ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

‘পরিকল্পিত লোডশেডিং’ কতোটা পরিকল্পিত!

শুভ কিবরিয়া
২ আগস্ট ২০২২, মঙ্গলবার
mzamin

বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কম মূল্যের জ্বালানির যোগান। নিজস্ব গ্যাস যদি আমরা ব্যবস্থা করতে না পারি তবে বেশি দামের গ্যাস, আমদানিকৃত দামি তেল আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। এর সঙ্গে আছে লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের সংস্কৃতি। আছে অদক্ষতা-অন্যায্যতা-অসাধুতা। এখনই দেখা যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় আমরা যে দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তার চাইতে কম দামে বিদ্যুৎ আমদানি করা যায়

সরকার হালে ‘পরিকল্পিত লোডশেডিং’ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা দেয়ার আগেও লোডশেডিং ছিল। পরেও হয়তো থাকবে। তবে অতীতে এতটা আয়োজন করে কখনো লোডশেডিং দেয়া হয়নি। দেশব্যাপী লোডশেডিং নিয়ে পরিকল্পনার কথাও কর্তৃপক্ষের পক্ষে এভাবে কখনো প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয় নাই। ফলে এবারের লোডশেডিংয়ের একটা আলাদা রকম মাহাত্ম্য আছে।

বিজ্ঞাপন
তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের একটা আগ্রহ ছিল এবারের লোডশেডিং নিয়েও।

লোডশেডিং চলছে। গ্রামে তো বটেই শহরেও এখন হরহামেশা লোডশেডিং চলছে। আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কারিগরিভাবে খুব একটা বৈষম্য না থাকলেও গ্রাম ও শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মধ্যে একটা বৈষম্য আছে। শহরের মানুষ যে কোয়ালিটির বিদ্যুৎ পায় গ্রামের মানুষ সেই কোয়ালিটির বিদ্যুৎ পায় না। নিরবচ্ছিন্ন, ন্যায্য ভোল্টেজের বিদ্যুৎ গ্রামের মানুষের কপালে খুব কমই জোটে। এর বহুবিধ কারণ আছে। তারমধ্যে অনেক কারণ খুবই যুক্তিসঙ্গতও বটে। যেমন শহরের মানুষের বসবাসের প্যাটার্ন জনবহুল। এক জায়গায় অনেক লোক বাস করে। ফলে এক জায়গায় বহু মানুষকে বিদ্যুৎ সেবা দেয়াটা কারিগরিভাবে সহজ, লাভজনক ও নিরাপদ। গ্রামের ক্ষেত্রে তা উল্টো। গ্রামে মানুষ এক জায়গায় ঘন হয়ে বসবাস করে না। ফলে বহু মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে হলে বহু কারিগরি আয়োজন লাগে। গ্রামে গাছপালা বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। সামান্য ঝড়-বাদলেই গাছপালা বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহে বিপত্তি সৃষ্টি করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কমতি না থাকলেও গ্রামের মানুষের জন্য সারা বছর লোডশেডিং পাবার অভিজ্ঞতা খুবই প্রাত্যহিক। তাই এবারের লোডশেডিংয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা গ্রামের মানুষের জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতাও বটে! 

 

 

