নির্বাচিত কলাম
৭ই নভেম্বর ঘটেছিল অভূতপূর্ব সিপাহী জনতার ঐক্য
শায়ের খান
৭ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার৭ই নভেম্বরের সেই উত্তাল অনিশ্চিত দিনগুলোয় সাধারণ সিপাহী-জনতার কাছে বেস্ট চয়েস ছিল জিয়াউর রহমান। এর কারণ, জিয়া ছিলেন স্মার্ট, ক্যারিশম্যাটিক, সাহসী ও দেশপ্রেমিক। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাত্রির পর নেতাবিহীন হতবিহ্বল জাতির সামনে দেবদূতের মতো উদয় হয়েছিলেন এই অখ্যাত ‘মেজর জিয়া’।
রেডিওর যন্ত্রপাতি টেনে দুর্গম কালুরঘাট থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা আর কমান্ডিং গলায় ‘উই রিভোল্ট’ মুহূর্তে স্পার্ক করে মুক্তিকামী জনতাকে। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। জিয়াউর রহমানই হচ্ছেন একমাত্র নেতা যিনি দুই দুইবার দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে লিড দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৬শে মার্চ দেশে যখন কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন না, তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করে মুক্তিযুদ্ধে নামিয়ে দেন তিনি।
৭ই নভেম্বর এক ইতিহাসের নাম। এ জাতির জন্য শ্বাসরুদ্ধকর কয়েকটি রক্তস্নাত দিনের পরিসমাপ্তি। দিনটি ছিল বাংলাদেশের সিপাহী-জনতার বিজয়ের দিন। ইন ফ্যাক্ট পুরো জাতির উদ্ধার পাওয়ার দিন। আর সময়টা ছিল ১৯৭৫ সাল।
বাংলাদেশের জন্মের পরপরই দেশ ডুবে গিয়েছিল বেদনাদায়ক সব ড্রামাটিক ঘটনায়। অধিকার আর গণতন্ত্রের লড়াইয়ে লাখে লাখে জীবন দিয়ে এ জাতি এনেছিল বিজয়। কিন্তু অচিরেই দেখলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন, চুরি, লুটপাট, একদলীয় শাসন, গুম, খুন ও বিয়োগান্তক সব ঘটনা।
বাংলাদেশের জন্য ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বরের আগের ক’টা দিন ছিল অনিশ্চিত। ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত। সশস্ত্র ওয়েস্টার্ন মুভি’র মতো। মুভি’র কাহিনী নেয়া হয় জীবন থেকেই। আর এই ক’টা দিন মোটেই কোনো শ্বাসরুদ্ধকর বেদনাদায়ক মুভি’র চেয়ে কম ছিল না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশ সিটিং প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাদে) হত্যা করে অভ্যুত্থান ঘটায়। এর ফ্রন্টলাইনে ছিলেন তদানীন্তন মেজর ফারুক-মেজর রশিদ-মেজর ডালিম। তারা সফলও হন। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম। অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশ্তাক আহমেদ নতুন প্রেসিডেন্ট হন। ২ জন ছাড়া আওয়ামী লীগের সব সংসদ সদস্য মোশ্তাকের নতুন সরকারে যোগ দেন। এরপর সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ পদত্যাগ করলে উপ-প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম নতুন সেনাপ্রধান হন।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীরউত্তম ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আবারো একটি ক্যু হয়। খালেদ মোশাররফের এই ক্যু ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। তিনি নিজেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান হন। মোশ্তাককে সরিয়ে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট করেন। আগের অভ্যুত্থানকারীরা দেশত্যাগ করে থাইল্যান্ড উড়াল দেন। তারা দেশত্যাগের আগ মুহূর্তে কিছু সেনাসদস্য জেলখানায় আওয়ামী লীগের ৪ হাই প্রোফাইল নেতাকে হত্যা করে। আবারো টানটান উত্তেজনায় পড়ে দেশবাসী।
৩ দিন টানা উত্তেজনায় কেটে যায় জনতার দিনরাত্রি। ৭ই নভেম্বর ভোরে সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহীরা জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিপক্ষে ৩য় পাল্টা ক্যু করে। এই ক্যু’তে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের পর নিহত হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। সাধারণ জনগণ সিপাহীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে। সিপাহী ও জনতা তাদের প্রিয়নেতা বন্দি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসে। জিয়া আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন সিপাহী-জনতার সমর্থনে।
এই শেষ অভ্যুত্থানটি মূলত জাসদ সমর্থিত কর্নেল (অব.) তাহের, বীরউত্তমের কৌশলগত নেতৃত্বে হয়েছিল। কর্নেল তাহের জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধাবস্থানে ছিলেন। আর সাধারণ সিপাহী-জনতা ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষক সেই ‘মেজর জিয়া’র বন্দিতে ক্ষোভে ফুঁসছিল। ফলে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।
আস্তে আস্তে সকল ঘাত-প্রতিঘাতের অবসান হতে থাকে। জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দেশকে স্থিতিশীল করতে সামরিক শাসন জারি করেন। সিটিং প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে করেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।
মোটা দাগে এটাই ৭ই নভেম্বরের সিপাহী- জনতার বিপ্লবের সাদামাটা স্কেচ। এই বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ চরম বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত এক দুঃখজনক অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল।
