ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

ধাক্কার সংস্কৃতি, রেলে রনির গোয়েন্দাগিরি, রিমোটে বন্দি সব

শামীমুল হক
৩ আগস্ট ২০২২, বুধবার
mzamin

এমনিতেই রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির প্রতিবাদ আন্দোলন সাড়া জাগিয়েছে সর্বত্র। তার টানা আন্দোলনে রেল কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে বসতে বাধ্য হয়। মোটামুটি একটা সমঝোতায় পৌঁছে তারা। দু’দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে রনি দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে গিয়ে অনিয়ম ধরছেন। আখাউড়া রেল জংশনে গিয়ে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৭৫ টাকার টিকিট ১২০ টাকা নেয়ার চিত্র তুলে ধরেন রনি। টিকিট কাউন্টারেই ঘটে এ ঘটনা

ধাক্কার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছেন না মন্ত্রীরা। সেই সাভারের রানা প্লাজা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার রটনা থেকে শুরু ধাক্কার সংস্কৃতি। সে সময়কার মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিকে বলেছিলেন- এটি বিরোধীদের কাজ। পিলার ধাক্কা দিয়ে রানা প্লাজাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়েছে। মহীউদ্দীন খানের এ মন্তব্য এখনো মানুষ উদাহরণ হিসেবে সামনে আনে।

বিজ্ঞাপন
এরই মধ্যে সোমবার রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম  সুজন মন্তব্য করেন রেল কাউকে ধাক্কা দেয় না, অন্যরা রেলকে ধাক্কা দিয়ে অঘটন ঘটায়। চট্টগ্রামে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি এ মন্তব্য করেন।  রেলমন্ত্রী প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, অন্যরা রেলকে ধাক্কা দিয়ে য?দি অঘটন ঘটায় তার জন্য কি রেল দায়ী? রেল যখন চলাচল করে তখন আশপাশ দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। রেল রেলের লাইনে চলে। অন্য কেউ রেলের সঙ্গে ধাক্কা খাবে, তার দায়িত্ব রেলের ওপর বর্তাবে, এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। রেল কাউকে ধাক্কা দেয় না, আরেকজন এসে ধাক্কা দিয়ে রেলকে অনিরাপদ করছে, এর দায়িত্ব রেল নেবে না। মন্ত্রী আরও বলেন, রেলে ব্যারিকেড বা গেট দেয়া হয় অন্যের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য না। 

রেলকে কেউ যাতে অনিরাপদ করতে না পারে তার জন্য এসব গেট দেয়া হয়। রেল লাইনের উপর দিয়ে পথ বানিয়ে যারা চলাচল করেন তাদের উচিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। রেল যদি নিজের লাইন রেখে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তাহলে এটা রেল দুর্ঘটনা হবে, তার দায়িত্ব রেল নেবে। রেলমন্ত্রীর এ মন্তব্য নিয়ে ফের আলোচনা দেশজুড়ে। আচ্ছা এমন ঘটনা যদি অন্য দেশে ঘটতো তাহলে সেদেশের মন্ত্রী কি এমন কথা বলতে পারতেন? পাশের দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক- একটি রেল দুর্ঘটনার পর মন্ত্রীর পদত্যাগ করার উদাহরণ রয়েছে একাধিক। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ভারতে। এর দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সে সময়ের রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুর্ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ না করে অপেক্ষা করতে বলেন। সে সময় সুরেশ প্রভু এক টুইট বার্তায় লেখেন, ‘দুর্ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ভার নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করেছি। তবে তিনি আমাকে অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।’ তবে প্রভু টুইট করার কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান অশোক মিত্তাল পদত্যাগ করেন। টুইট করে রেলমন্ত্রী প্রভু জানান, দুর্ঘটনার কারণে তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছেন। 

