ঢাকা, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রবিবার, ২৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

সংবিধান অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আগাম অনুধাবন করতে পারে না

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

(৩ মাস আগে) ২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:১৮ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৪:৫৩ অপরাহ্ন

mzamin

সংবিধান একটি জাতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। জনগণ ও রাজনীতিবিদের নৈতিক মান উচ্চ (moral high ground) থাকলে অলিখিত সংবিধান দিয়েও যে শত শত বছর রাষ্ট্র চমৎকারভাবে চলতে পারে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যে লিখিত কোনো সংবিধান নেই। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথা ও রীতি (Custom and Convention) সংবিংধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর আমাদের বিস্তারিতভাবে লিখিত সংবিধান থাকার পরও জাতি সংবিধান নিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। জাতীয় জীবনে নতুন নতুন অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। ভাবা যায় যদি যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের অলিখিত সংবিধান হতো তাহলে কী হতো!

তবে লিখিত সংবিধান হলেই যে সব পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে সব লিখিত আকারে রেখে দেয়া যায় তা কিন্তু নয়। সংবিধান যত বড় ও ব্যাপক হোক না কেন তা যে একটি জাতির সব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ও অবস্থা আগাম অনুধাবন (contemplate) করতে পারে না বাংলাদেশ তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেমন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।” 

কিন্তু স্পিকার যদি অনুপস্থিত থাকেন তখন কী হবে এ বিষয়ে সংবিধান সম্পূর্ণ নীরব (silent)।

স্পিকার না থাকলে ডেপুটি স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন এমন কথাটিও আমাদের সংবিধানে নেই। অর্থাৎ যদি থাকতোও তারপরও বর্তমান অবস্থায় প্রাসঙ্গিক হতো না কেননা ডেপুটি স্পিকার এখন জেলে। বর্তমানে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার দুজনই অনুপস্থিত। অর্থাৎ আমাদের জাতি এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছবে যখন স্পিকার অনুপস্থিত থাকবেন অথবা স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার দুজনই অনুপস্থিত থাকবেন এমন অবস্থা আমাদের সংবিধান আগাম আঁচ (contemplate) করতে পারেনি।

একটি hypothetical scenario বলি। যেমন, রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার এক জায়গায় একসাথে জাতীয় প্রয়োজনে বা জরুরি কাজে হেলিকপ্টারে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনায় পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা গেলেন। এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করতে হবে এমন বিধান আমাদের সংবিধানে নেই। অর্থাৎ সংবিধান এই অবস্থাগুলো (circumstances) আগাম অনুধাবন করতে পারে নি।

গত ১৫ বছরে পতিত স্বৈরশাসক নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করেছেন। নিজে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ও নিজেদের ক্ষমতায় থাকা প্রলম্বিত করতে সংবিধানের ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে তিন তিনটি ভুয়া নির্বাচন করেছেন যার সাথে দেশের প্রকৃত ভোটারদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সর্বশেষ এ বছরের গোড়ার দিকে ডামি নির্বাচন করে আরো পাঁচ বছর টানা ক্ষমতায় থাকতে চাইছিলেন। কিন্তু আট মাসের মাথায় এক অভাবিত গণঅভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতা ছেড়ে জান বাঁচাতে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে। ফলে এভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পলায়ন এবং এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী হবে বা কীভাবে দেশ চলবে তা কিন্তু আমাদের সংবিধান আগাম অনুধাবন করতে পারেনি, না মূল সংবিধান, না পতিত সরকারের কাটাছেঁড়া করা সংবিধান।

নব্বই দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন আহমদ তিন মাসের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে গেলেন। এই অবস্থায় তাঁর নির্বাচন পরিচালনা করা ও নির্বাহী রাষ্ট্রপতির পদাধিকারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থেকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়া সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদই অনুমোদন করেনি। পরবর্তিতে সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটির বৈধতা দেয়া হয়েছিল।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন আহমদের ১/১১ এর সরকার যে ক্ষমতায় এসে প্রায় দু’বছর দেশ শাসন করেছিলেন। তাদের এই প্রলম্বিত শাসনকাল সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সমর্থন করেনি। তাদের কার্যকাল ছিল extra-constitutional (সংবিধান বহির্ভূত)। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ১/১১ সরকারের প্রধান কার্যাবলিকে বৈধতা দিতে হয়েছিল।

