বিশ্বজমিন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান
বাংলাদেশে কি স্বাস্থ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে?
ড. রাকিব আল হাসান
(২৩ ঘন্টা আগে) ২১ মে ২০২৫, বুধবার, ১২:১১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:৫১ অপরাহ্ন

২০২৫ সালের শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবে এর কম্পন অনুভূত হয়েছে ঢাকায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শতকরা ৩০ ভাগ গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ঘাটতির রিপোর্ট করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। বছরে এখানে যক্ষা বা টিবিতে মারা যান কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষ। এমন দেশে এ বিষয়টি শুধু সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে মাথাব্যথার কারণ ছিল এমন না। একই সঙ্গে এটা ছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এক জরুরি অবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া, বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যখাতে ইউএসএইডের আকস্মিক তহবিল কর্তনের ফলে বাংলাদেশকে একটি যথার্থ ঝড়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একসময় সক্ষমতা উপলব্ধি করছিল বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মোট বাজেট ৬৭০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ায় এই অর্থের শতকরা ১৮ ভাগ চলে গেছে। এর ফলে এই সহায়তার ওপর নির্ভর করা বাংলাদেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কর্মসূচি বিপন্ন হচ্ছে। এই আর্থিক শূন্যতার বাইরেও, এই পদক্ষেপ একটি ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে। তা হলো বহুপাক্ষিকতার যুগে বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে একটি ভঙ্গুর বিশ্ব ব্যবস্থায় চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে আত্মনির্ভরতায় ভারসাম্য রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে।
অগ্রগতির ভঙ্গুর ভিত্তি
গত দুই দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় অর্জন বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার প্রমাণ বহন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ২০১৪ সালে পোলিও নির্মূল করেছে, ১৯৯০ সাল থেকে মাতৃমৃত্যুর শতকরা হার ৭০ ভাগ কমেছে এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালে প্রতি এক হাজারে ১৪৪ জন থেকে কমিয়ে ২০২০ সালে আনা হয়েছে ২৮ জনে। এই মাইলফলক স্থাপন সম্ভব হয়েছে এক্সপ্যান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন (ইপিআর) ও ন্যাশনাল ম্যালেরিয়া ইলিমিনেশন প্রোগ্রামের মতো উদ্যোগে। ইপিআর ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে শতকরা ৯০ ভাগ শিশুকে টিকা দিয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রোগ্রামটি ২০০৮ সাল থেকে ম্যালেরিয়া কমিয়েছে শতকরা ৯০ ভাগ। সামনে আসা চ্যালেঞ্জগুলোকে সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কান্ট্রি কোঅপারেশন স্ট্র্যাটেজি (২০২০-২০২৫)। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে ক্রমবর্ধমান ডায়াবেটিসের হার (প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা ১০ ভাগ এই রোগে আক্রান্ত), মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, জলবায়ুঘটিত হুমকি- যেমন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। ২০২৩ সালে এই রোগে আক্রান্ত হন তিন লাখ একুশ হাজার মানুষ। সংস্থাটি বাংলাদেশের হেলথ পপুলেশন নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রামকেও সহায়তা করেছে। এর উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) অর্জন করা। তা সত্ত্বেও জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ এখনও অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস পায় না। এমন অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তা কমে গেলে কয়েক দশকে কষ্টার্জিত অগ্রগতি বিপরীতমুখী হওয়ার ঝুঁকি আছে।
আর্থিক খাতের পতন
আর্থিক খাতের প্রভাবগুলো তীব্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বছরে ৬৮ কোটি ডলার দিতো যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু বাংলাদেশের জন্য প্রতি বছর গড়ে ১০ কোটি ডলার স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন করে ইউএসএইড। এসব উৎসের কারণে টিবি কর্মসূচি, টীকাদান কর্মসূচি, মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্যোগকে টিকিয়ে রেখেছে, যেখানে বাংলাদেশে টিবি খাতে ১৫ কোটি ডলারের বাজেটের শতকরা ৭০ ভাগের জন্য নির্ভর করতে হয় আন্তর্জাতিক দাতাদের ওপর। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আড়াই কোটি কোভিড-১৯ ডোজ টীকা দিয়েছে। এটা দিয়ে দেশে টীকা দেয়া গেছে শতকরা ৩০ ভাগ মানুষকে। ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত ক্লিনিকগুলোতে বছরে সন্তান প্রসবপূর্ব ২০ লাখ নারীকে সেবা দিয়ে থাকে। এটা একটি দেশের লাইফলাইন, যেখানে মাতৃমৃত্যুর বিষয়টি এখনও উদ্বেগজনক এক সংকট। অর্থনৈতিক চাপের কারণে সুইজারল্যান্ড, বৃটেন ও অন্য দাতারাও তাদের আর্থিক অনুদান কমিয়ে এনেছে। এর ফলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ শতকরা ৪০ ভাগ বাজেট কমানোর সম্মুখীন। এইএনএইডস বন্ধ করে দেয়ায় ৬০ হাজার রোগীর এইচআইভি/এইডস ব্যবস্থাপনা আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিবি ও ম্যালেরিয়া- তারা ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশকে ১১০ কোটি ডলার দিয়েছে। তারাই এখন বিশ্বব্যাপী তাদের ৪০০ কোটি ডলার ঘাটতির কথা জানিয়েছে। এই কাটছাঁটের কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে পড়ার হুমকিতে রয়েছে।
