শেষের পাতা
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কওমিপন্থি ১০ শিক্ষককে বাদ দেয়া নিয়ে যা জানা গেল
জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবারআন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) নীতিমালার তোয়াক্কা না করে একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল গত কয়েক বছর ধরে। ২০২১ সালে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জোর খাটিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বনে যাওয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভীর নির্দেশে এসব নিয়োগ দেয়া হয়। কোনো ধরনের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই তার পছন্দের লোকদের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো বলে সে সময় অভিযোগ উঠে। অপরদিকে ওইসময় আইআইইউসিতে স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষক-
কর্মকর্তাকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করে আবু রেজা নদভী। তবে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিতাড়িত হওয়ার পর আইআইইউসি থেকেও পালিয়ে যায় নদভীসহ আওয়ামীপন্থি অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। এ সময় আইআইইউসি শিক্ষার্থীরা নীতিমালা লঙ্ঘন করে নদভীর পছন্দে দেয়া শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবি জানায়। আর সেই বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্তদের বড় একট অংশকে অব্যাহতি প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই অব্যাহতি নিয়েও এখন তৈরি হয়েছে বিতর্ক। গত ২৯শে জানুয়ারি ১৯৮ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল মোহাম্মদ কাশেম, পিএসসি (অব.) স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয়। সেই চিঠির একটা অংশে বলা হয়, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সার্ভিসের প্রয়োজন নেই বিধায় ২৫৫তম সিন্ডিকেট সভা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভার সিদ্ধান্তক্রমে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো। আপনার এই অব্যাহতি আদেশ ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ থেকে কার্যকর হবে। উল্লেখ্য, আপনাকে ৩১শে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত প্রযোজ্য বেতন-ভাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথারীতি প্রদান করা হবে।
এদিকে অব্যাহতি প্রাপ্ত ১০ শিক্ষককে নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। তারা হলেন- ড. মাওলানা আব্দুস সালাম রিয়াদী, মাওলানা হারুন আজিজি নদভী, মাওলানা শাহাদাত হোসাইন, মাওলানা মিসবাহ উদ্দিন মাদানী, ড. শুয়াইব রশীদ মাক্কী, মাওলানা ইহতিশামুল হক মাদানী, মাওলানা জুহাইর ফোরকান,হাফেজ মুফতি এম. আহসান উল্লাহ, মাওলানা কাউসার মাহমুদ, সাইদুল মুর্তাজা। বলা হচ্ছে, এসব শিক্ষক যথেষ্ট মেধাবী ও যোগ্য হওয়ার পরও তাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র কওমি আকিদার লোক হওয়া কারণে জামায়াত ঘরনার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিরা তাদের বাদ দিয়েছেন। আর এই বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনা।
এদিকে খোঁজ নিয়ে, শুধুমাত্র ঐ কওমি শিক্ষক নয়, প্রায় একই নোটিশে নদভীর আমলে অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত ১০৮ শিক্ষককে বাদ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ জামায়াত সমর্থক বলেও পরিচিত। বাদ পড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটা অংশও জামায়াত সমর্থক। তাদের প্রায় সবাই কক্সবাজার ও নদভীর সংসদীয় আসন সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার বাসিন্দা। জামায়াত সমর্থক হলেও তারা নদভী ও তার স্ত্রী রিজিয়া রেজার বিশেষ অনুগ্রহে কোনরকম নিয়োগ বিধি না মেনেই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে আবার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার ডিও লেটার দেখিয়ে আইআইইউসিতে যোগ দেন। এছাড়া এই শিক্ষকদের মধ্যে আবু রেজা নদভীর প্রতিষ্ঠিত এনজিও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও রয়েছেন। তবে বিভাগগুলোতে অনুমোদিত কোনো পদ না থাকায় আবু রেজা নদভীর প্রশাসন এডহক ভিত্তিতে দেওয়া এসব শিক্ষককে পরবর্তীতে স্থায়ী করতে পারেনি।
কওমি আকিদার শিক্ষকদের দেখে দেখে বাদ দেয়া হয়েছে- এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ট্রাস্টি সদস্য বলেন, এটা একেবারে হালকা কথা। প্রথম বিষয় হলো এখানে নিয়োগ ও অব্যাহতির ক্ষেত্রে কওমি, জামায়াত, বেলরভী কিছুই দেখা হয় না। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যদি বলেন কওমি শিক্ষকদের বাদ দেয়া হয়েছে, তাহলে উনারা তো ১০ জন। তাহলে নদভীর আমলের নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে বাদ পড়া বাকি ১১৮ জন কারা? আমি তো জানি, এখানে উল্লেখযোগ্য সমর্থক জামায়াত সমর্থিত। এদের মধ্যে কয়েকজন জামায়াতের রোকন মানের লোক আছেন বলেও জানি।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের রেজিস্ট্রার কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ কাশেম বলেন, নীতিমালা মেনে যোগ্যতা যাচাই না করে এডহক ভিত্তিতে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইআইইউসি কর্তৃপক্ষ। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হচ্ছে না। যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হননি, তাদের অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, এখানে আমরা কোন দলীয় পরিচয় দেখে নিয়োগ দেইনি। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যম নিয়োগ, প্রমোশনসহ সব কার্যক্রম চালানো হয়। কয়েকজন শিক্ষকের অব্যাহতি নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে এগুলো নিছক প্রোপাগান্ডা।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের উদ্যোগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি)। ২০২১ সালের মার্চে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেন। তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাই খালেদ মাহমুদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা ওই সময় আইআইইউসি ক্যাম্পাসে গিয়ে দখল প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। মাওলানা শামসুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে আইআইইউসি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রাখে নদভী ও তার অনুসারীরা। দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামীপন্থী এমপি, ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে আবু রেজা নদভী গঠন করেছিলেন আরেকটি ট্রাস্টি বোর্ড।এই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ৩ বছরে আইআইইউসি থেকে ১০০ কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র আবু রেজা নদভী একাই ১২ লাখ টাকা করে মাসিক ভাতা গ্রহণ করেন আইআইইউসি থেকে, যা নজিরবিহীন। এছাড়া তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা, সাবেক তথ্য মন্ত্রী হাছান মাহমুদের ভাই খালেদ মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অনুষদের শিক্ষক ড. সালেহ জহুর, এস আলম গ্রুপের দখল করা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশীদসহ আওয়ামীপন্থী লোকজন ২-৩ লাখ টাকা করে অবৈধ পন্থায় মাসিক ভাতা গ্রহণ করতেন আইআইইউসি থেকে। সেই সময়ে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অনেকেই সেই হরিলুটে নদভী গংকে সহযোগিতা করতেন বলে অভিযোগ আছে।
পাঠকের মতামত
আই আই ইউ সি যে স্থানে বসে দখলের চক আঁকা হয়েছিল যাদের সহযোগিতায় হয়েছে তাদের বিষয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কি কর্তৃপক্ষ
যারা আখেরাতের পড়া পড়ে তাদের দুনিয়াবীর দরকার কী?
ববব
আজ কয়দিন ধরে কউমী ঘরানার কিছু মানুষ প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে এই বলে, ১০ জন শিক্ষক কে বাদ দেয়া হয়েছে আই আই ইউ সি থেকে শুধু কউমী মাদ্রাসার থেকে এসেছেন বলে। আজকে মানব জমিনের রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম শুধু ঐ দশ জন নয় মোট ১২৮ জনকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ তারা প্রচার চালাচ্ছে তাদের ঘরানার দশজনকে বাদ দিয়েছে। তাহলে বাকী ১১৮ জনের জন্য তাদের কোন কথা নেই কেন? ধন্যবাদ মানব জমিন কে পুরোপুরি সত্য বিষয়টা তুলে আনার জন্য।
কাউমি, জামায়াত, লীগ প্রপাগান্ডা না শুনে বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব নিয়মে চলুক এটাই সকলের প্রত্যাশা।
হায়রে বাংগালি ! কী হলো তোমাদের। হালাল- হারাম নাই, সত্য- মিথ্যা নাই, যা খুশি তাই করা হচ্ছে।
"শুধুমাত্র কওমি আকিদার লোক হওয়া কারণে জামায়াত ঘরনার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিরা তাদের বাদ দিয়েছেন।" কথাটা কিন্তু অমূলক বা মিথ্যা নয়। ধর্মব্য''বসায়ী, জাতীয় বেইমান, হাসিনার বহুবারের দোস্ত এই রগকটা - রাজাকার গোষ্ঠী জামায়াতের বাড় বহু বেড়েছে। ধর্মের নামে তারা একের পর এক অনৈসলামিক ও হিংসাত্মক কাজ করে যাচ্ছে।
জুতা নদভীর জুতা চেটে যে কয়দিন তারা জামায়াতের প্রতিষ্টান থেকে ঝোল খেয়েছেন, সে কয়দিনের সব কিছু ফেরত দেয়া উচিত। কারণ, কওমী কোন প্রতিষ্টানে জামায়াতের লোক চাকরি করতে পারেনা। সে হিসাবে, জামায়াতের প্রতিষ্টানের কওমীরা কোন যুক্তিতে থাকতে চায়?