ঢাকা, ৫ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় করার এখনই সময়

মো. আমিন মিয়া
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবারmzamin

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর  গ্রাজুয়েটদের মান এবং অধিভুক্ত কলেজগুলোর যথাযথ একাডেমিক মনিটরিং নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। সমালোচনার প্রধান কারণই হলো, ৩২ বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা না করে উচ্চতর শিক্ষা বোর্ড হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:

 

বোর্ড হিসেবে সফলতা:
১। প্রতি বছর ৪/৫ লাখ শিক্ষার্থীর অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করা।
২। পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ এবং সকল ফলাফল অনলাইনে দেখার সুযোগ।
৩। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে অনার্স মাস্টার্স চালু এবং  প্রতিটি বিষয়ে ২০০-৩০০ আসন বরাদ্দ দিয়ে, অধিভুক্ত কলেজ ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়িয়ে এটিকে একটি অর্থ উপার্জনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।
৪। কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস নেয়ার আগ্রহ কম হলেও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তিতে আগ্রহের ঘাটতি নেই।
৫। দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মতো প্রধান পরীক্ষক পদ্ধতি চালু করা, যা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
৬। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ এর ১ম সংবিধি লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রণীত সংবিধি অনুযায়ী  অধিভুক্ত কলেজসমূহের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
৭। অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি, আর্থিক সুবিধা ভোগের সকল কর্মসূচি ও অবকাঠামো নির্মাণে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না।
৮। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি উচ্চশিক্ষা বোর্ড হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষাকে বোর্ডের আদলে পরিচালনা করার নজির শুধমাত্র বাংলাদেশেই আছে।
৯। আইনে ২টি পরিচালক পদ থাকলেও, প্রশাসনিক কাজের জন্য ১৮টি পরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ।
১০। বোর্ড হিসেবে আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং প্রশাসনিক অবকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যা করতে পারেনি:
১। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করে অনার্সে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারা।
২। কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অবকাঠামো না থাকার পরেও অনার্স ও মাস্টার্সের অনুমোদন দেয়া এবং এসব প্রোগ্রামের  নিয়মিত ক্লাস না হওয়া।
৩। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং ভাইভা পরীক্ষার মান নিশ্চিত করতে না পারা।
৪। পরীক্ষা কমিটি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সকল বিষয়ের পরীক্ষা কমিটি গঠনের উদাহরণ কেবলমাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে।  
৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ১৯৯২ এর ১ম সংবিধির ৭(২), ৭(৩), ৭(৪), ৭(৬), ৮(২), ৮(৩), ৮(৪), ৮(৬), ৯(২), ৯(৩), ৯(৪), এবং ৯(৬) ধারা অনুযায়ী বিগত ০৫-১১-২০০৭  তারিখে অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলের ৬৩তম সভার এবং ২০০৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৯৯তম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস গঠন করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে কার্যকর রাখা হয়নি। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষা, একাডেমিক মনিটরিং ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নয়নে এই বোর্ডগুলোই যাবতীয় সুপারিশ প্রদান করার কথা। অথচ গত ৩২ বছর ধরে এগুলোকে অকার্যকর রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণগত উচ্চশিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ ও বিতর্কিত করা হচ্ছে। 
৬। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষা, একাডেমিক মনিটরিং ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রোমোশন, একাডেমিক প্রোগ্রাম চালু, নতুন একাডেমিক ইউনিট গঠন, ক্যাম্পাস সমপ্রসারণ, বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস কার্যকর করতে প্রত্যেক উপাচার্য মহোদয়কেই বাধা দেয়া হয়েছে এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে, যা বতর্মানেও চলমান।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ৫টি একাডেমিক গ্রুপকে ৫টি স্কুল/ফ্যাকাল্টি করার প্রস্তাবনা এবং বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস পুনর্গঠন করে কার্যকর করতে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার কোনো অগ্রগতি হয়নি।
