ঢাকা, ১৫ জুন ২০২৫, রবিবার, ১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ক্ষুব্ধ জামায়াত এনসিপি

স্টাফ রিপোর্টার
১৫ জুন ২০২৫, রবিবার

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক পরবর্তী যৌথ বিবৃতি নিয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মধ্যে। নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান গ্রহণযোগ্য হলেও কেবল একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করায় ক্ষুব্ধ দল দু’টি। লন্ডন বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে সরকার এবং বিএনপিকে সমশক্তি হিসেবে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করছে জামায়াত। এর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় ঘটেছে ও একটি দলের প্রতি সরকারপ্রধানের বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। এতে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করে দলটি। অন্যদিকে এনসিপি বলছে, একটি দলকে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ তৈরি করছে সরকার। যেটি অভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। দলটি মনে করে বিচার ও সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়া এভাবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করে দিলে জনগণের মনোযোগ বিচার-সংস্কার থেকে অন্যদিকে চলে যাবে। দলটির নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। 

জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের  বৈঠকে লন্ডন বৈঠক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরে এ নিয়ে বিবৃতিও দেয়া হয়। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন লন্ডন বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে সরকার এবং বিএনপি সমশক্তি। অথচ জামায়াতই প্রথম বলেছে, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা বলা হচ্ছে এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সরকার যেভাবে শুধু বিএনপি’র সঙ্গে বৈঠক করে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, তা অগ্রহণযোগ্য। তাদের মতে, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু আলোচনার পর ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক করে রমজানের আগে ভোটের ঘোষণা দিলে সব দল এবং সরকারের জন্য ভালো হতো। 

এদিকে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে আগে থেকেই নীরব ছিল জামায়াত। শুক্রবার বৈঠকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শুধু ‘ইতিবাচক’ বলেই মন্তব্য করা হয়। তবে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ ওইদিন রাতে মানবজমিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এপ্রিলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। অপরদিকে বিএনপি’র তরফে ডিসেম্বরে নির্বাচনের জোর দাবি জানানো হয়। এ পর্যায়ে লন্ডন ঘোষণার মাধ্যমে দুই পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে সরে গেছেন। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার তরফে ফের ঘোষণা আসলে ভালো হতো। 

গতকাল জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে লন্ডন ঘোষণা পরবর্তী পরিস্থিতি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। বৈঠক পরবর্তী গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ১৩ই জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যে বৈঠক হয়েছে জামায়াতে ইসলামী এটাকে খুবই স্বাভাবিক মনে করে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে এবং যৌথভাবে বৈঠক করেছেন। তবে গত ৬ই জুন জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন শুক্রবারের যৌথ বিবৃতিতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় ঘটেছে। এর মাধ্যমে তিনি একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে। জামায়াত মনে করে, দেশে ফিরে এসে প্রধান উপদেষ্টার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে তার অভিমত প্রকাশ করাই সমীচীন ছিল। উল্লেখ্য যে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বিগত ১৬ই এপ্রিল একটি বিদেশি মিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ২০২৬ সালের রোজার পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে মর্মে জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু কোনো একটি দলের সঙ্গে আলাপ করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বিবেচিত হতে পারে না। আমরা আশা করি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন। কারণ সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য  নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনকল্পে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করার জন্য জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। প্রসঙ্গত, জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান গত এপ্রিলে দাবি করেছিলেন, রমজানের আগেই যেন ভোটগ্রহণ হয়। পরে দলটি অবস্থান নেয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের। প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে স্বাগত জানায় জামায়াত।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে এনসিপি। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ উল্লেখ করে শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি।

নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে- এ কথা উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন-আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।

জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলে উল্লেখ করেছে এনসিপি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।’

জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।

এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মানবজমিনকে বলেন, বিগত ১ থেকে দেড় মাস বিএনপি’র বক্তব্য দেখলে বুঝা যায় তারা বিচার ও সংস্কার থেকে নির্বাচনে বেশি ফোকাস দিচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও তারা বিচার ও সংস্কার নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তারা জাতীয়ভাবেও নির্বাচনের জোয়ার তুলে বিচার-সংস্কারকে গুরুত্বহীন করে তুলতে চাইছে। তিনি বলেন, আমরা চাই আগামী জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ হয়ে গেলে সরকারকে বিচার কাজ এগিয়ে নিতে হবে। একইসঙ্গে দলগুলোর উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবে। এরপর নির্বাচন ঘোষণা করলে এটি অর্থবহ হবে। অন্যথায় এটি ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে। আদীব বলেন, এনসিপি চায় বিচার ও সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি, এরপর নির্বাচন। নির্বাচন হলে এনসিপি অংশ নেবে। তবে তার থেকে আমাদের বেশি ফোকাস বিচার ও সংস্কারে। 

এ ছাড়াও বৈঠকটিকে গণআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের বৈঠক দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিদেশে মিটিং বসানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
 

পাঠকের মতামত

দুইটাই অপশক্তি।

MU
১৫ জুন ২০২৫, রবিবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status