প্রথম পাতা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনে ঐকমত্য
স্টাফ রিপোর্টার
২০ জুন ২০২৫, শুক্রবারপ্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যদের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন পদ্ধতিতে কাছাকাছি মতামত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতির পরিবর্তনে একমত দলগুলো। তারা বলছে, উচ্চকক্ষ গঠিত হলে এখানকার ১০০ আসন, নিম্নকক্ষের ৩০০ ও নারী ১০০ আসনের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা যাবে। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার চতুর্থ দিনের বৈঠক শেষে এমন মত জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আলোচ্যসূচিতে ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধান, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ।
বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনে একমত পোষণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে একমত পোষণ করেছে অধিকাংশ দল। উচ্চকক্ষের আসন সংখ্যা ১০০তে উন্নীত করার বিষয়েও সবাই একমত পোষণ করেছে।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করার জন্য সবাই একমত পোষণ করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে আলোচনা করেছি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জানিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন রোববার এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কী হবে, রাষ্ট্রপতি কী কী বিষয়ে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে ইলেকটোরাল কলেজ হবে কিনা এসব নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তাই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, এনসিসি নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বিদ্যমান পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে ৫০০ সংসদ সদস্যের গোপন ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়া উচিত, তাহলে সচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে। তবে এ নিয়ে আমার দল থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদ সদস্যদের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেয়ার জন্য অধিকাংশ দল প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়াও পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সংসদ সদস্য নির্ধারণ না করার জন্য বিএনপি’র পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, যেহেতু আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ ওপেন করেছি, তাই আমরা মনে করি সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সেখানে গোপন ভোট হতে পারে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সিদ্ধান্ত এখনো পেন্ডিং রাখা আছে। দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। তবে পিআর পদ্ধতিতে আপার হাউস ভোট রাখা হলে অর্ধেক মেজরিটি পাবে না, তাই এটি আমরা সমর্থন করি না।
জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আলোচনায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য সবাই একমত পোষণ করেছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সংসদ সদস্যরা গোপন ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। আমরা এক্সটেন্ডেড ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু আমরা প্রস্তাব দিয়েছি স্থানীয় সরকার নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করতে হবে। তাহলে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিলে কোনো বিতর্ক হবে না। সকলে মিলে যে পর্যায়ে গেলে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে, সেখানে জামায়াতে ইসলামী তার মতামত দিতে ছাড় দেবে। দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার জন্য অধিকাংশ দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ১০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ সংসদের পক্ষে প্রায় সকল দল একমত হয়েছে। দু’বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে। সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি।
অভিযোগ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোতে এখনো আওয়ামী লীগের অংশীদাররা উপস্থিত আছে। এটি সরকারের ব্যর্থতা।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী সব রাজনৈতিক দল। নিম্ন্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ হলে সরাসরি উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের ৫০০ সদস্যের ভোটের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। আরেকটা প্রস্তাব এসেছিল ইলেক্টোরাল কলেজের বিষয়ে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতিতে আমরা কাছাকাছি যেতে পারবো। আমরা আশাবাদী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে পদ্ধতি নিয়ে আমরা ঐকমত্য আসতে পারবো।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে সবাই একমত। ইলেক্টোরাল কলেজের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের সবাই যুক্ত হবেন। আমরা মনে করি, প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যটাই জরুরি। ন্যূনতম ঐকমত্য হলে ইলেক্টোরাল কলেজসহ বাকি বিষয়ে আমরা ছাড় দিতে রাজি আছি।
গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে অনুষ্ঠিত আজকের সংলাপে বিদ্যমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিবর্তনের বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, যদি সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়, তাহলে উচ্চ ও নিম্ন্নকক্ষের ৫০০ সদস্য গোপন ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। এতে করে সংসদ সদস্যরা নিজেদের দলের প্রার্থীর বিপক্ষেও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।
নুরুল হক আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের যুক্ত করার সুপারিশ ছিল। তবে গণ-অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ বা কাউন্সিলরদের পরিবর্তে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশনের মেয়রদের ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে সর্বমোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৭৬ জন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক শরিক দলকে আলোচনায় ডাকা হয়েছে, যারা ১৪ দলীয় জোটের অংশ ছিল। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছি। শুনেছি, কোনো কোনো দলের সিনিয়র নেতাদের সুপারিশে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া দু-একটি দলের প্রস্তাবকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই দু-একটি দলের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান হয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, বাসদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, জাসদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণ-অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণফোরামসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।