নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়- একজন রনি আসলে কতোজন?
সময় বিবেচনায় একলা চলো নীতিতে কতোদূর যাওয়া সম্ভব?
রেজানুর রহমান
২৫ জুলাই ২০২২, সোমবার
গলদটা কোথায়? ঈদযাত্রার কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্য সময়েও কি একজন সাধারণ মানুষ খুব সহজে রেলের টিকিট সংগ্রহ করতে পারে? রেলগাড়ির অবস্থা কি মানসম্মত। রেলের যাত্রী সেবার কি এতটুকু উন্নতি হয়েছে? উন্নত এই প্রযুক্তির যুগে এখনো কেন প্রশ্ন ওঠে- ভাই ৯টার ট্রেন ক’টায় যায়? রেলের অনেক সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। কিন্তু কেন? একজন রনি এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু করেছেন। আমাদের উচিত রনির পাশে দাঁড়ানো। যদিও প্রশ্ন উঠেছে রনি কি এভাবে আলোচনায় এসে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চান? যদি রনির এই স্বপ্নও থাকে তাতে ক্ষতি কি? রাজনীতি কি খারাপ কিছু? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা এসেছে
প্রথম দিকে অনেকেই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। বরং কেউ কেউ বিরক্ত হয়েছেন। ‘এই ছেলের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নাই? রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে এসেছে। তাও আবার একা।’ ছেলেটি যেদিন একা একটি ছোট কাগজের বোর্ড হাতে উঁচিয়ে ধরে কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে গেল তখন স্টেশনে উপস্থিত প্রায় সকলেই একটু যেন অবাক হয়েছিলেন। যাওয়া-আসার পথে অনেকেই তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছেলেটির অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কমের প্রতিনিধিদের ডেকে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে এক শুনানির আয়োজন করে। শুনানিতে প্রমাণ হয়েছে অভিযুক্ত সহজ ডট কম রেলের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। এজন্য সহজ ডট কমকে সতর্ক করে দিয়ে ২ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়। মহামান্য হাইকোর্টেও ছেলেটির অভিযোগের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। ট্রেনের ছাদে যাত্রী উঠার ক্ষেত্রে মহামান্য হাইকোর্ট কঠোর নির্দেশ জারি করেছেন। এখন থেকে ট্রেনের ছাদে কোনো যাত্রী উঠতে পারবে না। এই আদেশের ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থাৎ রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হবে।
একজন রনির একক প্রচেষ্টায় এই যে একটা পরিবর্তন ঘটলো এটাই বা কম কিসের? যদিও কিছু প্রশ্নের সহজ উত্তর পাওয়া গেলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে আশঙ্কা কাটেনি। ভোক্তা অধিকারের রায়ের বিরুদ্ধে সহজ ডট কম উচ্চ আদালতে যাবে বলে এক ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কাজেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে এখনই তা বলা যাবে না। অন্যদিকে ট্রেনের ছাদে যাত্রী তোলা যাবে না মহামান্য হাইকোর্টের এই নির্দেশ আদৌ কি বাস্তবায়ন করা হবে? কারণ মহামান্য হাইকোর্টের এমন অনেক নির্দেশ জারি হলেও তা বাস্তবায়নের চিত্রটা মোটেও আশা ব্যঞ্জক নয়। তাহলে কি বলা যায় রনির আন্দোলন সফল হয়েছে? না, রনির আন্দোলন সফল হয়েছে তা বলার সময় এখনও আসেনি। তাই রনি আবার কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে হাতে শিকল ঝুলিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলে এবার শত শত রেল পুলিশের বাধার শিকার হয়েছেন। তবে রনি দমে যাননি। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি সাহসী, উদ্দীপ্ত। কারণ তার সঙ্গে ধীরে ধীরে দেশের নানা জায়গার বিবেকবান মানুষ বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে শুরু করেছে। রনি এখন আর একা নয়। সত্যি কী রনি একা নন তা বোঝার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আশ্রয় নিয়েছিলাম। প্রশ্ন ছিল ‘রেলের দুর্নীতি নিয়ে রনির আন্দোলন সম্পর্কে আপনার ভাবনা কি?’ আসুন আলোচনা করি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শতাধিক মানুষ এই আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরছি।
লিটন এরশাদ বলেছেন, এই প্রজন্ম জেগে উঠেছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে যার কোনো বিকল্প নাই। সচেতনমাত্র সকলকেই রনির পাশে দাঁড়ানো উচিত। মুহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন লিখেছেন, দুর্নীতি বের হলে অনেক জায়গারই দুর্নীতি প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই আলোচনা দরকার। এম আর আলম ঝন্টু লিখেছেন, আগামীর প্রজন্ম দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চায়। রনিরা জেগে উঠেছে।
সিরাজি সাকি লিখেছেন, রেলের দুর্নীতি খুঁজতে গেলে কিছুই থাকবে না। কম্বলের লোম বাছলে যেমন কম্বল থাকে না। কাজী মিরাজ আহমেদ শান্ত লিখেছেন, যা বহু আগেই করা উচিত ছিল আমার আপনার সেটা দেরিতে হলেও মহিউদ্দিন রনি একাই করে দেখাচ্ছে। অবশ্যই রনির পাশে দাঁড়াতে হবে। তাসলিমা জামান শিল্পী লিখেছেন, আর কত? অনেক তো হলো? এটা এখন সময়ের দাবি। মহিউদ্দিন রনির সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। নওশাদ আনসারী লিখেছেন, একজন তরুণ হিসেবে আমি অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। রনি যেটা করেছে সেটা কমই বলা যায়। কারণ রেলের শহর সৈয়দপুরে স্বচক্ষে ৩শ’ টাকার টিকিট ১১শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
নূরুজ্জামান ফিরোজ লিখেছেন, রনি আসলে এখন আর কোনো ব্যক্তি নন। সব সেক্টরের দুর্নীতি সামনে আনতে হলে এমন অসংখ্য রনিকে দরকার। মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান সাদ লিখেছেন, নূরুল দিনের কথা মনে পড়ে যায়। জাগো বাহে... মানিক মুনতাসির লিখেছেন, রনির আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। আমার মৌন সমর্থন আছে। হাসান ঝন্টু লিখেছেন, মহিউদ্দিন রনির সত্য-সাহসী একক আন্দোলন দেশের সাধারণ নাগরিকদের মাঝে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেতনাকে শানিত করলেও রেল প্রশাসনের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো অনুশোচনা নাই।
নেই আমলাদের কোনো মন্তব্য...
