অনলাইন
বিশ্ব বাণিজ্য কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
কাউসার মুমিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
(১ সপ্তাহ আগে) ৯ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১১ পূর্বাহ্ন

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল চীনের ওপর ১০৪% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা আজ বুধবার (৯ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হবে। তবে প্রেসিডেন্ট তার বাণিজ্য টিমকে বাংলাদেশসহ যে ৭০টি দেশ বাণিজ্য আলোচনার জন্য যোগাযোগ করেছে তাদের প্রত্যেকের জন্য ‘বিশেষভাবে তৈরি’ (টেইলর মেইড) চুক্তি তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তিনি চীনের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য আলোচনায় ইতি টানবেন এবং অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবেন।হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জানিয়েছেন, তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য আলোচনাকে অগ্রাধিকার দেবেন না।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেট বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মিত্র ও বাণিজ্য অংশীদার যেমন জাপান, কোরিয়া ও অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য। আর ট্রাম্পের প্রধান বাণিজ্য আলোচক জেমিসন গ্রিয়ার এ বিষয়ক এক শুনানিতে কংগ্রেসকে বলেছেন, তার দপ্তর দ্রুত কাজ করার চেষ্টা করছে, তবে তাদের সামনে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। গ্রিয়ার আইনপ্রণেতাদের বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি এখনই কোনো ছাড় বা ব্যতিক্রম দিচ্ছেন না।’
এর আগে সোমবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দেন, তিনি চীনের ওপর অতিরিক্ত ৫০% আমদানি শুল্ক আরোপ করবেন, জবাবে চীন ঘোষণা করেছে তারা আমেরিকান পণ্যের ওপর ৩৪% আমদানি ফি ধার্য করবে। চীনের এই পাল্টা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়ায় চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১০৪% শুল্ক আরোপ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যা ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
পাল্টাপাল্টি এই শুল্ক আরোপ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে। চীন ঘোষণা করেছে যে তারা, ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করবে। আমেরিকা চীনের পণ্যের ওপর ৩৪% শুল্ক আরোপ করায়, চীন পাল্টা শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার ফলে আমেরিকান আমদানির উপর চীনের মোট শুল্কের হার দাঁড়াবে ৭০%। প্রতিক্রিয়ায়, বেইজিং জানায়—যদি ট্রাম্প তার হুমকি প্রত্যাহার না করেন, তবে তারা ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে।’
এ প্রসঙ্গে দ্য ইকোনমিস্ট-এর গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ‘চীনের নেতারা এখন মনে করছেন, তারা এই বাণিজ্য যুদ্ধে জয়ী হতে পারবেন, কারণ তারা ইতিমধ্যে আগের তুলনায় আরও কঠোর কৌশল গ্রহণ করেছে’। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চীন ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ ঠেকানোর কোনো উপায় না থাকায়, ট্রাম্প চীনের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ হারিয়েছেন এবং চীনের শুল্ক আরোপের পর সব আলোচনা বাতিলের হুমকি দিয়েছেন'।
চীনা কর্মকর্তারা এই পদক্ষেপকে ‘এক ভুলের উপর আরেক ভুল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘নগ্ন চাঁদাবাজি’ এবং ‘রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। একই সঙ্গে তারা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের একটি পুরনো বক্তব্য তুলে ধরে ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করেছে, যেখানে রিগ্যান শুল্ক আরোপের বিরূপ প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
জবাবে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট মঙ্গলবার যুক্তি দেন যে, চীন পাল্টা আঘাত হানার মাধ্যমে একটি ‘বড় ভুল’ করছে। তিনি গতকাল সিএনবিসি-কে বলেন, ‘চীন যদি আমাদের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করে, তাহলে আমরা কী হারাবো? আমরা তাদের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ রপ্তানি করি, তাই এটা তাদের জন্য ‘একটি হাত হারানোর মতো অবস্থা’ হবে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ফের ট্যারিফ সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এর ফলে ইতোমধ্যেই শেয়ারবাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। গত সপ্তাহান্তে ফ্লোরিডা সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে বাণিজ্যমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সিএনবিসি টেলিভিশনকে বলেন, এটি ছিল ট্রাম্পের একক সিদ্ধান্ত এবং তিনি চেয়েছিলেন আতঙ্ক ও বিস্ময় (শক এন্ড অ) কৌশলের মাধ্যমে অংশীদারদের চাপ অনুভব করাতে। তার পরবর্তী ফলাফল হিসেবে, বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ ট্যারিফ আলোচনায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা জানিয়ে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে । তিনি বলেন, বিশেষ করে জাপানের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফোনালাপে অংশ নিয়েছেন এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনার পথ খুলেছে।
হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর মন্তব্য ঘিরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। তার মতে, শুধু শূন্য ট্যারিফ যথেষ্ট নয়, বরং অদৃশ্য ও গোপন ‘অ-ট্যারিফ বাধা’, ভ্যাট এবং ভর্তুকির মতো বিষয়ও আলোচনার অংশ হওয়া উচিত। ফলে ‘পারস্পরিকতা’ (রেসিপ্রোকাল) শব্দটির প্রচলিত অর্থ যেন ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে। হোয়াইট হাউস শুধু অদ্ভুত এক সূত্রের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের উপর ‘পারস্পরিক’ শুল্ক আরোপ করছে না, বরং ভিয়েতনাম ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে।
হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো সিএনবিসির এক অনুষ্ঠানে গতকাল বলেন, ‘ভিয়েতনামের শুল্ক মওকুফের প্রস্তাব আমাদের কাছে মূল্যহীন, কারণ প্রকৃত সমস্যা তাদের অশুল্ক প্রতারণা।’ তিনি চীনা পণ্য ভিয়েতনাম হয়ে রপ্তানি, এবং মেধাস্বত্ব চুরির মতো উদাহরণ তুলে ধরেন। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি কেবলমাত্র মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো নয়, বরং বিশ্ব বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী স্কট বেসেন্টও স্বীকার করেছেন, এসব বিষয় আলোচনার টেবিলে রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট নিজেই এই আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন।
প্রসঙ্গতঃ শুল্কনীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিশ্বজুড়ে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি ও প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের কারণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপ এবং এশিয়ার অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বছরব্যাপী ১০০% পর্যন্ত বেড়েছে। জার্মানির সংসদ একটি ঐতিহাসিক ঋণ সংস্কার আইন পাস করেছে, যাতে বৃহৎ প্রতিরক্ষা বাজেট নিশ্চিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারও জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন এক অস্থির সময় পার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারস্পরিকতা’ নীতির ব্যাখ্যা এবং তার প্রয়োগ, বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক, বাজার স্থিতিশীলতা, এমনকি ভূরাজনৈতিক বন্ধুত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ব্যবসায়ী নেতাদের অস্বস্তি, বাজারে ওঠানামা, এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতা—সব মিলিয়ে ট্রাম্প ট্যারিফ এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার পথে বিশ্বকে এগিয়ে নিচ্ছে, বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।