প্রথম পাতা
জুলাই আন্দোলন
এখনো স্বজনের খোঁজে তারা
সাজ্জাদ হোসেন
১৩ জুন ২০২৫, শুক্রবার
৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রাজধানী উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হন সোহেল শেখ। কিছুক্ষণ পর পরিবারকে অজ্ঞাত নাম্বার থেকে জানানো হয় আহত সোহেলকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। স্বজনদের দ্রুত সেখানে আসতে বলা হয়। খবর পেয়ে সন্ধ্যায় ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ছুটে যান স্ত্রীসহ স্বজনরা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় সোহেল শেখ নামে কোনো ব্যক্তি ভর্তি নেই, হাসপাতালে আসা নিহতদের লাশও ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এরপর পরিবার ছুটে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানেও সোহেল শেখকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও তার হদিস পায়নি পরিবার। ৫ই আগস্টের পর ১০ মাসের অধিক সময় পার হলেও আজও অটোচালক সোহেলের সন্ধান মেলেনি। এখনো স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী আয়শা আক্তার ও তাদের দুই সন্তান সাইমন ও সুমাইয়া। সোহেল নিখোঁজ থাকায় এখনো সরকার বা অন্যকোনো সংস্থা থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পায়নি পরিবারটি।
সোহেলের শ্যালক মহিউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আমার বোনের পরিবার গাজীপুরের টঙ্গীতে থাকতো। গত ৫ই আগস্ট সকালে সোহেল শেখ ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পরে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে সোহেলের স্ত্রী আয়েশার নাম্বারে ফোন দিয়ে বলা হয় সোহেল পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। তাকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ঐদিনই সোহেলের ভাই ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করলে তাকে পায়নি। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, এখানে যারা গুরুতর আহত এবং নিহত হয়েছে, তাদের সবাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরের দিন সোহেলের স্ত্রী ও তার দেবর ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে তাকে খুঁজে পায়নি। এর পরেরদিন আমি বেওয়ারিশ লাশের সন্ধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়, ক্রিসেন্ট হাসপাতাল সহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করে কোথাও পাইনি। তিনি বলেন, আমার বোন জামাই আটোরিকশা চালিয়ে যা আয় করতো তা দিয়েই চলতো তাদের সংসার। তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পক্ষেও তাদের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না। বর্তমানে দুই সন্তানসহ আমার বোন আমাদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে আছেন। কিন্তু আমাদের পরিবারেও টানাপড়েন। আমার রাজমিস্ত্রি বাবার পক্ষেও এত জনের সংসার চালানো কঠিন। মহিউদ্দিন বলেন, উত্তরার একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যতীত কোনো সহায়তা পায়নি আমার বোন। কয়েকবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাইন্ডেশনে যোগাযোগ করলেও নিখোঁজদের জন্য ফাইন্ডেশনের পক্ষে সহায়তা করা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়।
এদিকে শনিরআখড়া পূর্ব কদমতলী ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো শহিদুল ইসলাম মিরাজ। পড়াশোনার খরচ জোগাতে কাপ্তান বাজারে একটি ফিল্টার তৈরির দোকানে চাকরি করতো সে। গত ২৭শে জুলাই পরিবারকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয় মিরাজ। ঐদিন আর বাসায় ফেরেনি সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও মিরাজকে আর পাওয়া যায়নি। মিরাজের ভাই সাইফুল ইসলাম মৃদুল মানবজমিনকে বলেন, মিরাজের নিখোঁজের সময় যাত্রাবাড়ীতে তীব্র আন্দোলন চলছিল। আমরা মিরাজের খোঁজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে বেওয়ারিশ লাশের তালিকা এবং সেখানে থাকা লাশের মধ্যেও মিরাজকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তাকে পাইনি। মৃদুলের প্রশ্ন, আর কতো অপেক্ষা করতে হবে তাদের। এখনো কেন ভাইয়ের লাশও পাবো না? আর কতো অপেক্ষা করলে আমার ভাইয়ের খোঁজ পাবো?
তিনি আরও বলেন, মিরাজের নিখোঁজের সময় যাত্রাবাড়ীতে ধরপাকড় চলছিল। থানায় গেলে সন্ধান মিলবে- এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। মিরাজের নিখোঁজের ব্যাপারে থানায় জিডিও করেছি। কিন্তু থানা কিংবা কারাগার কোথাও তার সন্ধান পাইনি। মৃদুল বলেন, আমাদের পরিবার আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নয়। আমার বড় ভাই সাইফুল ইসলাম মিখিল জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাইন্ডেশনে মিরাজের নিখোঁজের তথ্য দিয়ে সহায়তা চায়। কিন্তু তারা জানায় এখনো জুলাই আন্দোলনে যারা নিখোঁজ হয়েছে সে ব্যাপারে সহায়তা দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আন্দোলনে আরেক নিখোঁজ মোহাম্মদ হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ভাইরাল হলেও লাশ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পায়নি তার পরিবার। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শরীফ জেনারেল হাসপাতালের সামনে হৃদয়কে কাছ থেকে পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে এক পুলিশ সদস্য। গুলিবিদ্ধ হৃদয়ের দেহটি একটি গলির দিকে টেনেহিঁচড়ে নিচ্ছে, এমন অমানবিক একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপরের আর কোনো ফুটেজ নেই। নেই কোনো তথ্য। হৃদয়ের দুলাভাই মো. ইব্রাহিম বাদী হয়ে গত ২৬শে আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় হৃদয়কে গুলি করে হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে মামলা করেন।
সংসারের অভাব-অনটনের জন্য টাঙ্গাইলের হেমনগর ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন হৃদয়। কথা ছিল পরেরদিন গ্রমের বাড়িতে চলে যাবেন। কিন্তু তার আগেই ২০ বছর বয়সী হৃদয়কে পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে দেয় পুলিশ।
হৃদয়ের বড় বোন মোসাম্মৎ জেসমিন মানবজমিনকে বলেন, আমার একমাত্র ভাই হৃদয়। আমার বাবা অনেক বয়স্ক। তিনিও পেশায় রিকশাচালক। বাবা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় হৃদয় ঢাকায় এসে অটোরিকশা চালাতো। বেশ কিছু টাকাও উপার্জন করেছিল। কিন্তু পুলিশ গুলি করে ভাইটারে মারছে, তার ভিডিও আছে। কিন্তু আমার ভাইটার লাশ আজও খুঁজে পাচ্ছি না। লাশ পাওয়া যায়নি বলে হৃদয়ের পরিবার আজও কোনো অনুদান পায়নি। শহীদের তালিকায়ও জায়গা হয়নি হৃদয়ের।
জুলাই আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে ‘গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে সরকার। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিহত, নিখোঁজ, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের পরিচয় প্রমাণসহ স্বজনদের আবেদন করতে বলা হয়। কিন্তু এখনো নিখোঁজদের ব্যাপারে সেলের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা ও যুগ্ম সচিব মো. মশিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা এখনো নিখোঁজ তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে ছুটির পরে সেলের কাজ শুরু হলে দ্রুতই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।