প্রথম পাতা
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমায় উল্লম্ফন, এক বছরে বেড়েছে ৩৩ গুণ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২০ জুন ২০২৫, শুক্রবারআওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩ গুণ। এতে বাংলাদেশিদের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে আমানতের এই উল্লম্ফন নজিরবিহীন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত এক যুগ ধরে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। যদিও নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করছে না ব্যাংকটি।
২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশিরা এই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা করেন। ওই বছরের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগ দেশ ছাড়েন। ধারণা করা হচ্ছে সরকার পতনের আগে-পরের সময়ে ভয়ে দেশ থেকে অর্থ সরিয়েছেন অনেকেই।
২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর (১২ মাস) শেষ হওয়া বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানত এখন ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি ফ্রাঁ ১৪৯ টাকা ৬৯ পয়সা হিসাব করলে ৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। অথচ আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এটি ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ২৬৪ কোটি টাকার মতো। এক বছরে আমানত বেড়েছে ৩৩ গুণ বা ৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। রিপোর্টে অবশ্য এই উল্লম্ফনের কোনো কারণ উল্লেখ নেই।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে বাংলাদেশিদের আমানত। ২১ সালে আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁতে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এরপর নজিরবিহীন গতিতে অর্থ তুলে নেন বাংলাদেশিরা। দুই বছরে ১১ হাজার কোটি টাকা কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় আমানত। দুই বছর টানা যে আমানত কমেছে, তা হঠাৎ এত বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১৮ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। আর ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, যদি কোনো বাংলাদেশি, নাগরিকত্ব গোপন রেখে অর্থ জমা রেখে থাকেন, তবে ওই টাকা এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গচ্ছিত রাখা স্বর্ণ বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও হিসাব করা হয়নি প্রতিবেদনে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বৈধ-অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ গচ্ছিত রাখেন। কঠোর গোপনীয় ব্যাংকিং নীতির কারণে সারা দুনিয়ার মানুষ সেখানে অর্থ জমা রাখেন। বিশেষ করে অবৈধ আয় আর কর ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকা জমা রাখা হয় সুইস ব্যাংকে। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও এক দশক ধরে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক।
এসএনবি’র দেয়া তথ্যমতে, এই অর্থের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা, আমানতকারীদের জমা এবং পুঁজিবাজারে বাংলাদেশের বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর ৯৫ শতাংশের বেশি অর্থই বাণিজ্যিক কার্যক্রমকেন্দ্রিক এবং বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা।
তবে বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, এই অর্থের কিছু অংশ বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদও হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে সুইস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সুইজারল্যান্ডের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য তারা পায়নি।
সুইস কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ দেয়া হলে তারা তথ্য সরবরাহে সহযোগিতা করতে পারে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, যদি কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান অন্য দেশের নামে সুইস ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখে, তবে সেটি বাংলাদেশের নামে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না। এছাড়া, সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্য এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত নয়। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রাখে তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম জানান, পাচারকারীরা আমানতের সিংহভাগ অবৈধ উপায়ে যেমন; ভুল চালান, হুন্ডি ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে অর্থপাচার করে থাকতে পারে বলে ধারণা করছি।