৭। প্রায় ২২৫০টি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বিপুলসংখ্যক কলেজের একাডেমিক মনিটরিং, সিলেবাস, কারিকুলাম, ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নতিকরণে ধারা ৬(ট) এর আলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ শিক্ষক ও  ৬(ক), ৬(খ), ৬(গ) ৮(১), ২৬(২-ক), ২৬(২-খ), ২৪(২-ঝ), ৩৯(২), ৪১(১) ধারাসমূহের আলোকে যে পরিমাণ মডেল একাডেমিক প্রোগ্রাম থাকার দরকার ছিল, তা গত ৩২ বছরেও এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ৩২ বছর বয়সী একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৬ জন অধ্যাপকসহ ৭৪ জন শিক্ষক রয়েছে। উল্লেখ্য, দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাকে গণমুখীকরণের উদ্দেশ্যে একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনার্স, মাস্টার্স এবং অন্যান্য একাডেমিক প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১৫০ জন, এর মধ্যে অধ্যাপক ৩০ জন।
৮। আইনের ২৭(১) ধারায়, প্রাথমিক পর্যায়ে ৩টি একাডেমিক ইউনিটের উল্লেখ রয়েছে। আইনের ৬(ড) ধারার আলোকে রেগুলেশন করে শিক্ষা ও গবেষণার স্বার্থে নতুন একাডেমিক ইউনিট (স্কুল অব আর্টস, স্কুল অব ‘ল’ ইত্যাদি অথবা একই নামে ফ্যাকাল্টি) চালু করতে পারবে। বোর্ডের পরিচালক পদ বাড়াতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একাডেমিক ইউনিট বাড়াতে পারে নাই। 
৯। আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী দেশের যেকোনো স্থানে ক্যাম্পাস স্থাপন করার সুযোগ থাকলেও, ৩২ বছর বয়সী একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথচ নিজস্ব একাডেমিক ক্যাম্পাস করতে পারেনি, ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত  করতে পারেনি। অথচ, একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তার রয়েছে উপাচার্যের বাসভবনসহ নিজস্ব দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ক্যাম্পাস।
উল্লেখ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার প্রথম তথা অন্যতম প্রধান সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটিকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্য গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় মনে করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে লাহোর থেকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত একটি বিশাল অঞ্চল এর অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলের ১৫১টি স্নাতক কলেজ ও ১৬টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। কলকাতা শহর ও শহরতলিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি ক্যাম্পাস/শিক্ষাপ্রাঙ্গণ (কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস, রাজাবাজার ক্যাম্পাস, শহীদ ক্ষুদিরাম শিক্ষা প্রাঙ্গণ ইত্যাদি) এবং ৭টি ফ্যাকাল্টি রয়েছে। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪র্থ। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
১০। আইনের ৬(ঠ) ধারার আলোকে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে, মানসম্মত গবেষণা কর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের গবেষণা ভাতা ও পুরস্কার প্রদানের সুযোগ অপ্রতুল। গবেষণাবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতি বছর গবেষণায় বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগই অব্যয়িত থাকে।
১১। আইনের ১২ (৩) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, “ভাইস-চ্যান্সেলর এই আইন, সংবিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলেশনের বিধান বিশ্বস্ততার সহিত পালনের নিশ্চয়তা বিধান করিবেন এবং এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে পারিবেন।”  অথচ প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর ধরে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ উপাচার্যগণ আইন প্রতিপালন করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পরিচালনা না করে শুধুমাত্র বোর্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। 

পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে পরিচালিত না হয়ে শিক্ষা বোর্ডের মতো পরিচালিত হলে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কখনই উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। মূল উপাদানকে অগ্রাহ্য করে, গত ৩২ বছরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পাঠকের মতামত

এটাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় না বলে 'জাতীয় উচ্চ শিক্ষা বোর্ড' বলা অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং যা একটি ব্যবসায়ী লাভ জনক প্রতিষ্ঠান।

মো.নুরুল আমিন
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার, ৮:০৯ পূর্বাহ্ন

সব এখন কেন? বিএনপি আগে আসুক রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাদের জন্য কিছু কাজ রাখুন।

মিলন আজাদ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status