গত বছরের ঘটনা। একটি রেল দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তাইওয়ানের পরিবহন মন্ত্রী লিন চিয়া-লাং। কিন্তু বাংলাদেশে দায় নেয়া তো দূরে থাক, দায় অন্যের কাঁধে চাপানোর যে কৌশল সেটি ভালো করেই জানেন মন্ত্রীরা। তাই তো তারা বলে উঠেন রেল কাউকে ধাক্কা দেয়নি। বরং রেলকে ধাক্কা দিয়ে তারা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।  এমনিতেই রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির প্রতিবাদ আন্দোলন সাড়া জাগিয়েছে সর্বত্র। তার টানা আন্দোলনে রেল কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে বসতে বাধ্য হয়। মোটামুটি একটা সমঝোতায় পৌঁছে তারা। দু’দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে রনি দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে গিয়ে অনিয়ম ধরছেন। আখাউড়া রেল জংশনে গিয়ে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৭৫ টাকার টিকিট ১২০ টাকা নেয়ার চিত্র তুলে ধরেন রনি। টিকিট কাউন্টারেই ঘটে এ ঘটনা। আবার দেখা গেছে, রাজশাহী গিয়ে সেখানকার শৃঙ্খলা দেখে প্রশংসাও করেছেন। রাজশাহীতে অবশ্য সারাটা সময় রেলওয়ে পশ্চিম জোনের প্রধান রনিকে সময় দেন। প্রশ্ন হলো-রনি কি এসব দেখতে পারেন? নাকি রেল কর্তৃপক্ষ এসব অনিয়ম, দুর্নীতি রোধে কমিটি করে তারা ধারাবাহিক অভিযান চালাবেন। এ কমিটিই অনিয়মরোধে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। রনি তো শুধু দেখাতে পারবেন। কোনো শাস্তি দিতে পারবেন না। 

 

 

রনি চলে এলে সেখানে আবার আগের মতো অনিয়ম চলতে থাকবে। রনির ক্ষমতা নেই বলেই তো আখাউড়া রেল জংশনের টিকিট কাউন্টারে থাকা সেই ব্যক্তিকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করেও নাম বলাতে পারেননি। আবার ডেকেও কাছে আনতে পারেননি। আসলে নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়- এটাই রনি প্রমাণ করছেন। আরও প্রমাণ হয়েছে রনিরা অনিয়ম- দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারণ চাপাবাজি এখন মোক্ষম ওষুধ। এ ওষুধ যারা খেয়েছেন তাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা খুবই কঠিন। ওই যে দুই বন্ধুর মতো। তারা দুই জন গল্প করছিলেন। একজন বলছিলেন, আমার নানা বাড়িতে বিশাল গোয়াল ঘর ছিল। যে গোয়াল ঘরের এক দরজা দিয়ে একটি গাভী প্রবেশ করলে অন্য দরজা দিয়ে বের হলে বাছুর নিয়ে বের হতো। ওই দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে গাভী এ ঘরেই গর্ভবতী হতো। আর বের হতে হতে প্রসবের সময় হতো। প্রসবের পর বাছুর নিয়ে একসঙ্গে ওই দরজা দিয়ে বের হতো। এবার বুঝো কতো বড় গোয়াল ঘর ছিল এটি। বন্ধুর এ গল্প শুনে অন্যজন বলে উঠলো, দেখ আমার নানা বাড়িতে একটি কোডা (মাটিতে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে ফল পেড়ে আনার দেশে তৈরি যন্ত্র) ছিল। কোডাটি এত বড় ছিল যে, এটি দিয়ে আকাশ থেকে চাঁদ পেরে আনা হতো। কথাটি শুনে ওই বন্ধু বললো, আচ্ছা এই কোডা কই রাখা হতো? বন্ধুর ঝটপট উত্তর-কেন তোর নানা বাড়ির গোয়াল ঘরে।    দুই: যান্ত্রিক এ যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের মন। 

এ পরিবর্তন চোখের সামনে এনে দিচ্ছে আজব সব কাহিনী। প্রেম-ভালোবাসাও যেন সব যন্ত্রকে ঘিরে। বুকভরা ভালোবাসা এখন শুধুই অতীত। এক রিমোটে বন্দি সব। এখন প্রসব বেদনা কি তা মায়েরা জানেন না। তার আগেই ছুরি চলে পেটে। কতো কষ্টের ধন সন্তান তা আর বুঝতে হয় না এখনকার মায়েদের। আর তাই আগে যেমন মায়েরা নারী ছেঁড়া ধন বলতেন। এখন আর মায়েরা সেভাবে বলতে পারেন না। আগেকার মায়েদের মতো বুকের দুধ খাওয়াতে চান না এখনকার মায়েরা। শরীরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে তাই। এখন দশ গ্রাম খুঁজেও পাওয়া যায় না যৌথ পরিবার। আধুনিকতা সবাইকে শিখিয়েছে একা থাকার কৌশল। শিখিয়েছে একা থাকার সুবিধা। ডিজিটাল জামানায় যা হচ্ছে তার সবই ডিজিটাল। আর এ ডিজিটাল নাকি এখন রাবারের চাল, যান্ত্রিক ডিম সবই খাওয়াচ্ছে মানুষকে। আধুনিকতার নামে পশ্চিমা কালচার ভর করেছে এই বাংলাদেশে। সালাম দেয়ার পরিবর্তে ‘হায়, হ্যালো’ জায়গা করে নিয়েছে অনেক আগেই। একটি প্রজন্ম আঁকড়ে ধরেছে এ কালচারকে। প্রকাশ্যে প্রেমিক যুগলের বেলাল্লাপনায় অন্যকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হলেও তাদের তাতে কিছু যায় আসে না। বাঙালির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা কালচারের কাছে। বাংলাদেশের জাতীয় খেলার নাম হা-ডু-ডু এটি জানেন না বর্তমান প্রজন্ম। তাদের খেলা অ্যান্ড্রয়েড ফোন নিয়ে। 

