মত-মতান্তর
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন
দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে চলছে ভয়ংকর নীরবতা!
সৈয়দ আব্দুল আজিজ
(২ মাস আগে) ২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ২:১৯ অপরাহ্ন
দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত একটা গল্প বলি। গল্পটা সত্তর-আশির দশকে বেশ আলোচিত ছিল। সেকালে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া উত্তরাঞ্চলে ‘বিদেশ যাওয়া’ বলতে নিজ বাড়ি থেকে দূরবর্তী কোনো জেলায় বা যমুনা নদী পার হওয়া বোঝানো হতো। সে রকম এক বিদেশগামী ছেলের বাবা সাত গ্রামের লোক জেয়াফত (দাওয়াত) দিয়ে খাওয়ানোর আয়োজন করেছে। লোকজন দাওয়াত খেয়ে জিজ্ঞেস করছে, ছেলে কোন দেশে চাকরি করতে যাচ্ছে? ছেলের বাবা গর্বভরে উত্তর দিচ্ছে, আরিচা ঘাটে!
আমাদের একটা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) আছে, তাদের কাজ-কর্ম আর দক্ষতার বহর দেখে আমার নিজ অঞ্চলের সেই পুরোনো গল্পের কথাই মনে হচ্ছে। ২৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৩০ টিরও বেশি সরকারি দপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত এই কর্তৃপক্ষ দেশকে স্মার্ট (?) বাংলাদেশ বানানোর ঘোষণা দিয়ে যা করছে তা যেন সেই আরিচা ঘাটে চাকরির নামে বিদেশ যাওয়ার অবস্থা! আগারগাঁও শেরে বাংলা নগরে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দপ্তর।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে এই দপ্তরের মর্যাদা সবার উপরে। ঠিক রংপুর অঞ্চলের আরো একটা গল্পের মতো! অগ্রহায়ণ মাস, এক দিনমজুর কাজের জন্য গিয়েছে দূরের এক গেরস্থ বাড়িতে। গেরস্ত আবার স্কুলের হেড মাস্টার! গেরস্তের সঙ্গে দিনমজুরের পরিচয় পর্বের সংলাপটা আঞ্চলিক ভাষায় ছিল এ রকম-
দিনমজুর-বাহে, তুমি কি মাস্টের?
গেরস্ত-হুম।
দিনমজুর-তুমি কি হেড মাস্টের?
গেরস্ত-হুম।
দিনমজুর-তুমি কি সব মাস্টেরের উপর?
গেরস্ত-হুম।
দিনমজুর-তুমি তো যা তা মাস্টের নও বাহে!
(এর অর্থ অনেক বড় মাস্টার! রংপুর অঞ্চলে কাউকে সম্মান জানাতে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা হয়)। ঠিক জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মর্যাদা বুঝাতে এই দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায়শই এভাবে পরিচয় দেন ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’। মানে সব দপ্তরের উপর এর অবস্থান! স্বয়ং মাননীয় (?) প্রধানমন্ত্রী এর গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান। দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক পেশাগত কোনো দক্ষ ও অভিজ্ঞ নির্বাহী এ দপ্তরে না থাকলেও নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ সকল নির্বাহী পদসমূহ একদল আমলার আলোয় আলোকিত! পরিপূর্ণ দক্ষ (?) সাংগঠনিক কাঠামো! লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট (?) বাংলাদেশ বিনির্মাণ!
‘শমী কায়সার’ শিল্প দক্ষতা পরিষদের চেয়ারম্যান! দক্ষতা উন্নয়নের সর্বত্র হিম শীতল নীরবতা!
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী ১০০ দিনের পরিক্রমায় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ডে চলছে ভয়ংকর স্থবিরতা, অনেকটা কানফাটা নীরবতা! পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বদলে এসেছে প্রধান উপদেষ্টার ছবি। প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েকজনের বাণী দিয়ে নাম দেয়া হয়েছে বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩! গ্রেফতারকৃত ‘শমী কায়সার’ নামক বিতর্কিত অভিনেত্রী এখনও শিল্প দক্ষতা পরিষদের একটি সেক্টর চেয়ারম্যান পদকে শোভাবর্ধন করছেন! কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সর্বত্র চলছে অচলাবস্থা ও হতাশা। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শিক্ষক অবরোধে অফিসে ছিলেন না বহুদিন। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব পলিটেকনিক ছাত্রদের উত্থাপিত কারিগরি শিক্ষা সংস্কারের ৬ দফার দাবিকে নামকাওয়াস্তে কমিটি গঠনের মাধ্যমে হিমাচলে পাঠিয়ে শান্তিতে সময় কাটাচ্ছেন! কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান পদে ব্যক্তি পরিবর্তন হয়েছে, অচলাবস্থার কোনো পরিবর্তন নাই! সবমিলিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন চরাচরে চলছে হিম শীতল নীরবতা!
দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠা-নামার অঙ্ক!
বাংলা পাটিগণিতে তৈলাক্ত বাঁশে উঠা-নামা বিষয়ক এক রম্যগণিতের সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজকর্মের অঙ্ক মেলাতে পাটিগণিতের সেই অঙ্কের উপমা অবধারিতভাবে চলে আসে! কাকতালীয়ভাবে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমেও এই উঠা-নামার একটা হিসাব আছে। সেই হিসাবটা দেখে নিলেই বুঝা যাবে যে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা কি এগোচ্ছি? নাকি পেছাচ্ছি? এগোলে কতটুকু এগিয়েছি? নাকি পথটাই হারিয়ে ফেলেছি? আসুন দেখে নেই সেই উঠা-নামার হিসাবটা।
দক্ষতা উন্নয়নে এগোনোর কথা
দেশে দক্ষতা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম শুরু ২০০৮ সালে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘টিভিইটি সংস্কার’ প্রকল্পের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে জাতীয় দক্ষতা নীতি পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে ব্যাপক মতবিনিময় শেষে ২০১২ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ অনুমোদিত এবং দক্ষতা উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ (এনএসডিসি) গঠিত হয়। ২৩ টি মন্ত্রণালয় এবং ৩০ টি সরকারি সংস্থা, শিল্পসংস্থা, ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনসহ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদের প্লাটফর্মে সংযুক্ত করা হয়। বেসরকারি অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে শুরু হয় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। চালু হয় শ্রমবাজারের চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও সনদায়ন। ৭ শতাধিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় নিবন্ধন করা হয়। ৯টি আর্থিক খাতে কর্মসংস্থানের চাহিদা নিরূপণ করে ‘স্কিলস স্ন্যাপ সট ২০১২’ প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান জরিপ সম্পন্ন হয়। ২০১৬ সালে দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে বাংলাদেশ যোগ্যতা কাঠামো এবং শ্রমশক্তির কৌশলগত পরিকল্পনা (Strategic Workforce Plan) ধারণাপত্র উপস্থাপিত হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো (বিএনকিউএফ) অনুমোদিত হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে পেশাভিত্তিক দক্ষতা সমন্বয় করে ২০৩০ সাল নাগাদ ১২০ মিলিয়ন শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য সরকারের নিকট কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হিসেবে দক্ষতা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরবর্তী ৩টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০৩৫) মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ উপস্থাপিত হয়। দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের এসব প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হয় প্রধানত তিনটি পক্ষের সমন্বিত প্রয়াসে; দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণের গবেষণা ও সুপারিশ, শিল্পসংস্থাসহ বেসরকারি অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সরকারের আর্থিক, প্রশাসনিক ও আনুষঙ্গিক সহায়তা। বিশেষ করে দক্ষতা উন্নয়নের প্রবাদপুরুষ আব্দুর রফিক-এর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদলের প্রাণান্তকর প্রয়াস, সালাউদ্দিন কাশেম খান, লায়লা রাহমান কবির প্রমুখ শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের ঐকান্তিক সহায়তা এবং নবগঠিত জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদে কর্মরত বিভিন্ন সেক্টর থেকে আসা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের একটা ভিত্তি তৈরি হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের রহস্যজনক পদক্ষেপ!
