শেষের পাতা
স্থানীয় সরকার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তায়েফুলের রাজত্ব
জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
৭ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
চাকরির বয়স ৫ বছর। এরমধ্যেই ঘুষ-দুর্নীতির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ব্র্রাহ্মণবাড়িয়া স্থানীয় সরকার শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তায়েফুল লতিফের। অভিযোগ রয়েছে পাহাড় সমান। তার যন্ত্রণায় ৩ বছর ধরে অতিষ্ঠ জেলার একশ’ ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটররা। গত ২৩শে মার্চ জেলা প্রশাসকের কাছে একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছে তায়েফুলের বিরুদ্ধে।
তথ্য মিলেছে, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে ২০২০ সালে নিয়োগ হয় সদর উপজেলার সুহিলপুর তেলীপাড়ার মৃত আফজাল লতিফের ছেলে তায়েফুলের। প্রথম পোস্টিং নাসিরনগর ইউএনও অফিস। সেখান থেকে প্রায় ২ বছর পর জেলায় বদলি হয়ে আসেন। ডিসি’র বাংলো, নেজারত শাখায় দেড়-দু’মাস করে চাকরির পর ২০২২ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় সরকার শাখায় পোস্টিং হয়।
লিখিত ওই অভিযোগ এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরদের অনেকে জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকার শাখা তায়েফুলের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। বদলি বাণিজ্যসহ নানা কাজেই টাকা দিতে হয় তাকে। স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালকের পরিদর্শনের ভয় দেখিয়েও ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন তিনি।
পরিবার নিয়ে বিমানে চড়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যান কয়েক মাস আগে তায়েফুল। নিজের ফেসবুক আইডিতে সে ছবি পোস্ট করেন। এনিয়ে তার সহকর্মীদের মধ্যেই সমালোচনা রয়েছে।
গত ৩রা মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শঙ্কর কুমার বিশ্বাস ইউনিয়ন পরিষদের ৮ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তার একটি বদলি আদেশ করেন। এর আগে ২৮শে জানুয়ারি আরও ১০ জনের বদলি আদেশ হয়। অভিযোগ উঠেছে, যারা টাকা দিয়েছেন তাদের ভালো জায়গায় বদলি করা হয়েছে। ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দিয়ে সুবিধাজনক জায়গায় বদলি হয়েছেন এসব আদেশে নাম থাকা অনেকে। নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. বাবুল মিয়া তার নিজের এলাকা সরাইল সদর ইউনিয়নে বদলি হয়ে এসেছেন। তবে বাবুল মিয়ার দাবি তিনি কোনো টাকা-পয়সা দেননি। তার বদলি জেনুইন। ৭ বছর ওই ইউনিয়নে ছিলেন। নাসিরনগরের কুন্ডা ইউনিয়ন থেকে আশুগঞ্জ সদর ইউনিয়নে বদলি আদেশ হয়েছে অসীম চন্দ্র করের, নারায়ণ বিশ্বাস সরাইলের অরুয়াইল থেকে পানিশ্বর, দিদার আহম্মেদ কসবার খাড়েরা থেকে সরাইলের অরুয়াইল, মো. আলমগীর হোসেন আশুগঞ্জের আড়াইসিধা থেকে নাসিরনগরের চাতলপাড়, কসবার বাদৈর থেকে মোহাম্মদ সুমন এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নে, মো. আলমগীর নবীনগরের জিনদপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নাটাই উত্তর ইউনিয়নে, মোহাম্মদ আতিকুর রহমান নবীনগরের লাউরফতেহপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সাদেকপুরে বদলি হয়েছেন। সদরের নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়ন থেকে লিটন চক্রবর্তীকে নবীনগরের নাটঘরে বদলি করা হয়। বদলিতে বেশি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আলোচিত মো. মহিবুর রহমান। মহিবুর ৭ বছর ধরে তার বাড়ি লাগোয়া সদরের তালশহর পূর্ব ইউনিয়নে রয়েছেন। এখন তাকে বাড়ির আরও কাছে বুধল ইউনিয়ন পরিষদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। টাকা না দেয়ায় মো. সুমন পারভেজকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বুধল থেকে কসবার খাড়েরায় বদলি করা হয়। সুমন জানান- তিনি হার্টের রোগী। গত ১৭ই ডিসেম্বর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে তার ৪টি রিং পরানো হয়। মানবিক কারণে তাকে আশপাশে বদলির জন্য আবেদন করেছিলেন। টাকা না দেয়ায় তাকে দূরে বদলি করা হয়েছে। তায়েফুল লতিফ তার কাছে ১ লাখ টাকা