আজ ৪৯ বছর পর খুব সহজে এই স্কেচ আঁকা গেলেও সেই সময়ের পরিস্থিতিটা ছিল জাতির জন্য ভয়াবহ ও টানটান উত্তেজনায় ভরা। ছিল অনিশ্চিত ও রক্তস্নাত। মাত্র ৪ বছর আগে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন করা জনতার ভাগ্য দুলছিল পেন্ডুলামের মতো। একবার ডানে, একবার বাঁয়ে।
ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বরকে যদি আমরা একেবারে নিরপেক্ষ ড্রোন শটে উপর থেকে দেখি, তবে কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় চোখে পড়বে। যেমন, এই শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয় ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল ৪টি আলাদা আলাদা গ্রুপ। এক. শেখ পরিবার সদস্যদের হত্যা করে অভ্যুত্থান ঘটানো ফারুক-রশীদ-ডালিম গ্রুপ। এরা প্রত্যেকে ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। দুই. আওয়ামীপন্থি ২য় অভ্যুত্থানকারী খালেদ মোশাররফ গ্রুপ। জেনারেল মোশাররফ ছিলেন বীরউত্তম। তিন. খালেদ মোশাররফকে পরাভূত করা জাসদ সমর্থক ৩য় অভ্যুত্থানকারী কর্নেল তাহের গ্রুপ। কর্নেল তাহেরও ছিলেন বীরউত্তম। চার. বন্দি জেনারেল জিয়াউর রহমান, সাধারণ সিপাহী ও জনতার নিরপেক্ষ গ্রুপ। জেনারেল জিয়াউর রহমানও ছিলেন বীরউত্তম। অর্থাৎ বিবদমান ও নিরপেক্ষ ৪টি গ্রুপই ছিল ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকা টগবগে মুক্তিযোদ্ধা।
৭ই নভেম্বরের সেই উত্তাল অনিশ্চিত দিনগুলোয় সাধারণ সিপাহী-জনতার কাছে বেস্ট চয়েস ছিল জিয়াউর রহমান। এর কারণ, জিয়া ছিলেন স্মার্ট, ক্যারিশম্যাটিক, সাহসী ও দেশপ্রেমিক। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাত্রির পর নেতাবিহীন হতবিহ্বল জাতির সামনে দেবদূতের মতো উদয় হয়েছিলেন এই অখ্যাত ‘মেজর জিয়া’। রেডিওর যন্ত্রপাতি টেনে দুর্গম কালুরঘাট থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা আর কমান্ডিং গলায় ‘উই রিভোল্ট’ মুহূর্তে স্পার্ক করে মুক্তিকামী জনতাকে। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। জিয়াউর রহমানই হচ্ছেন একমাত্র নেতা যিনি দুই দুইবার দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে লিড দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৬শে মার্চ দেশে যখন কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন না, তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করে মুক্তিযুদ্ধে নামিয়ে দেন তিনি। নিজেও নামেন। অকার্যকরের বদলে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেন দেশকে। আর দ্বিতীয়বার ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর। অকার্যকরের দিকে যাওয়া চরম বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রের দায়িত্ব সাহসের সঙ্গে কাঁধে নিয়ে তিনি জাতিকে ট্র্যাকে উঠান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে-‘নেতা তৈরি করা যায় না, নেতা উদয় হয়।’ মেজর জিয়া উদয় হয়েছিলেন। আবার বলা হয়- ‘প্রকৃত নেতা সে-ই, যাকে দেখামাত্র জনতা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।’ ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে সিপাহী-জনতার উল্লাস ছিল ঐতিহাসিক। এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে শহীদ জিয়ার জানাজায় উপস্থিত মানুষের সংখ্যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড হয়ে আছে। জিয়া ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন সফল সমর ও রাষ্ট্রনায়ক।
তারুণ্যের সঙ্গে জিয়া’র এক অদ্ভুত কেমিস্ট্রি আছে। কাকতালীয়ভাবে বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবী প্রজন্ম অন্য কারণে নিজেদের জেন-জি বললেও অনেকে মজা করে বলেছে- ওটা জেনারেল জিয়ার সংক্ষেপ। সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ খুব বুদ্ধিমান। প্রতিপক্ষরা যখন জেন-জি’কে ট্রল করে গে-ঞ্জি বলছে, তখন হাসনাত এক টকশো’তে সম্ভবত ট্রল এড়াতে জেন-জি’কে জেন-জেড বলে দিয়েছে। মজার বিষয়, জেড-এর মধ্যেও লুকিয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার ‘জেড ফোর্স’।
এমন একজন বিস্তৃত ব্যক্তির নাম ৭ই নভেম্বরের সঙ্গে চলে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। ৭ই নভেম্বর শুধুই নির্দিষ্ট কোনো দলের দিবস না, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস। দেশরক্ষায় সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিজয়ের এক মহান দিন।
লেখক: নাট্যকার-ফিল্মমেকার
এককথায় অসাধারণ! সাহিত্যের স্বাদও উপভোগ করেছি। ধন্যবাদ লেখককে।
very informative writing
৭ ই নভেম্বর কেনো বাংলাদেশীদের বিজয় দিবস ?? ১৬ ই ডিসেম্বরে এক দখলদার পাকিস্তান আরেক দখলদার ভারতের কাছে দখলদারিত্ত হস্তান্তর করে। ১৬ ই ডিসেম্বরে আমরা বাংলাদেশকে আমাদের বাংলাদেশ হিসাবে পাই নাই। আমরা পাকিস্তানীদের বন্দুকের গুলির নিশানা থেকে ইন্ডিয়ান রক্ষী বাহিনীর গুলির নিশানা হয়েছি। আমারা বাংলাদেশকে আমাদের বাংলাদেশ হিসাবে পেয়েছি ৭ ই নভেম্বর। ৭ নভেম্বর আমাদেরকে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়েছে। তাই বাংলাদেশীদের বিজয় দিবস ৭ ই নভেম্বর।