মত-মতান্তর
রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বনাম রাজনৈতিক দর্শন: বাংলাদেশে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত
আবু জুবায়ের
(১ মাস আগে) ২৪ অক্টোবর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:১২ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০১ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের এই নিষিদ্ধকরণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি রাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। তবে প্রশ্ন থেকে যায় রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করলেই কি এর আদর্শ ও দর্শনকে মুছে ফেলা সম্ভব? ইতিহাস আমাদের বলে যে একটি সংগঠন নিষিদ্ধ করা মানেই তার আদর্শ বিলুপ্ত করা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে ছাত্রলীগ প্রমাণ করেছিল যে, রাজনৈতিক মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য ছাত্ররাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।
যদিও ছাত্রলীগের শুরুটা বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করে, সময়ের সাথে সাথে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী জড়িত হয়েছে সহিংসতা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অপকর্মে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলোতে তাদের দখলদারিত্ব, বিরোধীদের ওপর হামলা, পরীক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ, এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসাবেও কাজ করেছে । হত্যা , গুম , খুন এমনকি ধর্ষনের সাথে এই সংগঠনের সদস্যরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ এবং ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের অনেক সদস্য সহিংস আক্রমণে অংশ নেয়, যা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর নিয়মিত আক্রমণ ও নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এইসব কর্মকাণ্ড ছাত্রলীগের সুনামকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে এবং দেশের ছাত্ররাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত এর সহিংসতা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার ক্যাম্পাসে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। তবে রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করার পেছনে একটি বড় প্রশ্ন হলো এর কি সত্যিই কার্যকর প্রভাব থাকবে? একদিকে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতা কমাতে পারে কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।
ইতিহাসে দেখা যায় রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করলেই তার দর্শন বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বরং নিষিদ্ধকরণ অনেক সময় সেই সংগঠনের প্রতি জনসমর্থন বাড়ায় এবং তারা আরও গোপনে বা বিকল্প পথে তাদের কার্যক্রম চালাতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের শাসনামলে আওয়ামী লীগসহ অনেক দলকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসারকে থামাতে পারেনি। বরং আওয়ামী লীগে, ন্যাপ , কমিউনিস্ট পার্টিসহ এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছিল।
এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছাত্রলীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত নাকি তাদের কার্যক্রম সীমিত করা উচিত? একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার মানে তাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া উচিত , যেখানে তাদের অপকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে, কিন্তু তাদের আদর্শিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হবে না।
এক্ষেত্রে সীমিতকরণ হতে পারে একটি বিকল্প পথ। সরকার ছাত্রলীগের কার্যক্রমে নির্দিষ্ট সীমারেখা আরোপ করতে পারে, যেমন তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের উপর নজরদারি বাড়ানো এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শক্তি প্রয়োগের সুযোগ কমানো। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান আরোপ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এভাবে, ছাত্ররাজনীতিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে তাদের কার্যক্রম একটি নিয়মের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হতে পারে।
ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের ইতিহাসে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর অবক্ষয় এবং অপব্যবহার ছাত্ররাজনীতির ওপর মানুষের আস্থা কমিয়েছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা বা তাদের কার্যক্রম সীমিত করার সিদ্ধান্ত নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কি ছাত্ররাজনীতির একটি সুস্থ সংস্কৃতি তৈরি করতে সক্ষম হবে?
নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা আরোপের পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সাংগঠনিক সংস্কার, যেখানে ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের মূল আদর্শিক ভূমিকার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে নৈতিক ও প্রগতিশীল ভূমিকা রাখা, যা অনেক ক্ষেত্রে হারিয়ে গিয়েছে।
ছাত্রলীগের নিষিদ্ধকরণ বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে এসেছে। কিন্তু একটি সংগঠন নিষিদ্ধ করলেই তার রাজনৈতিক দর্শন বিলুপ্ত হবে না। রাজনৈতিক দর্শন মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত থাকে এবং তা আইন দিয়ে থামানো যায় না। বরং এটি আরও গভীরে শিকড় গেড়ে বসতে পারে। ছাত্রলীগের মতো একটি সংগঠনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না করে তাদের কার্যক্রম সীমিত করার মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির এক নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা একটি সুস্থ, দায়িত্বশীল রাজনীতির পথে ফিরতে পারে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে শক্তিশালী করবে।
কবি, গবেষক
প্যারিস, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
[email protected]
দেখতে হবে তো এখন সরকার কারা নিয়ন্ত্রণ করছে
গত ১৫ বছরের ছাত্রলীগ এর "আদর্শ ও দর্শন" এক্কেবারেই হাস্যকর! খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, রামদা, চাপাতি, বন্দুক দিয়ে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কান্ডই তাদের "আদর্শ ও দর্শন" । দেশের সবাই তো দেখে আসছে দেড়যুগ ধরে।
gob has taken right step
ছাত্রলীগ যে নৃশংস গণহত্যা এবং পিটিয়ে ছাত্রহত্যার মত বর্বর কাজের সাথেও জড়িত সেটা কিন্তু উল্লেখ করলেন না, আলতোভাবে একটু দোষারোপ করে বাকিটা শুধু অতীত গৌরবের কাহিনী প্রচার করে সহানুভুতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন, দেশের জনগন কিন্তু সবই জানে।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিগত ১৫-১৬ বছর পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রলীগ একটি মূর্তিমান আতঙ্ক ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল এবং বিগত সরকার পতনের মুলে ছাত্রলীগের শিক্ষাঙ্গন সহ সারাদেশে বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যক্রম ব্যাপক চাঁদাবাজি , টেন্ডারবাজি নানা অনৈতিক কার্যকলাপ প্রধানত দায়ী। যেসব সুশীলরা ছাত্রলীগকে প্রমোট করতে নীতি আদর্শের প্রতীক বলছে তারা কিন্তু এতদিন নীরবে মজা নিয়েছে কেউ ই অনুশোচনা কিংবা মিনিমাম প্রতিবাদ করতে দেখিনি!