নির্বাচিত কলাম
কাওরান বাজারের চিঠি
বাংলাদেশে ‘বেহেশ্ত’ বেঁচে আছি, গায়ে জামা-কাপড়ও আছে
সাজেদুল হক
১৩ আগস্ট ২০২২, শনিবারএটা সত্য সারা বিশ্বই একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সরকারই পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে না জানে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের চিত্র এক নয়। সংকটের প্রধান শিকার জনগণ। আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত। তারা কী রকমভাবে বেঁচে আছেন- সেটা শুধু তারাই জানেন। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এক হালি ফার্মের মুরগির ডিম কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়! ভাবা যায়! এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে জনগণকে নিয়ে কৌতুক করবেন না। তাদের পাশে দাঁড়ান। অন্তত সান্ত্বনাটুকু দেন
গ্রামগুলো তখন ঘুমিয়ে।
মুনাফা বনাম ভর্তুকি
এই অবস্থায় সরকার কেন রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে গেল? কর্তা ব্যক্তিদের অবশ্য সাফ কথা তারা এতো পরিমাণে ভর্তুকি আর দিতে পারছেন না। কিন্তু এটি গল্পের এক দিক। গত ক’দিনে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর এবং সংস্থার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে কাহিনীর অন্যদিকটার কথাও। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর প্রতি লিটার অকটেনে ২৫ টাকা লাভ করছে বিপিসি। প্রতিলিটার পেট্রোলে এর চেয়ে ৫ টাকা কমবেশি লাভ হতে পারে। ডিজেলে এখনো লোকসান হচ্ছে লিটারপ্রতি ৬ টাকা। গত মাসের মতো একই পরিমাণ বিক্রি হলে ডিজেল ও অকটেন থেকে এ মাসে ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারে বিপিসি। ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৮ বছর ধরে সরকারের একমাত্র লাভজনক সংস্থা হিসেবে গ্রাহকদের কাছে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করে ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। দাম না বাড়িয়ে এই হারে লোকসান করতে থাকলেও মুনাফার টাকায় প্রায় ২১ মাস জ্বালানি সরবরাহ করতে পারতো বিপিসি। কিন্তু, গত ছয় মাসে তেল বিক্রিতে বিপিসি’র মোট ৮ হাজার ১৪.৫১ কোটি টাকা পরিচালন লোকসানকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে গত ৫ই আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তেলের মূল্য ৪২.৫ শতাংশ থেকে ৫১.৬ শতাংশ বাড়িয়েছে যা ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর আগে গত নভেম্বরে সরকার একই যুক্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতিলিটারে ১৫ টাকা বাড়ায়। বিপিসি’র তথ্যানুসারে, ২০১৮ অর্থবছর থেকে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুসারে, নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসি’র রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, এর তিনটি বিতরণকারী কোম্পানি- পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল ও অকটেনের আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে।
সিপিডি’র তথ্য
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত মে পর্যন্ত শেষ আট অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। সরকার জ্বালানি তেলে প্রায় ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর নেয়। বিপিসি’র কাছ থেকে প্রতি বছর লভ্যাংশ নিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে বিপিসি’র তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামপ্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অথচ আমাদের দেশে বৃদ্ধি করা হলো। আপনারা দেখতে পারেন নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই। ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির একটা দেশ অথচ দেখেন ভিয়েতনামে ডিজেলের লিটার প্রতি দাম ৯৭.৯ টাকা।
কী বলছেন বিপিসি চেয়ারম্যান
বিডিনিউজের এক রিপোর্টে বলা হয়, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ছয় বছরে যে মুনাফার অঙ্ক দেখিয়েছে, তার সঙ্গে বড় ধরনের ফারাক দেখা যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে। অর্থ বিভাগের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি প্রকৃত মুনাফা করেছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু বুধবার বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এক সংবাদ সম্মেলনে এই সাত বছরে ৪২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা মুনাফার তথ্য দেন। ফলে সরকারের অর্থ বিভাগ যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে বিপিসি’র হিসাবে ফারাক থাকছে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে ছয় বছরে বিপিসি’র বিপুল মুনাফা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই এই গরমিলের হিসাব এল।
প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন-
বিপিসি’র আগের লাভ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিপিসি আগে যে লাভ করেছে, সেগুলো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। গত শনিবার নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। নসরুল হামিদ আরও বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিপিসি ৮ হাজার কোটি টাকার উপরে লস করেছে। ওই টাকা তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে চলে গেছে। এখন অনেকে বলেন, লাভের টাকা কি আপনারা ধরে রাখছেন? আমরা লাভের টাকা তো ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনে খরচ করে ফেলেছি। আমরা গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে আসতেছি, সেখানে খরচ করছি। ভবিষ্যতে আমরা রিফাইনারি করবো, সেই জায়গাতে আমরা কনসালটেন্সিতে খরচ করেছি প্রচুর টাকা। বিভিন্ন প্রজেক্টে খরচ করছি যেন নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহটা রাখা যায় কিন্তু তেলের দাম তো নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববাজার।
বেঁচে আছি, গায়ে জামা কাপড়ও আছে
মানুষ যখন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে তখন তিনজন মন্ত্রীর বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। আরটিভি অনলাইনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনও কেউ মারা যায়নি’- বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বুধবার সকালে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। যারা আমাদের পছন্দ করে না তারা বলছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মরে যাবে। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে সত্য, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনও কেউ মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের একটি বক্তব্যও ভাইরাল হয়েছে। বিডিনিউজে মন্ত্রীর বক্তব্যের শিরোনাম, ‘সবাই খেতে পারছে, গায়ে জামা-কাপড় আছে।’ দুই মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে হয়! এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যখন অসহায় বোধ করছেন তেমন একটি কঠিন সময়ে তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। দাম বাড়ার কারণে কেউ মারা যায়নি এটি নিশ্চয় একটি বড় অর্জন। এখানেই পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় থেমে থাকেননি। তিনি আশাবাদী মানুষ, আশা করেছেন দাম বাড়ার কারণে কেউ মরবেও না। অনলাইন ভিডিওতে এটাও শুনলাম, মাননীয় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, তিনি আগে থেকেই বড়লোক। বড়লোকদের অবশ্য এদেশে কোনো সমস্যা নেই। কয়েক কোটি লোকের ক্রয় ক্ষমতা যে ইউরোপ-আমেরিকার মতো সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। এই লেখা যখন শেষ করে আনছি তখন চোখ গেল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণে। সেখানে বাংলা বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের একটি বক্তব্য। যেখানে বলা হয়েছে, সিলেটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সমপ্রসারণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে।
নোট: এটা সত্য সারা বিশ্বই একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সরকারই পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে না জানে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের চিত্র এক নয়। সংকটের প্রধান শিকার জনগণ। আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত। তারা কী রকমভাবে বেঁচে আছেন- সেটা শুধু তারাই জানেন। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এক হালি ফার্মের মুরগির ডিম কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়! ভাবা যায়! এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে জনগণকে নিয়ে কৌতুক করবেন না। তাদের পাশে দাঁড়ান। অন্তত সান্ত্বনাটুকু দেন।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন