ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কা ও রা ন বা জা রে র চিঠি

রাজপথে লাশ, মন্ত্রীর ৬ বান্ধবী, কূটনীতিকের গাঁজা কেলেঙ্কারি

সাজেদুল হক
৬ আগস্ট ২০২২, শনিবার
mzamin

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। গোলাগুলি। আলাদা মানচিত্র। দেশ বিভাগ। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। কিন্তু আত্মীয় সব স্রোত মিশেছে একই মোহনায়। ইতিহাসতো আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পাখি, তার তো আসলেই কোনো সীমানা নেই। উড়ে যায়। দেশ থেকে দেশান্তরে।

বিজ্ঞাপন
উপমহাদেশের দেশগুলো প্রায় অভিন্ন কারণে শিরোনামে এসেছে বার বার। এমনিতে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখন কাবু মূল্যস্ফীতির চাপে। চাল-নুনের হিসাব মিলছে না তাদের। মাসের বেতনে চলছে না মাস। পথে বসেছে শ্রীলঙ্কা। দেশটি এরইমধ্যে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। পাবলিক ক্যু-এ পরিবর্তন এসেছে গদিতেও। ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে পরিবার। যদিও তাদের ছায়া এখনও রয়ে গেছে। পাকিস্তানের অবস্থাও টালমাটাল। আইএমএফ’র লোন ছাড় করাতে তদবির করছেন দেশটির সেনাপ্রধান। প্রতিদিনই কমছে রুপির দাম। বাংলাদেশও রয়েছে চাপে। ব্যয় সংকোচনে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ঋণের জন্য দ্বারস্থ হয়েছে আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকের। অন্য দেশগুলোর অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়।  

বাড়ির পাশের পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় চলছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন মমতা ঘনিষ্ঠ এই তৃণমূল নেতা। তার বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাসায় অভিযান চালিয়ে রীতিমতো তাজ্জব বনে যায় ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। বস্তাভর্তি কোটি কোটি টাকা। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাম ও ধন কেলেঙ্কারিতে ক্ষোভ রাজ্যের সর্বত্র। তার দিকে জুতাও নিক্ষেপ করেছেন এক নারী। আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জয়ন্ত চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ইডি’র জেরায় নির্বাসিত তৃণমূল মন্ত্রী এবং মডেল কাম অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের  গোপন সম্পত্তির কথা যেমন উঠে আসছে, উদ্ধার হয়েছে ৪৯ কোটির বেশি টাকা, ঠিক তেমনই উন্মোচিত হচ্ছে দু’জনের সম্পর্কের রসায়ন। যদিও জেরায় অর্পিতা বলেছেন যে, সব উদ্ধার হওয়া টাকাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এবং পার্থ’র লোকজন ফ্ল্যাটে এসে টাকা রেখে যেতেন, কিন্ত কেউ কি বিশ্বাস করবে ফ্ল্যাট মালিকের অনুমোদন ছাড়া টাকা রাখার কথা? বিশেষ করে ইডি’র তদন্তে যখন উঠে আসছে দু’জনের মাখো মাখো সম্পর্কের কথা। পার্থ’র সঙ্গে অর্পিতার পরিচয় ২০১১ সালে। বয়সে অনেক ছোট অর্পিতাকে দেখে পার্থর মনে ধরে সেই সময়েই। সম্পর্ক নিবিড় হয়। প্রতিষ্ঠা পেতে অর্পিতার দরকার ছিল একটি সিঁড়ির। পার্থর মধ্যে সেই সিঁড়ি তিনি পেয়ে যান। রমণীপ্রীতি পার্থর চরিত্রের একটি দিক। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী বাবলির সঙ্গে এই নিয়ে ছিল মতান্তর। বাবলির মৃত্যুর পর আরও বলগাহীন হন পার্থ। অর্পিতাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে ছুটি কাটাতে যান তিনি। আলাদা ফ্লাইটে নাকি গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। একসঙ্গে দু’জনে মাছ ধরতেন বারইপুর কিংবা জঙ্গিপুরের পুকুরে। লং ড্রাইভে প্রায়ই  যেতেন পার্থ-অর্পিতা।  

