প্রথম পাতা
ইরান-ইসরাইল সংঘাত, উত্তেজনা
মানবজমিন ডেস্ক
১৪ জুন ২০২৫, শনিবার
গাজার পর ইরান। গাজায় নৃশংসতা ও গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযুক্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে এবার ইরানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে তার বাহিনী। এতে ইরানের সামরিক সক্ষমতা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে দিয়েছে তারা। ইরানের রাষ্ট্র পরিচালিত নূর নিউজ মিডিয়া জানিয়েছে, ইসরাইলের হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৮ জন। আহত হয়েছেন ৩২৯ জন। তবে এই সংখ্যা সরকারি হিসাবের নয়। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে গতকাল কথা বলার কথা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। এর আগে তিনি কথা বলেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সঙ্গে। ইরানে এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরই দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে। সতর্ক করা হয়েছে, এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সেটা হলে বারুদের আগুনে ছারখার হয়ে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে। এতে বিশ্বনেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইসরাইলের হামলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানায় অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি সহ কিছু দেশ ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। দৃশ্যত, এ ইস্যুতে পুরো বিশ্বে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে উত্তেজনার পারদ উঠছেই। তবে তাদের মধ্যে অনৈক্যের কারণেই মুসলিম বিশ্বের অন্যতম দেশ ইরানের এই পরিণতি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। হামলার জবাবে ইসরাইলে প্রায় ১০০ ড্রোন হামলা চালায় ইরান। তবে তাতে ইসরাইলের কী ক্ষতি হয়েছে দেশটির নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কারণে তা পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। পক্ষান্তরে শুক্রবার দিনভর ইরানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল ইসরাইল। সেই খবর ইসরাইলি মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। এরই মধ্যে ইরানকে পারমাণবিক চুক্তিতে রাজি হতেই হবে বলে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, পারমাণবিক চুক্তিতে এখনই রাজি না হলে ইরানে হামলা হবে আরও ভয়াবহ।
অন্যদিকে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। তাদের এমন বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিবিসি। চলছে বিতর্কও। উত্তেজনা দেখা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যেও। ইরানে হামলায় সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে মুসলিম দেশগুলোর মোড়ল বলে পরিচিত সৌদি আরব। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন শত্রুর সম্পর্ক থাকার পর সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে সৌদি আরব। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়েছে। ইসরাইল হত্যা করেছে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামিকে। নিহত হয়েছেন শীর্ষ দুই পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ও ফারেইদুন আব্বাসি। আইআরজিসির অ্যারোস্পেস ফোর্স কমান্ডার আমির আলি হাজিজাদেহকে হত্যা করেছে তারা। ভূগর্ভস্থ সদর দপ্তরে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া হত্যা করেছে কমপক্ষে ৬ জন পরমাণু বিষয়ক বিজ্ঞানীকে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ক্ষণে ক্ষণে এসব সংখ্যা বৃদ্ধির খবর দিচ্ছে। এ ঘটনায় ইরানে শোক ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরাইল এত বড় হামলা চালিয়ে ইরানের এত বড় ক্ষতি করায় তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা, সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তবে কী ইরানের এসব বাহিনীর ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ? তাদেরকে কি বিদেশি অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সহযোগিতা করছে বা করেছে? হামলায় ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি সহ সেনাপ্রধান, ৬ জন পরমাণু বিষয়ক শীর্ষ স্থানীয় বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার ফলে সারা বিশ্বে প্রশ্ন উঠেছে ইরানের যুদ্ধ প্রস্তুতির সক্ষমতা নিয়ে, তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা নিয়ে। সর্বোপরি প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে। ইসরাইল কার্যত যে হামলা করেছে, তার কাছে ইরান যেন আত্মসমর্পণ করেছে বলেই মনে হয়। তা নাহলে কেন একসঙ্গে শীর্ষ সব কর্মকর্তা নিহত হবেন! কীভাবে তাদের অবস্থান ইসরাইল নিশ্চিত করেছে? হামলার সময় তারা কোথায় ছিলেন? তাদের অবস্থান সম্পর্কে কে ইসরাইলকে তথ্য দিয়েছে? এমন অসংখ্য জিজ্ঞাসা এখন জনে জনে।
