বাংলারজমিন
বিষাক্ত শিশু খাদ্য তৈরি করে কোটিপতি ওরা
সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের আটকেপড়া পাকিস্তানি ক্যাম্প, কুলি মহল্লাসহ পাড়ায় পাড়ায় অবাধে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লোমেট মিশ্রিত ললি ও বালিশ নামের শিশুখাদ্য। একইসঙ্গে উৎপাদন করা হচ্ছে চকলেট, আচার, চানাচুর, চিপ্স, লিচি ও ম্যাংগো জুস এর রকমারি খাদ্য। প্রস্তুতকারকরা উৎপাদিত ভেজাল শিশুখাদ্য সৈয়দপুরের চাহিদা পূরণ করে উত্তরের ৮ জেলায় সরবরাহ করছেন। আর এসব উৎপাদনকারী টোকাই থেকে কোটিপতি বনে গেছেন।
জানা গেছে, চিনি ও স্যাকারিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত শিশুখাদ্যে সোডিয়াম সাইক্লোমেট বা ঘনচিনি ব্যবহার করছেন। সেই সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল রং। এসব খাদ্যে পানির সঙ্গে ক্ষতিকর রং, ঘনচিনি, বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভারের সঙ্গে সাইট্রিক এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের এক সদস্য জানান, ঘনচিনি হলো আখের চিনির চেয়ে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। এই ঘনচিনি শিশুর শরীরে প্রবেশ করলে কিডনি, লিভার ও পাকস্থলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৮০ ভাগ। এর ফলে সোডিয়াম সাইক্লোমেট খাবারে মেশানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রশাসন তৎপর থাকায় মাঝে মধ্যে ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে চলে। কিন্তু ৫ই আগস্টের পর পুলিশ একেবারেই নিস্ক্রিয় হওয়ায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব শিশুখাদ্য।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, হাতিখানা ক্যাম্পের ভলু, কালাম, মুন্সী ও জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন বিভিন্ন কোম্পানির মোড়কে ওইসব বিষাক্ত শিশু খাদ্য উৎপাদনের পর রংপুরের ৮ জেলায় বিক্রি করে বনেছেন টোকাই থেকে কোটিপতি। গড়েছেন বহুতল ভবন। কিনেছেন জমি-জায়গা। করেছেন ব্যাংক ব্যালেন্স। অথচ তারা অবৈধ ব্যবসা করতেই ক্যাম্পে বসবাস করছেন। এর কারণ হলো- ক্যাম্পে থাকা ও বিদ্যুৎ ফ্রি। আর ক্যাম্পে বসবাস করে অসহায় ভেবে অভিযান চালানো হয় না। তারা বলেন, পানীয় তৈরি করতে প্রয়োজন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিএসটিআইসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন। এর সঙ্গে পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ প্রধান কর্তৃক ট্রেডলাইসেন্স ও মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবসহ থাকতে হবে কেমিস্ট। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ওই ধরনের বৈধ কোনো কাগজপত্রই নেই। অপরদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ভোক্তা অধিদপ্তরের লোকজন ও বিএসটিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালালে সৈয়দপুর শহর থেকেই কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় সম্ভব।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, শহরের কাঁড়িহাটি রোডের প্রায় ১২-১৫টি দোকানে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ক্ষতিকারক ওইসব শিশুখাদ্য। অনেকে রং- বেরংয়ের শিশুখাদ্য উৎপাদনের পর এসব দোকান থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে রংপুর, বগুড়া, নীলফামারী, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর তাদের উৎপাদিত পণ্যের ওপর লেখা রয়েছে মেড ইন ঢাকা। তবে বিএসটিআই’র অনুমোদনের কোনো চিহ্ন দেয়া নেই। বাবুয়া নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, হাতিখানা ক্যাম্পে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী ভলুর কারণেই কাঁড়িবিহারী হাটি রোডে ভেজাল শিশুখাদ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। সে মাত্র ৪-৫ বছর আগেও ২ বেলা খেতে পারতো না। কিন্তু বর্তমানে ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে কোটি টাকার মালিক। শুধুমাত্র মানহীন শিশুখাদ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ার ফলেই ফুটপাথ থেকে অনেকেই বর্তমানে কোটি টাকার মালিক। বিহারী ক্যাম্পের নেতা মোলামসহ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ ব্যবসায়ীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। তাদের উৎপাদিত শিশুখাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির জেনেও নিজে অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ায় কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না। সৈয়দপুরের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াসিমুল বারী জয় ও মেডিকেল বিশেষজ্ঞ মাসুম আল আরেফিন বলেন, ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লোমেট মিশ্রিত খাদ্য শিশুদের পেটে গেলে শিশুদের পেটের মারাত্মক পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অচিরেই এসব বিষাক্ত শিশুখাদ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের নীলফামারীর সহকারী পরিচালক শামসুল আলম জানান, জনবল সংকট রয়েছে দপ্তরে। তারপরও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা অব্যাহত রয়েছে। শিশুখাদ্য ভেজাল করে বাজারের ছাড়ার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনার কথা জানান- তিনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, কেউ যদি ভেজাল শিশুখাদ্য তৈরি করে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।