বাংলারজমিন
বিজয়নগরে মাদক কারবারের নেপথ্যে আওয়ামী লীগ
আমিরজাদা চৌধুরী, বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
১৮ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবারগত ১২ই মার্চ দুপুরের ঘটনা। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুলতানপুর এলাকা থেকে বিজয়নগরের সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মিরাসানি গ্রামের কুখ্যাত মাদক কারবারি মো. জসিম খানকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা ও মোটরসাইকেলসহ আটক করে ডিবি। এরপর ঘটনাস্থলেই ডিবি পুলিশের সঙ্গে রফাদফা হয় জসিমের। মাদক কারবারি জসিমের মোবাইল থেকে তার স্ত্রী মুক্তা আক্তারের মোবাইলে কল করে নগদ দেড় লাখ টাকা আনার পর জসিমের মোটরসাইকেল ছেড়ে দেয়া হয় এবং ৫০০০ পিস ইয়াবার বিপরীতে পাবলিক সিএনজি অটোরিকশা থেকে মাত্র ৮৭০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে ডিবি পুলিশের এসআই মো. আনিসুজ্জামান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। শুধু তাই নয়, আসামির সঙ্গে আর্থিক রফাদফার পর ঘটনাস্থল সুলতানপুরের পরিবর্তে বিয়াল্লিশ্বর-পুনিয়াউট বাইপাস সড়ক দেখানো হয়।
গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে মাদক গায়েব করার পাশাপাশি ঘটনার বর্ণনা এবং ঘটনাস্থল আমুল পাল্টে সম্পূর্ণ মনগড়া ঘটনা সাজিয়ে নিজেদের পালিত কতিপয় সোর্সকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন। এমনকি গোয়েন্দা পুলিশ এ ঘটনাটি স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদেরও অবহিত করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, মামলা দায়েরের দুই সপ্তাহের মধ্যেই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে জসিম। ডিবি পুলিশের এমন অপ-পুলিশিংয়ের ফলস্বরূপ প্রকৃত মাদক কারবারি সুবিধা পেয়েছে। পরবর্তীতে এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামিন পাওয়ার পর মাদক সংক্রান্ত চার মামলার আসামি জসিম তার নিজ এলাকা নোয়াবাদী গ্রামের আরেক কুখ্যাত মাদক কারবারি, পাঁচটি মাদক মামলার আসামি যুবলীগ নেতা মোশারফ মিয়া, একাধিক মাদক মামলার আসামি নলগড়িয়া গ্রামের দীনু মিয়া ওরফে দীনা, পার্শ্ববর্তী আখাউড়া উপজেলার আমোদাবাদ গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী মোবারক, রোমান ও রিপনের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দেদারসে মাদক পাচার ও বিক্রি করছে।
একই এলাকা বিজয়নগরের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কালাছড়া গ্রামের রহিম বাদশাহর ছেলে আরেক কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান ইউপি সদস্য হানিফ মেম্বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও চুটিয়ে মাদকের লাইন নিয়ন্ত্রণসহ পাচার ও বিক্রি করছে। ওই গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে (মশুরবাড়ি) নারীদের দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করানোর পাশাপাশি নিয়মিত মাদক সেবন ও জুয়ার আসর বসানো হয় হানিফ মেম্বারের নেতৃত্বে। নির্জন ওই বাড়িতে বসেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা কারবারিদের সঙ্গে মাদক সংক্রান্ত লেনদেন পরিচালনা করেন তিনি। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। অথচ তার বাড়ির কাছেই রয়েছে বিজিবি’র বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি)। এই হানিফ মেম্বারের নামে বিজয়নগর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ছয়টি মামলা রয়েছে।
এর আগে, গেল ৩০শে ডিসেম্বর বিজয়নগরের কাশিনগর গ্রামের ফতেহ মিয়ার ছেলে ১৮ মামলার আসামি জসিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০০ বোতল ভারতীয় এস্কফ সিরাপ উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ ২৫ বোতল গায়েব করে ৭৫ বোতল উদ্ধার দেখিয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর (৫ই জানুয়ারি) একই গ্রামে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ফের অভিযান চালিয়ে জসিমের চাচা আব্দুল মান্নানের পরিত্যক্ত ঘর থেকে ৪০ বোতল ফেনসিডিল ও ৪০ বোতল এস্কফ সিরাপ উদ্ধার করলেও মাত্র ২৭ বোতল (২৫ বোতল ফেনসিডিল ও দুই বোতল এস্কফ) উদ্ধার দেখিয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে জেলার পুলিশ সুপার ঘটনাটি জানতে পেরে গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবিরকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করেন।
উল্লেখিত মাদক সংক্রান্ত সবগুলো ঘটনার অভিযোগের তীর জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। বিজয়নগর থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গেল ছয় মাসে (নভেম্বর ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত) বিজয়নগর থানা এলাকা থেকে মোট ১৩ হাজর ৬২৯ পিস ইয়াবা, ১৩০৬ বোতল এস্কফ ও ৫৫৬ বোতল ফেনসিডিল এবং ৩৮৬ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান চলাকালে মোট ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৬৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম বলেন, ডিবি পুলিশের কোনো সদস্যের ব্যাপারে এরকম কোনো অভিযোগ এখনো আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে তা যাচাইয়ের পর সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রওশন আলী বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বদ্ধপরিকর। থানায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তারা নিয়মিত মাদক উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের হাতে নিয়মিত মাদকদ্রব্যসহ আসামিও আটক হচ্ছে। বিজয়নগর থানার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এখানে যোগদানের কয়েক দিনের মধ্যেই অভিযোগ উঠা এসআই ইসহাককে বদলি করা হয়ে। তিনি অন্যত্র চলে গেছেন। তবে স্থানীয় বিএনপি’র দলীয় কোন্দলের কারণে তারা রোষাণলে পড়ছেন বলে দাবি করেন তিনি। তাছাড়াও স্থানীয় নাম সর্বস্ব কিছু পত্রিকার সাংবাদিক, যাদের নামে ৫ই আগস্টের আগে বিজয়নগর থানায় নারী নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির মামলা হয়েছিল, তারা এখন পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। যেমন গত ৮ই এপ্রিল রাতে স্থানীয় আমতলী বাজার এলাকা থেকে সুফিয়া নামের এক নারীসহ ৪ জনকে প্রাইভেটকারসহ আটক করে থানায় নিয়ে এসে তাদের পিসিপিআর চেক করে জানতে পারি, তিনজনের নামেই মাদকের মামলা চলমান রয়েছে। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো মাদকদ্রব্য না পাওয়ার কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ১৫১ ধারায় তাদের আদালতে প্রেরণ করি। এ ঘটনার পরদিনই ওই চার ব্যক্তি আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে থানায় জব্দকৃত মোবাইল ও অন্যান্য মালামাল বুঝে নিয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্থানীয় নাম সর্বস্ব পত্রিকার প্রতিনিধিরা পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা রেখে দেয়ার অভিযোগ তোলে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমার কিংবা থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে এই নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট করলে আমার কোনো আপত্তি নাই।