বাংলাদেশে গ্রামের বড় অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। টাঙ্গাইল জেলার এক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির স্থানীয় অফিসে বসে আছি কর্তাব্যক্তির রুমে। গিয়েছি তার অভিজ্ঞতা জানতে। কীভাবে লোডশেডিং পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন তা বুঝতে। দেখি ভদ্রলোক ফোনে কথা বলছেন লোডশেডিং নিয়েই। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাচারা জেরবার হয়ে পড়েছেন ফোনের অপর প্রান্তের মানুষকে তার কথা বোঝাতে। শেষে দেখলাম একটু বিরক্তই হয়ে পড়ছেন। কথায় তার উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। কথা শেষ হতেই জানলাম ফোনের অপর প্রান্তে সরকারি সংস্থার দায়িত্বশীল এক লোকের ভুল ভাঙ্গাচ্ছিলেন। ভুলটা কি? সরকার বলেছে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং দেয়া হবে না। অথচ দিনে কয়েকবারে কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে, ফোন যিনি করেছিলেন তার এলাকায়। তাহলে কি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ খোদ সরকারি নির্দেশই অমান্য করছেন? অভিযোগ ছিল সেটাই। পল্লী বিদ্যুতের সেই কর্মকর্তার দাবি হচ্ছে, ফোনে যিনি কথা বলছিলেন, তিনি সরকারি ঘোষণার ভুল ও অযথার্থ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সরকার কখনই বলে নাই, দিনে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হবে না। বরং সরকার বলেছে, যখনই লোডশেডিং হোক, প্রতিবার এক ফিডারে যাতে একঘণ্টার বেশি লোডশেডিং না হয় সেটা নিশ্চিত করা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সেটাই খেয়াল করার চেষ্টা করছে। যখনই লোডশেডিং হোক, যে ফিডারে লোডশেডিং করা হচ্ছে, যখনই করা হোক, তখন যেন টানা এক ঘণ্টার বেশি সময় সেই এলাকাকে অন্ধকারে রাখা না হয়। সরকার যে তার পরিকল্পিত লোডশেডিং বলতে এরকম একটা ব্যখ্যা দিয়েছেন সেটা আমারও নজরে আসেনি। বরং আমি নিজেও চিন্তা করে বের করতে পারিনি যে, এটা কীভাবে সম্ভব? মাত্র এক ঘণ্টার লোডশেডিং সারা দিনে? স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে এসে আমারও ভুল ভাঙলো। বুঝলাম ‘পরিকল্পিত লোডশেডিং’ মানে, দিনে একবার এক ঘণ্টার লোডশেডিং নয়। 

প্রয়োজনে বহুবার লোডশেডিং হতে পারে। কিন্তু প্রতিবার এক ঘণ্টার বেশি নয়! আমার ধারণা লোডশেডিংয়ের এই ব্যাখ্যাটা মানুষকে সঠিকভাবে দেয়া যায় নাই। গেলে হয়তো মানুষের ক্ষুব্ধতা কমতো। মানুষের নিজস্ব প্রস্তুতিও থাকতো। 
আমাদের দেশের সরকারগুলো সিদ্ধান্ত নেয় উপর থেকে। তারপর তা চাপিয়ে দেয়া হয় নিচের দিকে। টপ টু বটম চলে এই প্রক্রিয়া। ফলে নিচের দিকের সমস্যাটা ঠিক কি, সেটা উপর অবধি সবসময় পৌঁছায় না। বা পৌঁছুতে পারে না টপ টু বটম সিস্টেমের কারণে। ফলে মানুষের কষ্ট লাঘব করা সব সময় সহজ হয় না, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও। লোডশেডিং পরিস্থিতি বুঝতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গিয়ে তা টের পেলাম হাড়ে হাড়ে। সেখানকার বিদ্যুৎ বিভাগের অভিজ্ঞতা শুনলাম। দেখলাম তারা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তার সিংহভাগ চলে যায় বড় বড় কয়েকজন শিল্পগ্রাহকের কাছে। দু-তিনজন শিল্পগ্রাহক সর্বোচ্চ ভোল্টেজ লেভেলে বিদ্যুৎ নেন। ফলে তাদের লোডশেডিং করা যায় না। তারা কখনই লোডশেডিংয়ের মুখে পড়েন না। বাকি বিদ্যুৎ সাধারণ গ্রাহক লেভেলে যায়। ফলে টানাটানির মধ্যে একরকম লোডশেডিং পরিকল্পনা করে তা গ্রাহককে জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রান্তে নানা রকম কারিগরি, অকারিগরি সমন্বয়হীনতার কারণে। ধরা যাক সরবরাহ প্রান্তে বলা হলো, আপনাদের এখন ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়া হবে। সরবরাহ প্রান্তে সেটা নিয়েই লোডশেডিং পরিকল্পনা করা হলো। 

