শেষের পাতা
বৈশাখে ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব তৈরি
চারুশিল্পী মানবেন্দ্রর বাড়িতে দুর্বৃত্তদের আগুন
স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা ও মানিকগঞ্জ থেকে
১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
পহেলা বৈশাখে আলোচনায় ছিল ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাবয়ব বানানো নিয়ে। মুখাবয়ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদের সেই প্রতিচ্ছবির কারিগরের তকমা দেয়া হয় মানিকগঞ্জের চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের কাঁধে। তবে, এই চিত্রশিল্পী জানিয়েছেন তিনি ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেনি, করেছেন বাঘের মোটিফ। মোটিভ তৈরির ঘটনার জের ধরেই মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নের ঘোষের পাড়া এলাকায় মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে ঘটানো হয় অগ্নিসংযোগ। অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর বুধবার সকাল থেকেই প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে উৎসুক মানুষের ভিড় পড়ে যায় ওই বাড়িতে। চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাড়ি একই এলাকায়। ধারণা করা হচ্ছে, হাসিনার মুখাকৃতি তৈরির ক্ষোভ থেকেই দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এ নিয়ে চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ও তার পরিবারের সদস্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সর্বত্র। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।
চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, পহেলা বৈশাখের দু’দিন আগে থেকেই আমাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার রটানো হয়। সেখানে বলা হচ্ছিল, পতিত সরকার শেখ হাসিনার মুখাকৃতি আমি বানাচ্ছি। আমার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে বিভিন্ন আইডি থেকে এমনটা প্রচার করা হয়েছে। সেখানে নেটিজেনরা বিরূপ মন্তব্য করেছে। পোস্ট দেখার পর আমি ছোট্ট পরিসরে একটা রিপ্লে দিয়েছি। আমি সেখানে লিখেছি- বৈশাখী শোভাযাত্রায় আমি একটা বাঘের আকৃতি তৈরি করেছি মাত্র। আর যারা শেখ হাসিনার আকৃতি তৈরি করেছেন সেটার জন্য শিল্পীরা সরাসরি দায়ী নন। তাদেরকে কোনো গোষ্ঠী দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন না। কারণ অনেক উপর মহলের নীতি নির্ধারণীদের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যারা আকৃতি তৈরি করেছেন সবাই আমরা শিল্পী, কিন্তু ওয়ার্কার হিসেবে করেছি। রাষ্ট্রীয় যদি কোনো নির্দেশনা থাকে প্রতিষ্ঠান সে দায়িত্ব পালন করবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই ধারাবাহিকতায় অপর কয়েকজন আর্টিস্ট আকৃতিটি করেছেন। কারণ তাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল বলেই।
মানবেন্দ্র বলেন, আমার এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। কিন্তু ডায়েরি করার একদিনের মাথায় আমার বাড়িতে এ ধরনের কাণ্ড ঘটানো হলো। এ নিয়ে আমি এবং আমার পরিবার জীবনের নিরাপত্তায় ভুগছি। এই মুহূর্তে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। মানবেন্দ্র আরও বলেন, যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে সে ক্ষতি টাকা পয়সা দিয়ে পূরণ হওয়ার নয়। কারণ আমার অনেক স্মৃতি অনেক কাজ যেটা আমি শৈশব থেকে করেছি সেগুলো পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। আমার পক্ষে নতুন করে কাজ করা আর সম্ভব না। এ ক্ষতি আর কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। মানিকগঞ্জ সদর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সালাউদ্দিন বলেন, রাত আনুমানিক ৩টার দিকে চারুশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ির একটি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্ত। ঘটনার পর থেকেই পুলিশ তৎপর রয়েছে। যেসব দুষ্কৃতকারীরা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের শনাক্ত এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ এবং সিআইডির চৌকস টিম কাজ করছে। আমরা আশাবাদী দ্রুত ঘটনা অনুসন্ধান করে অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ সম্পর্কে জানতে পারবো। কারণ জানার পর আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এদিকে, গতকাল বিকালে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি’র একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুর্বৃত্তদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।
শোভাযাত্রায় যুক্ত ব্যক্তিদের ফোনে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি অব্যাহত: এদিকে, শোভাযাত্রা কার্যক্রমে যুক্ত বেশ কয়েকজনকে ভিনদেশি ফোন নম্বর থেকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা ধরনের কটূক্তি প্রচার অব্যাহতভাবে চলছে বলে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। চারুকলা অনুষদ জানায়, অত্যন্ত দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ এবং বেদনাক্রান্ত হয়ে জানাচ্ছি যে, একই দুষ্কৃতিকারীদের হামলায় চারুকলা অনুষদের বিশিষ্ট অ্যালামনাই শিল্পী-ভাস্কর মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তিনি অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে মোটিফ নির্মাণে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছেন। এমতাবস্থায়, বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা ১৪৩২ কমিটি এবং চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে আমরা এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি অতি দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি করছি।
ঢাবি সাদা দলের নিন্দা, বিচার দাবি: ওদিকে, এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরে শোভাযাত্রা কার্যক্রমে যুক্ত বেশ কয়েকজনকে ভিনদেশি ফোন নম্বর থেকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা ধরনের কটু কথা প্রচার অব্যাহতভাবে চলছে। এমতাবস্থায় আমরা ভাস্কর মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেয়ার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি এ বিষয়ে অতি দ্রুত অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ দুই দফা দাবি: মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় দুই দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। দাবি দু’টি হলো- মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িটি পুনঃনির্মাণ, তার পরিবার ও সকল শিল্পীকে নিরাপত্তা প্রদানসহ অবিলম্বে সকল ক্ষতিপূরণ প্রদান করা এবং চারুকলায় ও মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা।
প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে: শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে যারা হামলা করেছে, তাদের প্রত্যেককে ধরার জন্য পুলিশ কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। গতকাল দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা জানান। পোস্টে তিনি লিখেছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি পুলিশের আইজিকে পরিষ্কার নির্দেশনা দিয়েছেন। গত কয়েকদিন জুলাইয়ে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ অনলাইনে শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষকে আক্রমণের উস্কানি দিচ্ছিল, তাদের ভাষ্যে ‘হাসিনার এফিজি বানানোর অপরাধে’! এদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও লিখেছেন, পাহাড় থেকে সমতল জুড়ে বাংলাদেশ মাত্রই এক অভূতপূর্ব মৈত্রীর উৎসব শেষ করলো। এক অন্য রকম আবেশ সবার মনে। আর এই সময়ই ওরা আক্রমণ করে এটা মনে করিয়ে দিলো জুলাই চলমান। কিন্তু ওরা জানে না বাংলাদেশের মানুষ জুলাই বুকে নিয়েই সামনে আগাচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যের সামনে এরা তুচ্ছ।