শেষের পাতা
শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির পরামর্শ সিপিডি’র
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১৮ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো শুল্কহার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর
পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলে দেশটিতে ২০০ শতাংশ আমদানি বাড়াতে হবে। কমাতে হবে ৫০ শতাংশ রপ্তানি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহায়তা চুক্তি করতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক সংলাপে এ আহ্বান জানায় সিপিডি। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডি জানায়, বাংলাদেশের উচিত মার্কিন শুল্কের প্রভাব তার রপ্তানি প্রতিযোগিতার ওপর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা। সেইসঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত থাকা।
বক্তারা বলেন, মার্কিন শুল্কনীতি শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব অর্থনীতিকে দুষ্টুচক্রের মধ্যে ফেলবে। এটি শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়, শ্রমিকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ৯০ দিন পর যুক্তরাষ্ট্র কী করবে এটি কারও ধারণা নেই। তাই বিপদে পড়ার আগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাকে (ডব্লিউটিও) কাজ করতে দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাই ডব্লিউটিও’র দিকে না তাকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে পরামর্শ দেন তারা।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি মোকাবিলায় মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতায় জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে কৌশলগত বিকল্প অন্বেষণ করতে হবে। বাংলাদেশ মার্কিন আমদানিতে গড়ে ৬.২ শতাংশ শুল্ক এবং অন্যান্য শুল্ক আরোপ করে। তবে যখন রিবেট বিবেচনা করা হয়, তখন গড় শুল্ক ২.২ শতাংশে নেমে আসে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন আমদানিতে গড় শুল্ক ১৫.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্যারিফের প্রভাব একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম হবে। যারা মনে করেন, চীনের ওপর বেশি হারে ট্যারিফ আরোপ করায় বাংলাদেশ বেশি উপকৃত হবে, বিষয়টি ঠিক নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে চীন ‘ম্যান-মেড ফাইবার’ পোশাক রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশের রপ্তানির ৭০ ভাগ কটন। ফলে বাংলাদেশ খুব বেশি উপকৃত হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোনো একটি আইটেমে যদি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেয়, অন্য দেশকেও সেই সুবিধা দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। আলোচনার ওপর নির্ভর করবে আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কি কি ধরনের সুবিধা নিতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ খুব কম, সেটি কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নির্ভর করবে সামগ্রিক পলিসির ওপর। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আর ট্রাম্পের এই ট্যারিফ পলিসি আমাদের এলডিসি থেকে বের হওয়াতে সহায়তা করবে। ৯০ দিন পর কি হয়, সেটার ওপর নির্ভর করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি যদি ২০০ শতাংশ বাড়াই ও রপ্তানি যদি ৫০ শতাংশ বাড়াই তবেই শুল্ক শূন্য হতে পারে। বাস্তবে এটি আসলে সম্ভব নয়। এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, দেখতে হবে ও পদক্ষেপ নিতে হবে।
সিপিডি চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, নিজেদের যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আছে, তার মধ্যে থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের বাজার বড় করার চেষ্টা করা উচিত। সেখানে আরও কয়েক বছর বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত বাজারের সুবিধা আছে। সেইসঙ্গে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। এশিয়ার বাজারও আছে; এই মহাদেশ আগামী দিনে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির মূলকেন্দ্র হবে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এশিয়াই হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় জায়গা। রেহমান সোবহান মনে করেন, ‘ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানির একক বৃহত্তম বাজার। সেখানে এত অনিশ্চয়তা থাকলে আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে ১৮ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক পাওয়া গেছে। তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যে ১২৭ কোটি ডলার শুল্ক আদায় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া শীর্ষ তিন পণ্যে শুল্ক শূন্য করলে অন্য দেশকে সমান সুবিধা দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের মোট শুল্ক লোকসান হবে ১৭ কোটি ডলার। ফলে নিছক শুল্ক হ্রাস করে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে, বিষয়টি তেমন নয়।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, নির্ধারিত সময় শেষে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর ওপর শুল্ক কিছুটা কমাতে পারে। কিন্তু আমাদের মার্কেটের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বায়ারদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ৫০ শতাংশ নেগোসিয়েশন করতে হবে। এর জন্য কারখানাগুলোকে ব্যাংকের সাপোর্ট দিতে হবে। তবে এই কাজটা কেবল একটা পদ্ধতির মধ্যদিয়ে যাওয়া জরুরি, যা আগামী ৯০ দিনের জন্য কার্যকর হবে। তবে আগামীতে আমাদের রপ্তানি কিছুটা কমাতে পারে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তবে আগামী ৯০ দিন পরে পরিস্থিতি যাই হোক তাতে যেন সরকারের সহযোগিতা থাকে।