প্রথম পাতা
ইরান-ইসরাইল সংঘাত
তীব্রতর হচ্ছে যুদ্ধ
মানবজমিন ডেস্ক
১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যুদ্ধ। ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যকার এই যুদ্ধ এখন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসরাইলে মুহুর্মুহু হামলা করেছে ইরান। তাদের কথিত দুর্ভেদ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম’কে ছিন্নভিন্ন করে তেল আবিব সহ ইসরাইলের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত করেছে ইরানের ব্যালিস্টিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। অনেক স্থানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। রোববার দিবাগত রাত এবং সোমবার ভোরে চালানো এসব হামলায় ইসরাইলে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৮ জন। আহত হয়েছে ৯০ জন। তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এ নিয়ে ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪। অন্যদিকে ইরানে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২২৪ জন। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে তেল আবিবে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কাছেই এ হামলায় দূতাবাসের বেশ ক্ষতি হয়েছে। ওদিকে ইরানে হামলা চালিয়ে রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ কাজেমি, তার ডেপুটি হাসান মোহাকিক সহ মোট তিনজন জেনারেলকে হত্যা করেছে ইসরাইল। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এক ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করেছে ইরান। এর আগে ইসরাইলের হামলায় রেভ্যুলুশনারি গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি, সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ডেপুটি অপারেশন্স মেহেদি রাবানি, ডেপুটি ফর ইন্টেলিজেন্স গোলাম রেজা মেহরাবি, এরোস্পেস প্রধান আলি আকবার হাজিজাদেহ সহ বিপুল সংখ্যক পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইসরাইল ধ্বংস করে দিয়েছে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, বিমানবন্দর, তেলের ডিপো। একটি দেশের এসব কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়ার পর তার আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কথা নয়। কিন্তু ইরান আগের চেয়ে বরং শক্তিশালী হয়ে, আরও মনোবল বৃদ্ধি করে ইসরাইলে হামলা জোরালো করেছে। এতে প্রমাণ হয়, সেখানে কমান্ডিং পজিশনে বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চেইন অনেক দীর্ঘ। হাতেগোনা কয়েকজনকে হত্যা করে তাদেরকে দমানো যাবে না। তারা সেই ‘হাউস অব ডেড’-এর বসের মতো মুহূর্তেই রূপ পাল্টে পুনর্গঠিত হয়ে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। রোববার রাতে ইসরাইলের আকাশ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ‘বৃষ্টি’তে আলোকিত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দিক থেকে, নানা কৌশলে সেসব ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব, কিরিয়াত গাট সহ বিভিন্ন শহরের আকাশকে আলোকিত করে আঘাত হানে টার্গেটে। এর ফলে তেল আবিবে চরম আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা ও হতাশা দেখা দেয়। সিএনএনের জেরুজালেম প্রতিনিধি জেরেমি ডায়মন্ড জানিয়েছেন, হামলার স্থানগুলোয় ছড়িয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ। সেনা ও উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিতদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছিলেন। তেল আবিবের একটি আবাসিক এলাকার ওপর চারটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় ইয়েমেন ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। চীন উভয় পক্ষকে সংযত থেকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ, সিরিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে সহায়তা দিয়েছিল রাশিয়া, ইরান। তাদের মধ্যে ওই সময়ে চমৎকার সখ্য দেখা গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া এবার ইরানের পাশে প্রকাশ্যে না দাঁড়িয়ে গা বাঁচানো বিবৃতি দিচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কাজ করছেন বলে বলা হচ্ছে। ওদিকে, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় রাশিয়াকে সামরিক সহ বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তা করেছে ইরান। এখন বিপদের দিনে তার পাশে নেই রাশিয়া। এর অর্থ ইরান খুব বেশি একা হয়ে পড়েছে। তার পাশে নেই স্বজাতি মুসলিমরা। নেই আঞ্চলিক দেশগুলো। এমন অবস্থায় ইসরাইলের মতো আঞ্চলিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরান টিকে আছে- এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। ইরান জানিয়েছে, চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনোরকম পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হবে না তারা।