২০১৮ অবধি এসব প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গৃহীত হতে থাকে রহস্যজনক সব পদক্ষেপ! নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তৎকালীন এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, মুখ্যসচিব, অর্থসচিব (সদ্য পদত্যাগী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর) সহ সংঘবদ্ধ একদল আমলা। গ্রহণ করা হয় নজিরবিহীন কিছু আইনি পদক্ষেপ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত। উপেক্ষিত হতে থাকে দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং বেসরকারি অংশীজনের মতামত। এমনকি দক্ষতা উন্নয়নে সর্বাধিক সম্পৃক্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আপত্তি আমলে না নিয়ে প্রণীত হয় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৮। গঠন করা হয় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাতিল করে দেয়া হয় দক্ষতা উন্নয়নে সমন্বয় সাধনকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ (এনএসডিসি)।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে পরিপূর্ণ আমলা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সমন্বয়মূলক ভূমিকা (Apex Bodz) পালনের পরিবর্তে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সেই সঙ্গে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১ বহাল রেখেই নতুন আরো একটি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০২২ জারি করা হয়। অর্থাৎ একই শিরোনামে দু’টি দক্ষতা উন্নয়ন নীতি চালু করা হয় এবং যুক্তি দেখানো হয় যে, ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আলাদা’, সুতরাং দুটো দক্ষতা উন্নয়ন নীতি থাকতে সমস্যা নেই। এসব উদ্ভট সিদ্ধান্তের ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় সর্বত্র। যেখানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একটি অবিভাজ্য বিষয়, সেখানে শিক্ষা থেকে প্রশিক্ষণ বাদ দেয়া হবে কীভাবে? অতীব ক্ষমতাবান এসব আমলাদরে একই উত্তর ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত’। সুতরাং দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহ বাস্তবায়ন করবে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে (১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান) এ সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়। (সূত্র: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্ধারণ বিষয়ক সভার কার্যবিবরণী)। দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এহেন নজিরবিহীন সিদ্ধান্তের ঘটনায় মনে পড়ে যায় বাংলার এক কবিকে যিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে বাবার ঔরসে সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এখন নাতির ঔরসে দাদার জন্ম হচ্ছে!’
প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে চলছে অচলাবস্থা!
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এইসব সিদ্ধান্তের ফলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শুরু হয় বিপর্যয়! দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে দেশ। অচলাবস্থা তৈরি হয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে। কোন সংস্থার কী ম্যান্ডেট তা নির্ধারণে সৃষ্টি হয় ধুম্রজাল। প্রায় ৭ শতাধিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও সনদায়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যার পরিমাণ মাসে প্রায় ২০ হাজার। এ যেন পূর্ণ গতিসম্পন্ন একটি গাড়িকে ব্রেক করে থামিয়ে দেয়ার নামান্তর! অকার্যকর করে দেয়া হয় প্রশিক্ষণে নিয়োজিত প্রশিক্ষকসহ দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণ বাহিনীকে। পরিবর্তে নতুন চালকের হাতে দেয়া হয় দক্ষতা উন্নয়নের গাড়ি! এই ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দীর্ঘদিন থেকে বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও অচলাবস্থা এখনও বিদ্যমান! বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় নিবন্ধিত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সমূহের অবস্থা এখন লালন ফকিরের গান স্মরণ করে দিচ্ছে, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়’।
দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রশ্নবিদ্ধ দক্ষতা!
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চলমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বন্ধ করে দিলেও তাদের নিজেদের কর্মদক্ষতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আইনানুগভাবে এই কর্তৃপক্ষের দায়িত্বগুলো হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয় সাধন, কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, তথ্যভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণের মানদণ্ড নির্ধারণ, শিল্প দক্ষতা পরিষদ গঠন, শিল্প সংযুক্তি কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন তহবিলের সুষ্ঠু ব্যবহার, যুব সমাজকে দক্ষতা প্রশিক্ষণে আগ্রহী করণ প্রভৃতি। সর্বোপরি দেশের বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমশক্তির উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বিগত ৫ বছরের কার্যক্রমের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র রূপকল্প বাস্তবায়ন’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ এইসব পোশাকি কথাবার্তা ছাড়া দক্ষতা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন নেই। ১৬ টি শিল্প দক্ষতা পরিষদ গঠন করা হলেও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংযোগ এবং কর্মসংস্থানে কোনো অগ্রগতির তথ্য নাই। তাছাড়া ‘শমী কায়সার’ জাতীয় ব্যক্তিবর্গ কোন দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে শিল্প দক্ষতা পরিষদের চেয়ারম্যান সে প্রশ্ন উঠতে পারে! ৭টি প্রতিষ্ঠানকে মানব সম্পদ উন্নয়ন তহবিল সহায়তার আওতায় আনা হলেও সহায়তার মাত্রা এবং দক্ষতা উন্নয়নের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২২ থেকে ২০২৭ সাল নাগাদ ৮৬ লাখ শ্রমশক্তির প্রশিক্ষণ নামে যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বিগত ৩ বছরের অগ্রগতির তথ্য না থাকায় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দক্ষতাই এখন প্রশ্নের মুখোমুখি।
আমলাগণ জানেন কীভাবে কাজ না করা যায়!
দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও অংশীজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি, বেসরকারি অংশগ্রহণ সংকুচিতকরণ, বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা, সর্বোপরি চলমান দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের গতিরোধ করতে তারা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন! এভাবে কাজ বন্ধ করা বা সচল কাজ বন্ধ করার দৃষ্টান্তে ড্যানিস কবি ‘পাইট হাইন’ (১৯০৫-১৯৯৬) এর অনুকাব্য (গ্রুক) স্মরণ করা যায়,
‘Experts have their expert fun,
Ex-Cathedra telling one,
Experts knwo hwo nothing can be done’
অর্থাৎ বিশেষজ্ঞগণের কৌতুকগুলোও বিশেষভাবে কৌতুককর! কারণ বিশেষজ্ঞগণই (আমলা) জানেন, কীভাবে কাজ না করা যায়! কমিটি গঠনের নাম দিয়ে অথবা নানা যুক্তিতে যুক্তিযুক্ত কাজকেও হিমঘরে পাঠানো যায়!
গোড়ায় গলদ!
খোদ ‘দক্ষতার’ সংজ্ঞা নির্ধারণে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি গুরুতর অসঙ্গতি লক্ষণীয়। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৮ অনুযায়ী জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০২২-এর ১.২ অনুচ্ছেদে দক্ষতার প্রদত্ত সংজ্ঞা মোতাবেক, কোন কাজ করিবার জন্য অর্জিত জ্ঞান ও কৌশল বা শিল্প ও বৃত্তির মান অনুযায়ী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মোতাবেক পণ্য ও সেবা উৎপাদনের সক্ষমতা ও সামর্থ্য অন্তর্ভুক্ত হইবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই সঙ্গাতে সময় গণ্য করা হয়নি যা গুরুতর বিচ্যুতি এবং দক্ষতার বিশ্বজনীন সংজ্ঞার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
‘চুবানো’র আশঙ্কা কি শেষ হয়নি?
নদীতে টুপ করে ফেলে দিয়ে চুবানোর গল্প বাংলাদেশে বেশ প্রসিদ্ধ! পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে পদ্মা নদীতে চুবানোর কথা বলেছিলেন। দক্ষতা উন্নয়নে এরকম এক রূপক গল্প বলি। গল্পটিতে নৌ পারাপারে যাত্রীবাহী নৌকাকে দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হিসেবে, নৌকার মাঝিকে আমলা হিসেবে আর আরোহীদেরকে দক্ষতা উন্নয়নের অংশীজন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ঢেউ বিঘ্নিত নদীতে আরোহীগণের নানা কোলাহলে টালমাটাল মাঝি মেজাজ হারিয়ে হুংকার দিয়ে বলছে, ‘এবার যে শালা নড়াচড়া করবে ঐ শালাকেই চুবানো হবে’! যাত্রীদের মাঝে নৌকার এক কোনে চুপচাপ বসে ছিল স্বয়ং মাঝির বাবা (দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ) ইষৎ ধীর গলায় বললেন, ‘বাবা, সব শালাকেই কি চুবানো হবে’? মাঝির অবিব্রত জবাব, ‘না, কোনো কোনো শালা বাদ’। এতোদিন দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ এইসব চুবানোর হুংকার থেকে কোন রকমে বেঁচে থাকলেও মুক্ত নতুন বাংলাদেশেও কি চুপ থাকতে হবে? নাকি তরুণদের জন্য দক্ষ আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে যোগ্য ব্যক্তিদের সরব হতে হবে? সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে সঠিক সময়ে না বসানোর খেসারত আর কতদিন বাংলাদেশ পরিশোধ করবে? পুনর্গঠন আশু প্রয়োজন!
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে অর্জিত বাংলাদেশকে গড়ার নতুন অভিযাত্রায় রাষ্ট্র সংস্কারের নানা উদ্যোগ থাকলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার এখনো দৃশ্যমান নয়। সকল সংস্কার ও উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে রাষ্ট্রের প্রয়োজন একটি শক্ত পাটাতন। দক্ষ জনশক্তি হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সেই শক্ত পাটাতন। বাংলাদেশের কর্মক্ষম বিপুল জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া দেশের বর্ধিত বেকারত্ব দূর করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সবার জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। সম্ভব নয় পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ বিপর্যয় রোধ করা। সম্ভব নয় জনগণের মধ্যে পাহাড়সম অর্থবৈষম্য দূর করা। বাংলাদেশকে এই অদক্ষতার চক্র থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন বিদ্যমান দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের মৌলিক পুনর্গঠন। স্থবির হয়ে যাওয়া কার্যক্রমগুলো সচল করতে হবে, সরকারি-বেসরকারি সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে, থেমে যাওয়া দক্ষতা উন্নয়নের গাড়িগুলোকে সচল করতে হবে। আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যেসব জঞ্জাল তৈরি হয়েছে তা দূর করতে প্রয়োজন যোগ্য ব্যক্তিদের নেতৃত্বে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে পুনর্গঠন।
দক্ষতা উন্নয়নে ‘লি কুয়ান’-এর কথা!