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আরও বেশ কয়েকজন বান্ধবীর নাম। অর্পিতার বাইরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মোনালিসা। পেশায় অধ্যাপিকা। এছাড়াও আলোচনায় অহনা, সোমাসহ কয়েকজন। কোনো কোনো গণমাধ্যম বলছে এই সংখ্যা ৬, আবার কেউ বলছে ৮। আনন্দবাজার পত্রিকাতো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাংলাদেশে অর্থ পাচার নিয়ে বড় একটি রিপোর্টই প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টের একটি অংশে চোখ আটকে যায়। এতে লেখা হয়েছে- “ইডি-সূত্রের ভাষ্য আদতে কুমিল্লার লোক পার্থের এই সব যোগাযোগ এবং ‘অর্থের সম্ভাব্য গতিপথ ও বিনিয়োগ’ বাংলাদেশের গোয়েন্দারা যাতে খতিয়ে দেখেন, সেজন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠি দিয়েছেন তারা। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক হয়ে সে চি?ঠি শুক্রবার পর্যন্ত তাদের হাতে পৌঁছয়নি বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র।” মানবজমিনও এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো চিঠির বিষয় জানতে পারেনি। তবে গোয়েন্দা সূত্র এটি বলছে, তারা বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিচ্ছেন। কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া এ নিবন্ধের লেখককেও পার্থের কুমিল্লা সংযোগের বিষয়টি স্বভাবতই কৌতূহলী করে তুলেছে। এমনিতে কুমিল্লা নিয়ে গত কয়েকবছরে  দেশে চলছে নানা চাপানউতোর। কুমিল্লা নামে বিভাগ দিতে রাজি নয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব। কুমিল্লার আলোচিত নেতা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার অবশ্য অনড়। তিনি কুমিল্লা নামেই বিভাগ চান। তার এ ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।  

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নারী অধ্যায় আমাদের দৃষ্টি আরও বহু পেছনে নিয়ে যায়। যদিও বলে রাখা ভালো, ক্ষমতাবানদের জন্য এ ধরনের কেলেঙ্কারি কোনো অভিনব ঘটনা নয়। প্রাচীন কাল থেকে এই সময়। এ ধরনের ঘটনা পাওয়া যাবে অগণিত। তার কিছু প্রকাশ্যে আসে। বেশির ভাগই থেকে যায় পর্দার আড়ালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শাসকদের মধ্যে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নারী সংশ্লিষ্টতা নিয়েই কানাঘুষা ছিল সবচেয়ে বেশি। কখনও খবর হয়েছে, কখনও হয়নি। তার বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন জিনাত মোশাররফ। অনেক প্রভাবশালীকে নিয়ে কানাঘুষা এখনও আছে।  অভিযান চালিয়ে বাড়িতে বস্তা বস্তায় টাকা উদ্ধারের ঘটনা আমাদের এখানেও ঘটেছে। সর্বশেষ ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময়ও আমরা এটি দেখেছি।  

উপ-মহাদেশের আরেক দেশ পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে রয়েছে প্রচণ্ড চাপে। রাজনীতিতেও ঝড়। মাস কয়েক আগে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। সম্প্রতি পাকিস্তানের  নির্বাচন কমিশন জানায়, ইমরান খানের দল বিদেশ থেকে বেআইনি অর্থ পেয়েছে। এ ইস্যুটি বহুদূর গড়াতে পারে। এমনকি নিষিদ্ধও হতে পারে পিটিআই। তবে নাটকীয়তা আছে আরও। কিছুদিন আগে পাঞ্জাবে উপ-নির্বাচনে চমক দেখায় পিটিআই। কিন্তু ডেপুটি স্পিকারের বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকে যান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের ছেলে হামজা শেহবাজ। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। ক্ষমতা পান ইমরানের জোটের নেতা পারভেজ এলাহী। আদালতের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন জোট। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বলেন, ‘আমরা সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো আপস করবো না।’ তিনি হয়তো ভুলে গেছেন ক’মাস আগে এই সুপ্রিম কোর্টের রায়েই তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া পড়ে প্রয়াত কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসার লেখা একটি কলামের কথা খুব মনে পড়লো, ‘কার উসিলায় সিন্নি খাইলা মুনশি চিনলা না।’ 