এদিকে রয়টার্স এক খবরে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের পথে রওয়ানা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিটজ। জাহাজের অবস্থান শনাক্তকারী ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্যে দেখা গেছে, সোমবার সকালে ইউএসএস নিমিটজ দক্ষিণ চীন সাগর ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে যাত্রা করে। সপ্তাহের শেষদিকে রণতরীটির ভিয়েতনামের ডানাং বন্দরে নোঙর করার কথা থাকলেও সেই সফর বাতিল করা হয়েছে। এক কূটনীতিক জানিয়েছেন, হ্যানয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তাকে জানিয়েছে, উদ্ভূত সামরিক প্রয়োজনে ইউএসএস নিমিটজের ভিয়েতনাম সফর বাতিল করা হয়েছে। ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার মধ্যে এই খবর রীতিমতো উদ্বেগের।
এরমধ্যে ইরান প্রকাশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচিতে প্রবেশ করতে চাইছে। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বের হয়ে আসতে পার্লামেন্টে বিল উত্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে তারা। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘেই বলেছেন, এনপিটি চুক্তি বাতিল করতে কাজ করছে ইরানের পার্লামেন্ট। যদিও তেহরানের অবস্থান গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টের কারণেই এবার এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইরান। তবে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে দেশটি। ইতিমধ্যেই ইসমাইল ফকির নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে তারা। এ ছাড়া যারা ইসরাইলের ওই গোয়েন্দাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার সন্দেহে আটক হয়েছেন তাদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন ইরানের প্রধান বিচারপতি গোলামহোসেই মোহসেনি এজেই। বলেছেন, জায়োনিস্টদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে কেউ গ্রেপ্তার হলে খুব দ্রুতই তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এদিকে ইরানের এক- তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করার দাবি করেছে ইসরাইল। দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফেই ডেফরিন টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইরানের মোট ক্ষেপণাস্ত্রের ৩০ শতাংশ ধ্বংস করা হয়েছে। এ কাজে অন্তত ৫০ যুদ্ধবিমান নিয়োগ করা হয়। ওই মুখপাত্র দাবি করেন, কমপক্ষে ১২০টি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করেছে তার দেশের সেনারা। সংঘাতের চারদিনে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ৩৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। দেশটির হোম ফ্রন্ট কমান্ড এ দাবি করেছে। তারা জানিয়েছে, প্রতি হামলায় ৩০ থেকে ৬০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান। অন্যদিকে ইরানের দাবি তারা এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান। অনির্দিষ্টকালের জন্য ইরানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী সকল ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামাবাদ। দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কাদির বখশ পিরকানি এএফপিকে বলেন, চাগাই, ওয়াশুক, পাঞ্জগুর, কেচ ও গাদার-এই পাঁচ জেলার সব সীমান্ত কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। পাকিস্তানের এই পাঁচ জেলার সঙ্গে ইরানের সীমান্ত রয়েছে। চাগাই জেলার সীমান্ত কর্মকর্তা আতাউল মুনিম বলেছেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইরানে প্রবেশ বন্ধ থাকবে। তবে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। ইরান থেকে পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশে ফেরার সুযোগও থাকছে। আতাউল মুনিম বলেন, সোমবার প্রায় ২০০ জন পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ফেরার কথা রয়েছে।
তেলের দাম ফের ঊর্ধ্বমুখী, হরমুজ প্রণালি নিয়ে উদ্বেগ: দুই দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান দেখা না যাওয়ায় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ইতিমধ্যে গত সপ্তাহে ৭ শতাংশ দাম বাড়ার পর রোববার তেলের দাম আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৭৩.৮৫ ডলার, যা গত সপ্তাহের তুলনায় ১.২ শতাংশ বেশি। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্রেন্ট তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলার, যা ১ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। ওদিকে, সোমবার ভোরে ইসরাইলের উপকূলীয় শহর হাইফায় ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় একাধিক ভবন ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়। হামলার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হাইফার একটি তেল শোধনাগারের আশপাশে বিস্ফোরণ ঘটছে এবং আগুন জ্বলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল রপ্তানির সম্ভাব্য বিঘ্ন এবং হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রতিদিন শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বৈশ্বিক তেল সরবরাহ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সংঘাত আরও বিস্তৃত হয় এবং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ওমানকেও টেনে আনে, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়তে পারে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার এই প্রবণতা আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জ্বালানি খাতে চাপ আরও বাড়তে পারে।