এর জবাবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেছেন, আইআরজিসি’র বিমান বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের নির্মূল করা হয়েছে। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আইআরজিসি’র বিমান বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডাররা একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সেন্টারে জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। সেখানে সমবেত হন তারা। এ সময়েই ইসরাইল সেখানে হামলা চালায়। তার এ তথ্য এটাই বলে দেয় যে, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিস্তার জালের মতো কতো গভীরে। নিশ্চয়ই ওই বৈঠক সম্পর্কে ইসরাইলের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। যদি তা-ই হবে, তাহলে এই তথ্য তাদেরকে কে দিয়েছে? স্বাভাবিক সমীকরণ বলে দেয়- ইরানের ওইসব নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মোসাদের এজেন্ট। শীর্ষ কর্মকর্তারা কোথায় আন্ডারগ্রাউন্ডে মিটিং করছেন, সেই তথ্য সাধারণ কোনো সেনাসদস্য বা কর্মকর্তার জানার কথা নয়। শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকার কথা। বিশেষ করে একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়ে দেয়- যেকোনো সময় ইরানে হামলা চালাবে ইসরাইল। এরপরও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি ইরান। এর অর্থ কি দাঁড়ায়? তাদের খুব গভীরেই মোসাদের উপস্থিতি আছে? ইসরাইলের আরেক রিপোর্ট শিরদাঁড়া আরও হিম করে দেয়। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের ভেতরেই আছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গোপন ‘এক্সপ্লোসিভ ড্রোন’ ঘাঁটি। ইসরাইল যখন ইরানে হামলা চালায়, তখন সেখান থেকে যোগ দেয় ওই ঘাঁটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। এই সর্বনাশ ইরানের। তারা কোনোভাবেই কী এই ঘাঁটি সম্পর্কে জানে না? তাহলে কি গোয়েন্দাগিরি করলো তারা? এতদিন বলা হয়েছে, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে বা করার দ্বারপ্রান্তে। হামলায় এত শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করার পর সেই কথিত পারমাণবিক অস্ত্র কোথায় গেল? নাকি এর মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে? জবাবে ইরান কঠোর হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই রিপোর্ট গত রাতে লেখা পর্যন্ত ইসরাইলে বড় কোনো প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়নি ইরান। তবে রাতের আঁধার গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় তা বলা কঠিন। এরই মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসসহ বিশ্বের বহু নেতা উভয় পক্ষকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
নিহত শীর্ষ কর্মকর্তা যারা
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম শুক্রবার নিশ্চিত করেছে, ইসরাইলের হামলায় ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে নিহত হয়েছেন দেশটির শীর্ষ ৬ জন পরমাণু বিষয়ক বিজ্ঞানী। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’জন হলেন- মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ও ফারেইদুন আব্বাসী। মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ছিলেন ইসলামী আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। ফারেইদুন আব্বাসী ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিহত তিন পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল হামিদ মিনোচেহর, আহমেদ রেজা জোলফাঘারি এবং আমির হোসেন ফেঘি রাজধানী তেহরানে অবস্থিত শহীদ বেহেশতি ইউনিভার্সিটির শিক্ষাবিদ। নিহত ষষ্ঠ বিজ্ঞানীর সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়নি। খবরে বলা হয়, হামলাটি ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে চালানো হয়। এই হামলায় সালামির মৃত্যু দেশটির সামরিক নেতৃত্বের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়, সালামি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা কৌশলের অন্যতম মুখ্য স্থপতি। তিনি ২০১৯ সাল থেকে আইআরজিসি’র শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ইরানে জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে এবং পাল্টা প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, শত্রুদের এই অপরাধের জবাব দেয়া হবে কঠোরভাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সালামির মতো একজন শীর্ষ জেনারেলের মৃত্যু ইরানের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। এর ফলে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার সংঘাত শুরুর আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে। ইতিমধ্যে ইসরাইল নিজ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছে সম্ভাব্য ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কায়।