শেষের পাতা
তিন কর্মকর্তার যোগসাজশ
অগ্রণী ব্যাংকের ১৩ কোটি টাকা পাচার
এ.জে. সুজন, কুষ্টিয়া থেকে
১৮ জুন ২০২৫, বুধবার
অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখার তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে কুষ্টিয়ার এক শিল্পপতি অবৈধভাবে ১৩ কোটি টাকার এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছেন। কুষ্টিয়া অঞ্চল প্রধান ডিজিএম সাবিনা সুলতানা, ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক এজিএম এনামুল হক ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তা তানভীরের যোগসাজশে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। দেশের দু’টি ব্যাংকে ঋণ খেলাপি কুষ্টিয়ার কেএনবি এগ্রো ফিড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এসএম কামরুজ্জামান এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার করে কোনো টাকা জমা দেননি বলে ব্যাংক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
এদিকে, কুষ্টিয়া বড় বাজার শাখার এজিএমকে আগামী তিন দিবসের মধ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেয়া ৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৭০ দশমিক ৫৮ ডলার সমপরিমাণ টাকা ফেরত দিতে চিঠি দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখার বৈদেশিক বাণিজ্যিক বিভাগ। ঋণ খেলাপির তথ্য গোপন করে সকল নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে কামরুজ্জামান নাসিরকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে সহযোগিতা করেছেন অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি কুষ্টিয়া বড় বাজার শাখার কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এলসি প্রদান করতে হলে শতভাগ মার্জিন রেখে গ্রাহককে এলসি সুবিধা প্রদান করতে হবে। কিন্তু শিল্পপতি কামরুজ্জামানের প্রতিষ্ঠানকে কোনো রকম মার্জিন না রেখে অবৈধভাবে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এলসি সুবিধা প্রদানের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন্স অনুযায়ী সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানে একটি ক্ষেত্রেও সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়নি। সিআইবি রিপোর্টে অন্য কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রদর্শিত হলে সেই গ্রাহককে নতুন কোনো সুবিধা প্রদান করা যাবে না।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া ডিজিএম সাবিনা সুলতানা বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন। তাদের অনুমতি ছাড়া আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না। অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া বড় বাজার শাখা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৯ই জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত ১৯টি এলসি খোলা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯টি এলসির মাধ্যমে ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫৭ মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ কোটি ৫৯ লাখ ২৩ হাজার ৮৩২ টাকা পাচার করা হয়। এই টাকার বিপরীতে কোনো জামানত নেয়া হয়নি কিংবা এখন পর্যন্ত ব্যাংকে ফেরত দেয়া হয়নি। ব্যাংকের অঞ্চল প্রধান ডিজিএম সাবিনা সুলতানা, ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক এজিএম এনামুল হক ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা তানভীরের পরস্পর যোগসাজশে হওয়ায় বিষয়টি কেউ জানতো না।
সূত্রটি জানায়, এলসি’র বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি নিয়ে বিল পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়কে অবহিত না করেই সুইফট মেসেজ ট্রান্সফার করে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে। ব্যাংকের ডিজিএম সাবিনা সুলতানা ও এজিএম এনামুল হকের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে শাখা ব্যবস্থাপক এজিএম এনামুল হক বলেন, কেএনবিকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এলসি সুবিধা দেয়া হয়নি। যখন এলসি করা হয় তখন তিনি কোনো ব্যাংকের খেলাপি ছিলেন না। গত ১৫ই মে অভিযুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা তানভীরকে বদলি করা হয় অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যালিটি বাজার শাখায়। নতুন কর্মকর্তা যোগদান করে দেখতে পান ওই প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এলসি খোলা হয়েছে। তিনি বিষয়টি তাৎক্ষণিক এজিএম ও ডিজিএমকে জানালে তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু কোনো সুরাহা না হওয়ায় বিষয়টি অগ্রণী ব্যাংক খুলনা বিভাগীয় জিএমকে জানানো হয়। পরে এ বিষয়ে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন কর্তৃপক্ষ।
কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার তানভীর আরও দু’টি শাখায় ঋণ জালিয়াতি করায় তার নামে অডিট আপত্তি রয়েছে। যা এখনো চলমান। তানভীরের অফিসার ক্যাশ পদবি হলেও তিনি ক্যাশ বিভাগের দায়িত্ব না দিয়ে তাকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কে দায়িত্ব দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখা এবং আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ঢাকা দিলকুশা শাখায় বিপুল পরিমাণ টাকা খেলাপি কুষ্টিয়ার কেএনবি এগ্রো ফিড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এসএম কামরুজ্জামান নাসির। আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, কেএনবি এগ্রো ফিডের নামে মালিক কামরুজ্জামান নাসির ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক দিলকুশা শাখা থেকে ২৩০ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেন। যার সুদে আসলে বর্তমানে ২৩৫ কোটি টাকার বেশি বলে জানা যায়। ইতিমধ্যে অর্থঋণ আদালতে কয়েকটি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সিটি ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখার একটি সূত্র জানায়, কেএনবি ফিড ও কেএনবি ফ্লাওয়ার মিলস নামের দুই প্রতিষ্ঠান এই শাখায় ঋণ খেলাপি। প্রতিষ্ঠান দু’টির মালিক কামরুজ্জামান নাসির।
অগ্রণী ব্যাংক খুলনা বিভাগীয় জেনারেল ম্যানেজার সামছুল আলম বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেছেন। দু’-একদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেএনবি এগ্রো ফিড লিমিটেডের জিএম জাহিদুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না। ব্যাংকের বিষয়টি সরাসরি মালিক নিজেই দেখভাল করেন। এলসি বা ঋণ খেলাপি বিষয় আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে কেএনবি এগ্রো ফিড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী কামরুজ্জামান নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করে বারবার কেটে দেন। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।