গভীর রাত পর্যন্ত চলে গ্রুপ করে খেলা। দাড়িয়াবান্দার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, এটা কি জিনিস।  হায়রে প্রজন্ম। সন্তানরা জিজ্ঞেস করে ‘চাল’ গাছ কেমন বাবা? লাউ গাছ কতো মোটা। রুই মাছ আর কাতল মাছ তাদের চেনার দরকার নেই? ফার্মের মুরগি হলেই হলো। গ্রামের ঐতিহ্য চিতই পিঠা, পাটিশাপটা, তেলের পিঠা ওদের আকৃষ্ট করতে পারে না। ওরা আকৃষ্ট হয় ফাস্টফুডে। পিৎজা, বার্গার এসবে। ছাদে বারবিকিউ পার্টি চলে বন্ধুদের নিয়ে। ওদের আইডল হয় ভারতীয় নায়িকা কারিশমা কাপুর, শ্রীদেবী কিংবা ঐশ্বরিয়া রায়। রাত দিন ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে মত্ত থাকে ওরা। খেতে বসলেও চলে টিভি। ওয়াইফাই, ডিশ এক মিনিটের জন্য বন্ধ হলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ফেনসিডিল, ইয়াবা সেবন যেন ফ্যাশন। বন্ধুত্বে ছেলেমেয়ে পার্থক্য নেই। সবাই এক। নাচানাচি, হৈ-হুল্লোড়ে মাতোয়ারা সবাই। এর বাইরে থেকে একটা অংশ নিজেকে প্রস্তুত করেন। জ্ঞান আহরণ করেন। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে কোথায়। বাধ্য হয়ে মেধা পাচার হচ্ছে। মেধার অবমূল্যায়নই এখানে ফ্যাক্টর। স্বজনপ্রীতি, তদবিরে মেধাবীরা ছিটকে পড়ছেন। এ মেধা কাজে লাগছে অন্য দেশের। আমরা আত্মতৃপ্তি বোধ করি বাংলাদেশের সন্তান বলে। 

এতে দেশের কী লাভ হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত যে রেমিট্যান্স পাচ্ছে তা সে দেশের অষ্টম স্থান। এত ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে? গার্মেন্ট সেক্টরের ঊর্ধ্বতনদের মধ্যে ভারতীয়ই নাকি বেশি। যেখানে দেশে লাখ লাখ বেকার যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে ভারতীয়রা বাংলাদেশে চাকরি করে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কি? হয়তো দেশে গার্মেন্ট খাতে কাজ করবে- এমন মেধা নেই। কিংবা যে সব মেধা ছিল তারা অন্য দেশে তাদের মেধা বিলাচ্ছে। খবর নিয়ে জানা গেল, দেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেও বেকার ঘুরছে- এমন সংখ্যাও কম নয়। তাহলে আমরা তাদের কাজে না লাগিয়ে অন্যদেশ থেকে লোক আনছি কেন? প্রশ্ন উঠতে পারে মেধাবীদের মধ্যে কি দেশপ্রেম নেই? অবশ্যই আছে। তাহলে? এখানেও দেখা যায়, দেশের পরিস্থিতি এমন যেখানে দেশপ্রেমের মূল্য নেই। চাটুকারিতা, চামচাগিরি এখানে অগ্রাধিকার পায়। আর এটা করতে গিয়েই পাল্টে যায় গতিপথ। ঘটে একটা, বলে আরেকটা। এভাবেই চলছে সবকিছু। সব জায়গায়ই চাপাবাজির জোর বেশি। এমন চাপাবাজও দেখা যায় সমাজে যার চাপার উপর দিয়ে রেল গাড়ি গেলে রেলের চাকা ব্লাস্ট হবে। কিন্তু তার চাপার কোনো ক্ষতি হবে না।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status