প্রথম পাতা
ট্রাম্পের প্রস্তাব নাকচ খামেনির
মানবজমিন ডেস্ক
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবারনিজের অবস্থানে অনড় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। কথা একটাই- ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে। তবে তার এ কথা প্রত্যাখ্যান করেছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করবে না তার দেশ। ইরান-ইসরাইল সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো বুধবার হোয়াইট হাউস প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি বলেন, আমি আগে যেটা বলেছি- তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় এ যুদ্ধ কতোদিন চলবে তা নিশ্চিত নন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার এ কথায় ইরান-ইসরাইল সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। কার্যত এমন উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের মধ্যদিয়ে দুই নেতা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। এর আগে ইরানকে লক্ষ্য করে নিজের ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া পোস্টেও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ প্রস্তুত করা হয়েছে। বৃটেন থেকে আনা হয়েছে যুদ্ধবিমান। ইসরাইলও প্রস্তুত। যেকোনো মুহূর্তে ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা সহ বিভিন্ন এলাকাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। যদিও এতদিন পরে রাশিয়া ও চীন সোচ্চার হয়েছে। মুখ খুলেছে মুসলিমদের যেকোনো বিপদে পাশে দাঁড়ানো তুরস্কও। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেছেন, ইরান আত্মরক্ষা করছে। তার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কথা সবাই বলছেন। ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কতা দিয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাফ জানিয়ে দিয়েছেন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধী তিনি। ওদিকে দৃশ্যত এই যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো যুদ্ধে যুক্ত হতে হলে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুমোদন নিতে হয় কংগ্রেসের। সেই অনুমোদন না নিয়েই তিনি যুদ্ধে যুক্ত হবেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা চলছে। তবে এর আগে অনুমোদন না নিয়েই মার্কিন সাবেক প্রশাসন বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করেছে। বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাবলে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার ইন চিফ। তিনিও তা পারেন। ভয়াবহ যুদ্ধ উত্তেজনায় কাঁপছে মধ্যপ্রাচ্য। সম্ভবত এই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকছে না। ভয়াবহ এই সংঘাত হয়তোবা পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এমনটা টের পেয়ে ইরান তার প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়।
বিশেষ করে পারমাণবিক যুদ্ধের আতঙ্ক বিরাজ করছে এই কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নজর পড়েছে ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনায়। এটি কোম নগরে অবস্থিত। একটি পাহাড়ের নিচে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ মিটার গভীরে এর অবস্থান। খবরে বলা হচ্ছে, এই স্থাপনা ধ্বংস করতে হলে কমপক্ষে ১৩,৬০০ কেজি ওজনের বোমা প্রয়োজন হবে। এই বোমা বহন করে সেখানে ফেলার মতো যুদ্ধবিমান নেই ইসরাইলের হাতে। তা আছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। নাম বি-২ স্টিলথ যুদ্ধবিমান। এই বিমান ব্যবহার করে যদি ইরানে জিততে পারেন তাহলে আরও শক্তির অধিকারী হয়ে উঠবেন ট্রাম্প। হয়তো তিনি এখন সেই যশ বা খ্যাতির লোভে পড়েছেন। ১৩,৬০০ কেজি ওজনের একটি বোমা বিস্ফোরিত হলো কি ইরান টিকে থাকবে! আগাম বলা যায় না পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়। যেকোনো সময় পাল্টে যেতে পারে দৃশ্যপট।
ইরান-ইসরাইল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এখন পুরোপুরি স্পষ্ট। ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে ট্রাম্প যেভাবে কথা বলছেন তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই আতঙ্কের। ইরানের জন্য তো বটেই। ট্রাম্প সোমবার তার ট্রুথ সোশ্যালে খামেনিকে লক্ষ্য করে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন। তার দাবি, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কোথায় আছেন সেটা তিনি জানেন। এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমরা ঠিক জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি সহজ লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু আপাতত আমরা তাকে হত্যা করবো না।’ খামেনিকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও লেখেন, ‘আমরা চাই না সাধারণ মানুষের ওপর কিংবা মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হোক। আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।’ ট্রাম্প এর আগে আরও দুটি পোস্টে বলেন, আমাদের এখন ইরানের আকাশে সম্পূর্ণ ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তিনি দাবি করেন, ইরানের কাছে উন্নত স্কাই ট্র্যাকিং সিস্টেম ও প্রচুর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু আমেরিকান প্রযুক্তির কাছে তা কিছুই না। সর্বশেষ পোস্টে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ইংরেজিতে লিখেছেন-আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার। অর্থাৎ শর্তহীন আত্মসমর্পণ (করতে হবে ইরানকে)। ইরানকে তিনি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন এর মধ্যদিয়ে। এদিকে ট্রাম্পের হুমকির কড়া জবাব দিয়েছেন খামেনি। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো অবস্থায়ই আত্মসমর্পণ করবে না ইরান। ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে খামেনি বলেন, জোর করে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে ইরান। দেশটি দৃঢ় থাকবে জোর করে চাপিয়ে দেয়া শান্তির বিরুদ্ধেও। তিনি আরও বলেন, ইরান কারও কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। বুধবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে এসব বলেছেন খামেনি। ট্রাম্পের বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বলেছেন, যারা ইরান ও এর ইতিহাস জানে তারা জানে, ইরানিরা হুমকির ভাষার প্রতি ভালো সাড়া দেয় না। আর আমেরিকানদের জানা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপ্রতিরোধ্য পরিণতি বয়ে আনবে।
এদিকে ইরান-ইসরাইল সংঘাতের ৬ষ্ঠ দিনে নড়াচড়া দিয়েছে রাশিয়া। ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করেছে দেশটি। বুধবার রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ সতর্ক করে বলেছেন, ইসরাইলকে সরাসরি মার্কিন সহায়তা দেয়া মধ্যপ্রাচ্যকে পুরোপুরি অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ ছাড়া এ ধরনের ‘অনুমানমূলক বিকল্প’ বিবেচনা করার বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছেন তিনি। রিয়াবকভ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ পুরো পরিস্থিতিকে আরও ব্যাপকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সূত্র জানায়, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এসব খবর সামনে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে এসব সতর্কবার্তা দিলো মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট সমঝোতা চাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকট নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন পুতিন। ফোনালাপে পুতিন জানিয়েছেন, এই সংকটে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রাশিয়া। এক্ষেত্রে অন্যান্য আঞ্চলিক মিত্রদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।