চেয়েছিল বলে অভিযোগ করে বলেন, আমি একজন হার্টের পেশেন্ট। সরাইল থেকে কসবায় কি করে যাব। উপ-পরিচালকের পরিদর্শনের কথা বলেও তার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফোন দিয়ে বলে ভাই ডিডি এলজি (স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক) আপনার এখানে যাবে। বলি ৩ মাস আগে না এলো। তাহলে একটু দেখা করেন। এরপর গিয়ে ৩/৪ হাজার টাকা দিয়ে আসি। অফিসিয়াল কোনো কাজে ফোন দিলে সে ফোন ধরে না। বলে অফিসে আসেন। চাকরি করি ২০/৩০ মাইল দূরে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে উঠি। অফিসে আসবো কখন। এরপর ফোন কেটে দেয়। টাকা না দেয়ায় আরও কয়েকজনকে দূরে বদলি করার অভিযোগ রয়েছে। সরাইলের পানিশ্বর থেকে শেখ রাজিবুর রহমানকে নবীনগরের কাইতলা দক্ষিণ ইউনিয়নে, মোহাম্মদ আরিফ মিয়াকে নবীনগরের নাটঘর ইউনিয়ন থেকে সাতমোড়া, মো. মাসুম আহাম্মদকে আশুগঞ্জ সদর ইউনিয়ন থেকে নাসিরনগরের কুন্ডা ইউনিয়নে বদলি করা হয়। নাসিরনগরের গোকর্ণ ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু সাঈদের কাছে পছন্দের জায়গায় পোস্টিংয়ের জন্য ১ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দেয়ায় তার পোস্টিং হয়নি। তার কাছ থেকে উপ-পরিচালকের পরিদর্শনের কথা বলে ৫ হাজার টাকা নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কসবার মুলগ্রাম ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম ঠাকুর ২০২৪ সালের ১০ই নভেম্বর বদলির জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে একজন উপদেষ্টার পিএসও তার বদলির জন্য স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালকের কাছে সুপারিশ করেন। এরপরও মাহবুবুলের কাছে তদবিরে কাজ হবে না বলে ৭০ হাজার টাকা দাবি করা হয়।
২০২২ সালে জেলার ৫৭ জন ইউনিয়ন সচিবকে একসঙ্গে কয়েক উপজেলা ডিঙ্গিয়ে বদলি করা হয়। সেসময়ও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। ওই বদলি আদেশের পর অসুস্থতার জন্যে দূরে চাকরি করতে অক্ষম হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মারা যান আরেকজন।
অভিযোগ বদলি ছাড়াও অন্য সবকাজেই টাকা দিতে হয় স্থানীয় সরকার শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তায়েফুলকে। আশুগঞ্জের শরিফপুর ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাফর খানের কাছে উপ-পরিচালকের পরিদর্শনের কথা বলে ৫ হাজার টাকা চাওয়া হয়। জাফর খান নিজেকে পিরোজপুর জেলার ডিসি’র আপন চাচা বলে জানালে তায়েফুল তাকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘কতো ডিসি দেখেছি, আমি নিজেও ডিসি’র স্টাফ। সরাইলের পাকশিমুল ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু হাছানের কাছ এক বছর আগে পারস্পরিক বদলির জন্য ২৫ হাজার টাকা নেয়া হয়। কিন্তু বদলি আর হয়নি। ২৩ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ২০২৩ সালের জুনে উচ্চতর গ্রেডের জন্যে আবেদন করেন। এই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একজন জানান, আবেদনের পর প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন তায়েফুল। কিন্তু উচ্চতর গ্রেডের কিছু হয়নি। অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে আরও হরেক রকমের। তায়েফুল তার নিজের চাকরিতে প্রক্সি পরীক্ষার্থীর মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন।
স্থানীয় সরকার শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তায়েফুল লতিফ আগের কিছু বদলি নিয়ে অভিযোগ হয়েছে জানিয়ে বলেন, বদলি তো অনেকদিন ধরে হয় না। ৫৭ জনের বদলির সময় এই শাখায় আমার চাকরিকাল ছিলও ২ দিনের। এক লাখ টাকা করে নেয়ার বিষয়ে আমার জানা নেই। রুহুল আমিন স্যার (উপ-পরিচালক) ৮/৯ মাস ছিলেন। অন্য স্যাররা অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। কোনো পরিদর্শনে যাননি। তাহলে আমি কীভাবে টাকা নেবো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, অভিযোগ একটা দিয়েছে। বদলির নামে টাকা নেয়ার বিষয়টি আমার কানেও এসেছে। সুস্পষ্ট অভিযোগ যদি দেয়া হয় আর সেটি প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠকের মতামত
এই সমস্হ কর্মকত্তাদের বিরুদ্দে অনতিবিলন্বে বেবস্হ নেওয়া হোক
বেকসুর খালাস থাকবে?