জ্ঞানতাপস আব্দুর রফিক আধুনিক সিঙ্গাপুরের রূপকার ‘লি কুয়ান’ (১৯২৩–২০১৫)-এর উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেই স্মৃতির আলোকে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। আশির দশকে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সিঙ্গাপুরে কর্মরত ছিলেন এবং কাছ থেকে দেখেছেন লি কুয়ানের উন্নয়ন দর্শন। একবার বিদেশি সংস্থার একটি বিশেষজ্ঞ দল সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে লি কুয়ানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, ‘আপনাদের সাহায্যের প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ, তবে আমাদের উন্নয়ন আমাদেরই করতে দিন।’
উল্লেখ্য, লি কুয়ান সিঙ্গাপুরের প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন নিজ দেশের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে করতেন। এ কারণেই সিঙ্গাপুর টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের যথাযথ অংশগ্রহণ নেই। এখানে বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং আমলাতন্ত্রই প্রধান ভূমিকা পালন করে। ফলে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও টেকসই উন্নয়ন কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যায়। এখনো এমন প্রকল্প চালু রয়েছে, যেখানে টার্মস অব রেফারেন্স এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন প্রকৃত দক্ষ ব্যক্তিরা সে কাজ করার সুযোগ না পান।
তবে আশার কথা হলো, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ানের মতো স্বপ্নদ্রষ্টা একজন নেতা এখন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি চাইলে দক্ষ ও সঠিক কাজের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্কার উদ্যোগের পাশাপাশি একটি সমন্বিত দক্ষতা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। আমলাদের বাতিল করে দেয়া দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ পুনর্গঠন করে সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনদের একত্রিত করে ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ কোটি কর্মক্ষম শ্রমশক্তিকে শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি দক্ষ, সমৃদ্ধ এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পদচিহ্ন তৈরি করা। যা হবে একটি ‘তিন শূন্যের বাংলাদেশ’, যেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অসমতা থাকবে না। আমাদের মেধাবী প্রজন্ম সেই পদচিহ্ন ধরে এগিয়ে যাবে, গড়ে তুলবে এক টেকসই ও সমৃদ্ধ দক্ষ বাংলাদেশ।
লেখক-দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং প্রফেসর, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস।
ই-মেইল- [email protected]
দেশের উন্নয়নের ও গঠনের প্রথম পূর্ব শর্ত কারিগরি সেক্টরের উন্নয়ন
শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে অন্যতম সেরা আর্টিকেল। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব আমলে নেয়া।
দেশের উন্নয়নের ও গঠনের প্রথম পূর্ব শর্ত হওয়ার কথা ছিলো কারিগরি সেক্টরের উন্নয়ন, তবে তেমন কোনো চিন্তা /পরিকল্পনা আমরা এখনো দেখিনি। সরকার সংশ্লিষ্ট মহোদয় এর কাছে আবেদন এই সেক্টরেও যেনো ভূমিকা রাখেন ও নজর দেন আপনারা।
দেশের উন্নয়নের ও গঠনের প্রথম পূর্ব শর্ত হওয়ার কথা ছিলো কারিগরি সেক্টরের উন্নয়ন, তবে তেমন কোনো চিন্তা /পরিকল্পনা আমরা এখনো দেখিনি। সরকার সংশ্লিষ্ট মহোদয় এর কাছে আবেদন এই সেক্টরেও যেনো ভূমিকা রাখেন ও নজর দেন আপনারা।
100% Sathik. Many Thanks.. I hope Your goodness.
আমি একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছি, সে সুবাধে এই বিষয় গুলির কিছুটা অনুধাবন করতে পারি। লেখক কে ধন্যবাদ, হয়ত লেখাটি কর্তিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ হবে এবং যথাযুগ্য ব্যবস্থা নিবেন।
দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়ে একটি চমৎকার আর্টিকেল।
শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে অন্যতম সেরা আর্টিকেল। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব আমলে নেয়া।