এবিএম সোহেল রশিদ লিখেছেন, রেল দুর্নীতিগ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রীর নিজ জেলার রেল গাড়ি পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ১৪ ঘণ্টা লেটে কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছালো। কেউ দেখার নাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে কালোবাজারির কাছে সব টিকিট। কাউন্টারে নাই। রিয়াজ হোসেন লিখেছেন, রনির ছয় দফা দাবির ব্যাখ্যা সহজ, সাবলীলভাবে সকলের সামনে তুলে ধরা দরকার। যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত খুবই জরুরি। আখতারুজ্জামান সরকার লিখেছেন, আমাদের প্রধানতম শত্রু দুর্নীতি। কম বেশি সব দপ্তরেই তা বিদ্যমান। রেল এর বাইরে নয়। অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, মেন্যুপুলেশন, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে ভ্রমণকারী নির্বিঘ্নে টিকিট কিনতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত রনি প্রতিবাদ শুরু করেছেন। এতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ওপর চাপ প্রযুক্ত হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ভালো ফলাফল আসবে।
আলমগীর আজম লিখেছেন, আমার বিবেচনায় রনির চলমান আন্দোলন যৌক্তিক। শুধু রেলে কেন? এ ধরনের আন্দোলন দুর্নীতিগ্রস্ত সব সেক্টরেই করা উচিত। তাহলে আগামী প্রজন্ম একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেলেও পেতে পারে। হাফিজুর রহমান লিখেছেন, একবার যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে রেলের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, রেলের পা থেকে গলা পর্যন্ত খেয়ে ফেলা হয়েছে। বাকি আছে মাথা। যাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
সরকার মিল্টন লিখেছেন, রনি ঠিকপথেই আছে। আমজনতা সবারই রনির সঙ্গে যোগ দেওয়া উচিত। একরামুল হক বিজয় লিখেছেন, রনি প্রমাণ করেছে সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে এভাবেই রুখে দাঁড়াতে হয়। এমন রনি থাকলে তরুণরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও উজ্জীবিত হবে। মীর আনোয়ার আলী মকবুল লিখেছেন, রনির দাবিগুলো যুক্তিযুক্ত। কঠিন একটা বিস্ফোরণ দরকার। সৈয়দপুর রেলস্টেশনে একই চিত্র। কাউন্টারে বা অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায় না। নবী ভূঁইয়া লিখেছেন, রেলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা এই যুগে যায় না। রেল প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে চালানো উচিত। আর কতো। মানুষ বিরক্ত। এইভাবে চলতে পারে না। রনির আন্দোলনের বিরুদ্ধে কয়েকজন বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। মশিউর রহমান লিখেছেন, আমার মনে হয় ছেলেটা ভাইরাল হতে চায়। তা না হলে সে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও আবার কমলাপুরে যায় কীভাবে? তার কি আর কোনো কাজ নাই? জাহিদ মুস্তাফা লিখেছেন, এই ইস্যুতে রনি বিখ্যাত।
এখন এটাই তার ইস্যু...
আমার ফেসবুক বন্ধুদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। যদিও সবার মন্তব্য তুলে ধরতে পারলাম না। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আসলে রনির একলা চলো নীতির ব্যাপারে আমাদের কার কি মনোভাব সেটাই জানার জন্য ফেসবুকে আলোচনাটা চেয়েছিলাম। আপনাদের কি মনে হয়? রনির একলা চলো আন্দোলন কি সফল হবে? রনি কি সত্যি সত্যি ভাইরাল হওয়ার জন্য এত কিছু করছেন? রেল প্রতিটি দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম। পাশের দেশ কলকাতা শহরের কথাই ধরুন না, রেলে চেপে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ কলকাতায় চাকরি করতে আসে। কলকাতার রেলের নিয়ম কানুন সবার কাছে সমান। আমরা সেটা পারি না কেন? গলদটা কোথায়? ঈদযাত্রার কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্য সময়েও কি একজন সাধারণ মানুষ খুব সহজে রেলের টিকিট সংগ্রহ করতে পারে? রেলগাড়ির অবস্থা কি মানসম্মত। রেলের যাত্রী সেবার কি এতটুকু উন্নতি হয়েছে? উন্নত এই প্রযুক্তির যুগে এখনো কেন প্রশ্ন ওঠেÑ ভাই ৯টার ট্রেন ক’টায় যায়? রেলের অনেক সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। কিন্তু কেন? একজন রনি এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু করেছেন। আমাদের উচিত রনির পাশে দাঁড়ানো। যদিও প্রশ্ন উঠেছে রনি কি এভাবে আলোচনায় এসে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চান? যদি রনির এই স্বপ্নও থাকে তাতে ক্ষতি কি? রাজনীতি কি খারাপ কিছু? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা এসেছে। তবে দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। রনি যেন এই ধরনের কোনো নেতিবাচক প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন এখন সেটাই দেখার বিষয়।
শুভ কামনা সবার জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার,
সম্পাদক, আনন্দ আলো।