কূটনীতিকের গাঁজা কেলেঙ্কারি: মানবজমিনের কূটনৈতিক রিপোর্টার মিজানুর রহমান প্রথম বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। সাংবাদিকতার ভাষায় যাকে বলে স্কুপ নিউজ। জাকার্তায় বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত কাজী আনারকলির বাসায় অভিযান চালায় সেখানকার মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ওই বাসায় নাইজেরিয়ান এক তরুণের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি। মারিজুয়ানা বা গাঁজা পাওয়ার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়। কূটনীতিক হওয়ার কারণে বাংলাদেশ দূতাবাসের জিম্মায় মুক্তি দেওয়া হয় আনারকলিকে। এরইমধ্যে তাকে প্রত্যাহার করে দেশে আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু হয়েছে। তার বিষয়টি নিশ্চয় আইনানুগভাবেই এগুবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও সে কথাই বলেছেন। এর আগে কথিত গৃহকর্মী নিখোঁজের ঘটনায় অভিযোগ ওঠার পর আনারকলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। 

আনারকলির সর্বশেষ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিপুল বিতর্ক। বেশির ভাগই তার সমালোচনা। কেউ কেউ আবার তার পক্ষও নিয়েছেন। এখন কথা হলো, কূটনীতিকতো আর পাঁচটা-দশটা পেশার মানুষের মতো নন। একটি দেশের দূত তারা। দেশের বার্তা বাহকও বটে। তাদের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি দেশ এবং জাতির ভাবমূর্তির প্রশ্ন। দেশের স্বার্থ রক্ষাই তাদের কাজ। যে দেশে নিয়োজিত থাকেন সেখানকার আইন মেনে চলতে হয় তাদের। যদিও ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী সুরক্ষা পেয়ে থাকেন তারা। কাজী আনারকলি এবং তার বয়ফ্রেন্ডের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে ইন্দোনেশিয়ার আইনে তা গুরুতর অপরাধ। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশি কূটনীতিকদের বিদেশি নাগরিক বিয়ে করার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে বিদেশির সঙ্গে লিভ টুগেদারেরও নিশ্চয় সুযোগ নেই!  

 

 

রাজপথে লাশ: এমনিতে বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে স্থবির। আইনের ভাষায় ‘স্ট্যাটাসকো’। সোজা বাংলায় যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন বিএনপি মুখে মেনে নেয়নি, কিন্তু কার্যত মেনে নিয়েছে। দলটির অতি স্বল্পসংখ্যক এমপি সংসদের কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। দুই, একজন ঝড়ও তুলছেন। যদিও এসবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এ লেখকের সন্দেহ রয়েছে। এছাড়াও বিএনপি নেতারা মাঝে-মধ্যে কড়া বক্তব্য রাখেন। বেশির ভাগই ইনডোরে। কখনও কখনও প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তা আটকে করেন সমাবেশ। ফেসবুকে অনুসারীরা নেতাদের বক্তব্য শেয়ার করেন। এসব কর্মসূচিতে সাম্প্রতিককালে পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বলা হয়, বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। কিন্তু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে ভোলায়। ছোট্ট এই শহরে বিদ্যুৎ নিয়ে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশ ও বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মধ্যে। ঝরে গেছে দু’টি তাজা প্রাণ। নিহতদের একজন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশের গুলিতে তারা মারা গেছেন। নিহতদের শরীরেও পাওয়া গেছে গুলির আলামত। 

দুঃখজনক এই ঘটনায় আবার লাশ পড়লো রাজপথে। স্বজনহারাদের কান্নায় ভারী হলো আকাশ! এমন মামুলি কর্মসূচি কেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিলো? কোন প্রেক্ষাপটে গুলি চালালো পুলিশ।  এর কি কোনো তদন্ত হবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর কি জানা যাবে না? ভোলায় ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। চিহ্নিত করা প্রয়োজন দোষীদের।  প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। গণতান্ত্রিক দাবি করা রাষ্ট্রে সে মূল্য আরও বেশি। আর কত? স্বাধীন দেশে কবে শেষ হবে লাশের এই রাজনীতি? 

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status