গ্রাহককেও জানিয়ে দেয়া হলো। আধাঘণ্টা পরেই গ্রিড থেকে সরবরাহ প্রান্তে জানিয়ে দেয়া হলো আপনারা এখন ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবেন। বাকি ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কাটেন এখনই। জেনারেশন কম হচ্ছে। জেনারেশন প্রান্তে ফিকোয়েন্সি সমস্যা হচ্ছে ইত্যাদি। এখন সরবরাহ প্রান্তে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের তো মাথায় হাত। কীভাবে তারা এটা ম্যানেজ করবেন। এবং এই সিদ্ধান্তগুলো কাজে পরিণত করতে সময় পাওয়া যায় না। যখন বিদ্যুৎ কমাতে বলা হয় তখনই সেটা না কমালে সারা দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থায় বিপত্তি ঘটতে পারে। ফলে, সরবরাহ প্রান্তে একটা হ-য-ব-র-ল ঘটনা ঘটে। দারুণভাবে গ্রাহক অসন্তুষ্টি ঘটে। পরিকল্পিত লোডশেডিং গ্রাহক প্রান্তে তাই স্বপ্নই থেকে যায়! মাঠের এই সমস্যা কখনই ঠিকমতো উপর অবধি যায় না। দুটো কারণে যায় না। এক. উপরের লোকেরা সমস্যার কথা শুনতে চান না। দুই. সঠিক জায়গায় সমস্যার কথা জানিয়ে সঠিক সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারটা কেউই বহন করতে চান না। ফলে, মাঠপ্রান্তে গ্রাহক হয়রানি কমে না, বাড়তেই থাকে। আর বিদ্যুৎ বিভাগের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রাহকপ্রান্তে দিনরাত কাজ করেন তারা গ্রাহকদের গালমন্দ শুনতেই থাকেন অহরহ, যদিও এ বিষয়ে তারা মোটেই দায়ী নন। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণেও নানা জায়গায় গ্রাহক ভোগান্তি কমানো যাচ্ছে না। অথচ সেদিকে কারও খুব একটা নজর আছে, তার প্রমাণ মেলেনি।
এত গেল মাঠপ্রান্তে নানা সংকটের কথা। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে শতভাগে বিদ্যুতে দেশ ভাসার পরও কেন এরকম লোডশেডিংয়ের মুখে পড়তে হলো। 

বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমিয়ে দিতে হয়েছে। আমরা বাস্তব পরিস্থিতি কিছুটা দেখতে পারি। ২৮শে জুলাই ২০২২ তারিখে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল বাস্তবে ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট। দিনের বেলায় ওই তারিখে সর্বোচ্চ উৎপাদিত হয়েছে ১০ হাজার ৯১২ মেগাওয়াট, রাতে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮৬৭ মেগাওয়াট। জ্বালানির কারণে ওইদিন বিদ্যুৎ ২ হাজার ৯০২ মেগাওয়াট কম উৎপাদিত হয়েছে। এই ডাটা বলছে, এখন আমরা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাস্তবে তার চাইতে দ্বিগুণ। অথচ গ্রাহক লোডশেডিং ভোগ করছে। ২৭শে জুলাই ২০২২ তারিখে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে তার মধ্যে গ্যাস জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ৪৬.৭%, তেলে ৩১.৬%, কয়লায় ১১%, পানিতে ১.১২%, সোলার ০.৫৪%। অর্থাৎ অনেক ঢাকঢোল পেটানোর পরও বাস্তবে আমরা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুব একটা এগুতে পারি নাই এখনো। এখানেও পরিকল্পনার ‘পরী’ আকাশে ডানা মেলতে পারে নাই।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কম মূল্যের জ্বালানির যোগান। নিজস্ব গ্যাস যদি আমরা ব্যবস্থা করতে না পারি তবে বেশি দামের গ্যাস, আমদানিকৃত দামি তেল আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। এর সঙ্গে আছে লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের সংস্কৃতি। আছে অদক্ষতা-অন্যায্যতা-অসাধুতা। এখনই দেখা যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় আমরা যে দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তার চাইতে কম দামে বিদ্যুৎ আমদানি করা যায়। ফলে, মূল্যের হিসাবে একসময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাইতে আমদানিই হবে লাভজনক। বিদ্যুতে আমরা যদি আমদানিনির্ভরই হয়ে পড়ি তবে জ্বালানি নিরাপত্তা কতোটা সুরক্ষা পাবে সেটা ভাবার বিষয়। কাজেই বিদ্যুতের পরিকল্পনার পাগলা ঘোড়াটাকে এখন থামানো দরকার। দরকার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে নব-মূল্যায়ন। নইলে গানের কথায় বলতে হয়, ‘সময় গেলে সাধন হবে না...।’
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status