প্রান্তসীমায় সিস্টেম
পরিণতি এরই মধ্যে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, কোভ্যাক্সে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বাদে, বাংলাদেশে নতুন করে ম্যালেরিয়া ও এইচপিভি টীকা দুই থেকে তিন বছর বিলম্বিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নের পরিচালিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে আনায় কক্সবাজারে রোগের ওপর নজরদারি দুর্বল হয়েছে। অথচ কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। যক্ষা চিকিৎসার ওষুধ সরবরাহে ব্যাঘাতের ফলে ওষুধ-প্রতিরোধী স্ট্রেইনগুলো ত্বরান্বিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, এরই মধ্যে শতকরা ৪.৫ ভাগ এর জন্য দায়ী। এই সংখ্যা তিনগুন হতে পারে ২০৩০ সালে।
আত্মনির্ভরতার মরীচিকা
এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার এরই মধ্যে ‘হেলথ সেক্টর সেলফ-রিলায়েন্স ইনিশিয়েটিভ’ উন্মোচন করেছে। এর উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক যেসব ফান্ড হারিয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ করা। এই পরিকল্পনাটি তামাক ও চিনিযুক্ত পানীয়ের ওপর প্রস্তাবিত ‘সিন-ট্যাক্স’-এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির শতকরা ২.৩ ভাগ থেকে শতকরা ৫ ভাগে উন্নীত করার ওপর নির্ভর করে, যা থেকে বার্ষিক ১২০ কোটি ডলার আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলোতে কম খরচে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং এনজিওগুলোর সাথে সরকারি-বেসরকারি অংশদারিত্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা ও ঝুঁকি
পশ্চিমা তহবিল কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অংশীদার খুঁজছে বাংলাদেশ। তবে এটিও একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবর্তন। স্বাস্থ্য বিষয়ক অবকাঠামোতে ৫০ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। কিন্তু তহবিলের শতকরা ৬০ ভাগ অর্থের কন্ট্রাক্ট আছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। সৌদি আরব মেডিকেল খাতে ৩০ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে ম্যান্ডেট আছে যে নিয়োগ করতে হবে সৌদি আরবের ম্যানেজার। ফলে এর স্থায়িত্ব ও স্থানীয় সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ২০২৪ সালের ঢাকা ঘোষণার মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্দেশ্য হলো জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে সম্পদ বা অর্থ সংগ্রহ করা। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা সহযোগিতাকে গভীরভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এই জোটগুলো আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও নতুন এক ধরনের নির্ভরতা তৈরির ঝুঁকি তৈরি করবে।
হতাশার মাঝে উদ্ভাবন
ডিজিটাল স্বাস্থ্য উদ্যোগ আশার আলো দেখাচ্ছে। ‘টনিক’ ও ‘ডকটাইম’-এর মতো টেলিমেডিসিন প্লাটফর্মগুলো শহর ও গ্রামীণ জীবনের বিভক্তি কমিয়ে আনছে। কোভিড-১৯ এর সময় তারা ৫০ লাখ ব্যবহারকারীকে সেবা দিয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলো, যেখানে ক্লিনিক সেবা খুব সীমিত, সেখানে মাতৃস্বাস্থ্য ও রোগ শনাক্তে প্রতিশ্রুতি দেখাচ্ছে মোবাইল অ্যাপস। আভ্যন্তরীণ ওষুধের চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ সরবরাহ করছে স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে টিবি এবং টীকা উৎপাদনের শূন্যতা পূরণ করতে পারে।
সামনের পথ: স্বনির্ভরতা নাকি আত্মসমর্পণ?
এই সঙ্কটে বালাদেশের প্রতিক্রিয়াই তার ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য শিক্ষা হবে। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে- দেশীয় সম্পদ সংগ্রহ: দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা কার্যকর করা, করের ভিত্তি সম্প্রসারণ করা, মেগাপ্রকল্প থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক অবকাঠামোতে তহবিল পুনর্বন্টন করা।
ন্যায়সঙ্গত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, বেসরকারি খাতের সহযোগিতা মুনাফা নয় বরং ক্রয়ক্রমতা ও সহজলভ্যতাকে অগ্রাধিকার দেয়।
আঞ্চলিক সংহতি: সম্পদ, জ্ঞান ও দর কষাকষির ক্ষমতা ভাগাভাগি করার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব জোরদার করা।
জলবায়ু-সহনশীলতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনায় দুর্যোগ প্রস্তুতিকে একীভূত করা।
বিশ্বব্যাপী অ্যাডভোকেসি: দাতাদের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং নিম্ন আয়ের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরদার করতে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য অর্থায়নে সংস্কারের জন্য তদবির করা।
টিকে থাকার পরীক্ষা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া শুধু একটি বাজেটগত ধাক্কা নয়- এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্বনির্ভরতা রক্ষার দৃঢ় সংকল্পের জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। যদিও সামনের পথ চ্যালেঞ্জে ভরা, তবু ইতিহাস আশার আলো দেয়া- এটি এমন একটি দেশ যা দুর্ভিক্ষের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃত তৈরি করেছে এবং চিরস্থায়ী দারিদ্র্যের পূর্বাভাসকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
(লেখক একজন চিকিৎসক, অধিকারকর্মী আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত তরুণ নেতা। তার এ লেখাটি ডেইলি সান থেকে অনুবাদ)