঞ্চলে বাঙ্গলা সনের সাথে আজও নাড়ির সংযোগ অক্ষুণ্ন রয়েছে । গ্রামের মানুষ ঘটা করে শহরবাসীর মত পয়লা বৈশাখ পালন না করলেও তাদের জীবনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে বাংলা সনের মাস এবং ঋতু জড়িয়ে আছে । গ্রামের মানুষ বাংলা মাস গুণে জমিতে বীজ ফেলে , বাংলা মাস গুণে বোঝে কখন পাট কাটা যাবে , কখন খেজুর গাছ রস দেবে । তাই নববর্ষের অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রার আয়োজনে রংঢঙ দিয়ে সাজানো হাতি , ঘোড়া , বাঘ , পেঁচা , হরিণ এর চেয়ে গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার উপকরণের প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি । কল্পনা দিয়ে পশুপাখি আমদানি ক’রে বর্ষবরণের থিমকে বিচ্ছিন্ন করার চেয়ে শোভাযাত্রায় যদি ঢেকি , কুলো , লাঙল , মাছ ধরার সামগ্রী , চাষ করার গরু , খাল পেরোবার সাঁকো , নৌকা , ডোঙা , কাচি , কোদাল ইত্যাদি কৃষিজ উপকরণ থাকে , তাহলে অনুষ্ঠান আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ হবে – রূপকথার মত খাপছাড়া লাগবে না । আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা বিবেচনা করবেন ।
- গাজী মিজানুর রহমান (সাবেক যুগ্ম-সচিব এবং লেখক)