সফল গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব, Mass uprising সংবিধান মেনে হয় না। বাংলাদেশে তো নয়ই, পৃথিবীর কোথাও হয়নি, যেমন ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, ইরানের ইসলামী বিপ্লব, আরব বসন্ত, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি। ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সংবিধান মেনে হয়েছে? মোটেই না। বরং প্রচলিত আইন, প্রথা ও সংবিধান ভেঙেই সাধারণত গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব হয়।  সংবিধান বা আইন মেনে আন্দোলন করলে ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হতো না। জনৈক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব একদা বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে আর আইন ও সংবিধান মানলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না আর বাংলাদেশও স্বাধীন হতো না’।

সাংবিধানিক সংকট যদি বলতে হয় তা তো এখন নয় বরং খোদ ৫ই আগস্টে সৃষ্টি হয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পলায়ন করলেন সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদের আলোকে? সংবিধান মানলে তো বরং তাকে দেশ থেকে পালাতে দিয়ে সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সমর্থন করে না এমন সরকার গঠন করার জন্য সংশ্লিষ্টরা সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড তুল্য অপরাধ করেছেন!

সুতরাং সংবিধান একটি জাতির সব অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা ও জরুরি বিষয় আগাম অনুধাবন করতে পারে না। জাতির চলমান জীবনে নতুন নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়, হতে বাধ্য। জাতির বিশেষ প্রয়োজনে doctrine of necessity’র (প্রয়োজনীয়তার মতবাদ) আওতায় অনেক সময় সংবিধানের বাইরে গিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে হয়। এমন উদাহরণ বিশ্বে বহু আছে, বাংলাদেশেও আছে একাধিক নজির।

যেহেতু সফল গণঅভ্যুত্থানের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবিধানের বাইরে গিয়ে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের উচিৎ ছিল ৫ই আগস্টের পরপরই Proclamation of Revolution দিয়ে দেশ চালানো। এতে দেশ চালানো সহজ হতো, অনেক ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা হতো না, সংবিধান কিছু মানছি কিছু মানছি না এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সংবিধান স্থগিত করে অথবা বহাল রেখেও Proclamation দিয়ে দেশ চালানো যেত। শুধু সংবিধান বহাল রাখার ক্ষেত্রে ফরমান তথা Proclamation এ ঘোষণা দিতে হতো যে - if there is any conflict or conflict arisen between the existing Constitution and Proclamation in any matter, the Proclamation shall prevail (সংবিধান ও প্রোকলেমেশনের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব থাকলে বা উদ্ভব হলে প্রোকলেমেশন তথা ঘোষণা প্রাধান্য পাবে)।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে “Better late than never” (অর্থাৎ একেবারে কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভালো)। সরকারে যারা আছেন তারা ও গণঅভ্যুত্থানের নায়করা ব্যাপারটি ভেবে দেখতে পারেন। অন্তত: অনেক ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা ও সাংবিধানিক গ্যাঁড়াকল থেকে রক্ষা পাবেন। নতুবা যত দিন যাবে সাংবিধানিক গ্যাঁড়াকল ও অচলাবস্থা আরও প্রকট হবে।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Email:  [email protected]

পাঠকের মতামত

"Time and tide waits for none." কিন্তু এটাও তো ঠিক "Better late than never."

হারুন রশিদ মোল্লা
২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:৪০ অপরাহ্ন

এটি খুবই যুক্তিপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক লিখা। এখানে উপস্থাপিত যুক্তিগুলো সরকার গ্রহণ করতে পারে। আমরা সাংবিধানিক সংকট নিয়ে যে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করছি তার সমাধান হতে পারে এখান থেকে।

এম,এইচ, বারী
২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন

খুবই যুক্তিযুক্ত।

মারুফ কামাল খান
২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন

Bus already left.

Fazle Ahmed
২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

যুক্তিযুক্ত কলামে বর্ণিত মূল ফোকাসটিতে বর্তমান সরকার গেলেই বোধহয় জাতির জন্য কল্যাণকর হবে।

মো:খাইরুল ইসলাম সরকা
২৯ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status