প্রথম পাতা
সিপিবি-গণফোরামের ওয়াক আউট
সাংবিধানিক কাউন্সিল চায় জামায়াত-এনসিপি ভিন্নমত বিএনপি’র
স্টাফ রিপোর্টার
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবারজাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে একমত জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। বিপক্ষে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি বলছে, অথরিটি আছে, পাওয়ার ফাংশন আছে কিন্তু কোনো জবাবদিহিতা নেই- এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা সমর্থন দিতে পারি না। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় এমনই মত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বৈঠকে তিনটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়। সেগুলো হলো- জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও জেলা কাউন্সিল গঠন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় মতভিন্নতা থাকার কারণেই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা চলছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো এসব বিষয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। দলগুলো নিজেদের অবস্থানের পাশাপাশি অন্যদের অবস্থানও বুঝতে পারে। আমরা সেদিক থেকে লক্ষ্য করছি- মত দিচ্ছেন, মতবিনিময় হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটার অগ্রগতিও আমরা লক্ষ্য করছি। আজকে যেসব বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি তার মধ্যে রয়েছে- এনসিসি গঠন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং জেলা কাউন্সিল বিষয়ে আলোচনা। তারমধ্যে দুটো বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে পেরেছি।
এনসিসি গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রথমেই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের বিষয়ে। এটি এমন এক প্রতিষ্ঠান যেটি সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেবে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের তাগিদ রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করে কিনা। বিভিন্নভাবে সেটা তারা বলেছেন। তাদের তাগিদ আছে, দু’একটি রাজনৈতিক দলের নীতিগত পার্থক্য থাকলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মনে করে এরকম একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। আবার বেশ কয়েকটি দল এ বিষয়ে একমত হয়নি।
আলোচনায় খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা এই আলোচনা অব্যাহত রাখবো আগামী সপ্তাহেও। আজকের আলোচনার দ্বিতীয় বিষয় ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে দুটো প্রস্তাব আছে। একটি সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে, আরেকটা নির্বাচন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে। দু’টো কমিশন একটি ইলেক্ট্রোরাল কলেজ পদ্ধতি চালু করার কথা বলেছে।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ফাংশনে বলা আছে তাদের দায়িত্ব কী হবে। তবে এই জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল যখন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে না, পার্লামেন্ট ডিজলভব হবে, তখন পর্যন্ত এটা বহাল থাকবে। আবার যখন পার্লামেন্ট না থাকে তখন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হয়ে যায় মাত্র পাঁচজনের একটা কমিটিতে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও দু’জন উপদেষ্টা চিফ জাস্টিস ও প্রেসিডেন্ট থাকেন। দায়িত্ব একই থাকবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত। এরকম একটি কর্তৃপক্ষ- যেটা প্রস্তাব করা হয়েছে তাদের যে দায়িত্ব এটা এখন নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে হয়।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবে আগের মতোই একমত নয় বিএনপি। এই কাউন্সিলের জবাবদিহিতা না থাকায় সমর্থন করে না বিএনপি। এই কাউন্সিলে আরেকটি ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করি আমরা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এক নম্বর দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেটা যদি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় যেটা হয়েছে অলরেডি। যদি আমরা নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে, আইনিভাবে ফাংশন করতে দেই তাহলে এই দুটো জিনিসের মধ্যদিয়ে নির্বাহী বিভাগ এবং পার্লামেন্ট সর্ম্পূণভাবে স্বৈরাচারী হওয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেবে। যদি ত্রুটি থাকে, সেটা দেখবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা।
এদিকে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক শেষে সরকার ও বিএনপি’র যৌথ বিবৃতি প্রকাশের মধ্যদিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, বিদেশের মাটিতে একটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে সরকারপ্রধানের বৈঠক শেষে বিবৃতি পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে আমরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিব্রত। এ কারণেই ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবার বৈঠকে আমরা অংশগ্রহণ করিনি। তবে প্রধান উপদেষ্টাসহ কমিশনের অনুরোধে আজকে এসেছি। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের পক্ষে নীতিগতভাবে একমত আমরা।
ডা. তাহের বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী- আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়তো এখনো বুঝেননি। কারণ যিনি এক মাসে একটি ভবনের তালা খুলতে পারেননি, তিনি নির্বাচনের সময় কী করতে পারবেন তা জানা হয়ে গেছে। সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষে জামায়াত উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে এর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতির সম্পৃক্ততা চাই না। কারণ তারা দুইজনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়াও কোনো বিষয়ে বিরোধ হলে সমাধান করবেন কে? তাই সেখানে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ও স্পিকার থাকবেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আমরা বলতে চাই, যারা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে, তারা মূলত ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান। তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশন থাকার পরও বিগত ১৬ বছরে তারা কোনো কথা বলেনি। দুদক ও নির্বাচন কমিশন তাদের কার্যক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। কারণ, তারা একটি দল ও ব্যক্তির আজ্ঞাবহে পরিণত হয়েছিল। নির্বাহী বিভাগের অসম ক্ষমতা হ্রাস করতেই আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। তাই আমরা এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছি। তবে এখানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। পাশাপাশি এনসিসিতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত নয়। এটা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, মৌলিক সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে প্রয়োজনে গণভোটে যেতে হবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যারা ক্ষমতায় যেতে চান, তারা সংস্কার চান না। বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কমিশনের নিয়োগ তারা আগের মতো নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখতে চান। আমরা মনে করি, এ পদ্ধতিতে নিয়োগের কারণে অনেক সময় দলীয় ও আঞ্চলিকতা কাজ করে। এতে সঠিক ব্যক্তি বাছাই করা হয় না। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, বাসদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, জাসদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণ-অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণফোরামসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
জামায়াতকে সময় বেশি দেয়ায় বের হয়ে গেল সিপিবি ও গণফোরাম: এদিকে জামায়াতে ইসলামীকে বেশি কথা বলতে দেয়া ও বৈষম্যের অভিযোগ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম। কিছুক্ষণ পর আবার বৈঠকে ফিরে যান তারা। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বেলা পৌনে তিনটায় আবার বৈঠক শুরু হয়। এক ঘণ্টা পর সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বেরিয়ে আসেন। রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এখানে বৈষম্য হচ্ছে। জামায়াতের তিনজনকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। আমাদের একজন বক্তব্য দিতে গেলেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ জানালে, কমিশন তা নোট করে। তাই আবার সংলাপে ফিরে যাচ্ছি।
গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তারা নিরপেক্ষ না হলে আমরা সংলাপে ফিরবো না। সিপিবি এবং গণফোরাম নেতাদের সংলাপে ফিরিয়ে নিতে আসেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। ছিলেন সমমনা দল বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহছান হুদা।